কুইন্টে উপসাগরের মিথলজি
অতি প্রাচীন সময় থেকেই মানুষ এই মহাসৃষ্টির রহস্য বুঝতে চেয়েছে। জ্বলন্ত সূর্য থেকে শুরু করে অতল জলরাশি—সবখানেই প্রাচীন মানুষের জন্য ছড়িয়ে ছিল রহস্য। কিন্তু তখনো বিজ্ঞান ততটা এগিয়ে যায়নি। তাই যেকোনো অসামান্য প্রাকৃতিক সৃষ্টিকে মানুষ সমীহ করে এসেছে, করেছে প্রাকