চিঠি

প্রতীকী ছবি
অলংকরণ: স্বপন চারুশি

বিদেশে আসার পর সবার সঙ্গে ফোনেই কথা হতো। কখনো কাউকে চিঠি লেখা হয়নি। কারণ, এ আধুনিক ব্যস্ত যুগে কে আর চিঠি লেখে। তবে গত কয়েক মাস থেকে, আমি আমার মাকে নিয়মিত চিঠি লিখছি। প্রতি পনেরো দিনে একটি চিঠি। আজ অবশ্য মাকে চিঠি লেখার কথা ছিল না। কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই কাগজ–কলম নিয়ে মাকে চিঠি লিখতে বসে গেলাম। কারণ, গত রাতে আমি আমার মাকে স্বপ্নে দেখেছি।

মাকে চিঠি লিখতে বসলে আমার কিছুই ভাবতে হয় না। শুধু কাগজের ওপর কলম ধরলেই হয়। মনে হয় কলম নিজে থেকেই সব লিখে দেয়।

মা,
তুমি কেমন আছ? জানি বলবে, আমার কথা বাদ দে। আগে বল, তুই কেমন আছিস বাবা? মা, আমি ভালো আছি।
জানো মা, গত রাতে তোমায় আমি স্বপ্নে দেখেছি। এত পরিষ্কার স্বপ্ন। মনে হচ্ছিল এ স্বপ্ন না, বাস্তব। দেখলাম, তুমি বিছানায় শুয়ে আছ। হাঁটুর বাতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছ। আর আমি তোমার পায়ের কাছে বসে, তোমার হাঁটুতে গরম রসুন-তেল মালিশ করছি। তুমি বারবার বলছ, আর লাগবে না বাবা। তুই যা, আমার এখন আর ব্যথা করছে না। হা হা হা...আমি জানি তুমি মিথ্যা বলছ। আসলে তুমি চাও না তোমার ছেলে কষ্ট করুক। তোমার মুখ দেখলেই যে কেউ বলে দিতে পারবে, তোমার পায়ে অনেক ব্যথা করছে।
মা, তোমার মনে আছে, তোমার যখন হাঁটুতে অসহ্য ব্যথা হতো, তুমি তখন মুখ দিয়ে কষ্টে একধরনের আওয়াজ করতে। আওয়াজটা নিয়ে আমি খুবই কনফিউজড ছিলাম। কখনো মনে হতো তুমি কু কু করছ, আবার কখনো মনে হতো তুমি উ উ করছ। কেমন জানি একটা ছন্দময় তালে, বিরতি দিয়ে দিয়ে তুমি আওয়াজটা করতে। উ…উ…উ…
আমি একদিন কলেজে শেষে আড্ডা দিয়ে রাতে বাসায় ফিরে দেখলাম, তুমি বিছানায় শুয়ে বাতের ব্যথায় ওই ছন্দময় উ উ আওয়াজ করছ। আমি তোমার সামনে গিয়ে কড়াভাবে বললাম,
—তোমার সমস্যা কী? তুমি কু কু করছ কেন?
—বাবা, হাঁটুতে অসহ্য ব্যথা হচ্ছে।
—বুঝলাম। কিন্তু কু কু করছ কেন? ব্যথা হলে কি কু কু করে আওয়াজ করতে হবে?
—আওয়াজটা করলে ব্যথাটা একটু কম মনে হয়, বাবা।

—ফালতু কথা বলবে না, মা। তোমার এই আওয়াজটা খুবই বিরক্তিকর। প্লিজ আর আওয়াজ করবে না। আর যদি করতেই হয়, মনে মনে করবে।
—বাবা একটু তেল-রসুন গরম করে মালিশ করে দিবি? খুব ব্যথা করছে।
—মা শোনো, আমি সারা দিন পর মাত্র বাসায় ফিরলাম। আমি এখন খুবই ক্লান্ত। আমি পারব না।
বলে অন্য রুমে চলে গেলাম।
হায়রে ক্লান্ত। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ফালতু সময় কাটিয়ে নাকি ক্লান্ত। আফসোস। এখন এসব মনে হলে চোখ ভিজে যায়। জানো মা, ওই সব আড্ডাবাজ বন্ধুর কারও সঙ্গেই এখন আমার তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। তারা সবাই নিজ নিজ জীবন নিয়ে ব্যস্ত। জানি এটাই বাস্তবতা। অথচ তুমি আগেও আমার পাশে ছিলে, এখনো আছ। আর প্রতিনিয়ত আমার জন্য দোয়া করে যাচ্ছ।
মা জানো, এখন কি মনে হয়? মনে হয়, ইশ্‌ এখন যদি তোমার কাছে থাকতে পারতাম। তাহলে সারা দিন তোমার হাঁটুতে তেল মালিশ করে দিতাম। আর বলতাম, মা তুমি যত জোরে পারো, চিৎকার করে কু কু আওয়াজ করো। দেখি কে আমার মাকে কিছু বলে। জানো মা, ইদানীং আমার হাঁটুতেও কেমন জানি ব্যথা করে। মনে হয় তোমার মতোই বাতের ব্যথা। ব্যথা উঠলে আমিও তোমার মতো কু কু করে আওয়াজ করি। তুমি মা ঠিকই বলেছিলে, ওই আওয়াজটা করলে কেমন জানি ব্যথাটা একটু কম মনে হয়।

মা জানো, তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা হয়। কথা বলতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু তুমি তো আমার ওপর রেগে আছ। ফোনও ধরো না। কথাও বলো না। আমি তোমাকে কত চিঠি লিখি। অথচ তুমি একটা চিঠিরও উত্তর দাও না। আমি জানি তুমি কেন এমন করছ। আসলে তুমি চাও, তোমার ছেলেকে ফোনের স্ক্রিনে না, সরাসরি দেখতে। তুমি তোমার ছেলের চিঠি পড়তে চাও না। তুমি চাও সামনাসামনি বসে ছেলের কথা শুনতে। তুমি চাও ছেলেকে জোরে বুকে চেপে ধরতে। আমিও তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাই মা। মনে হয় তোমাকে জড়িয়ে ধরে মন ভরে অনেকক্ষণ কাঁদি। জানো মা, আমার এই দুই চোখে অনেক কান্না জমে আছে।
মা, আমি আর লিখতে পারছি না। বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে। মা, জানো এখন আমি কি করব? এখন আমি বাথরুমে যাব। তারপর শাওয়ার ছেড়ে চিৎকার করে, মা মা বলে বিলাপ করে অনেকক্ষণ কাঁদব। আমি জানি, আমার এই লাইনটি পড়ে তুমিও বিলাপ করে কাঁদবে। কাঁদো মা কাঁদো। কেঁদে একটু হালকা হও। চলো এক কাজ করি, দুই মা-ছেলে একসঙ্গে চিৎকার করে কাঁদি। ভালো থেকো মা।
ইতি
তোমার আদরের বাবা
প্রতিবার আমার চিঠি হাতে পেয়ে বড় ভাই আমাকে ফোনে একটা মেসেজ পাঠায়। এবারও এই চিঠি পেয়ে ভাই আমাকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছে।
‘ভাই, তোর আগের চিঠিগুলোর মতোই, শেষ লেখা চিঠিটিও মাকে পড়ে শুনিয়েছি। তারপর চিঠিটি কবরস্থানে মায়ের পায়ের কাছে রেখে এসেছি। মা ভালো আছে। তুইও ভালো থাকিস।’
বি. দ্রষ্টব্য:
মায়েরা কখনোই তার বুকের ধনকে এই দুনিয়ায় একা ফেলে চলে যান না। তিনি সব সময় সন্তানের আশপাশেই থাকেন। সন্তানকে দোয়ায় রাখেন, দেখে রাখেন।
বি. দ্রষ্টব্যের বি.দ্রষ্টব্য:
পৃথিবীর সব বাবা-মাকে আল্লাহ ভালো রাখুন। আর যাঁরা চলে গেছেন,আল্লাহ তাঁদের জান্নাত নসিব করুন। আমিন।
*লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]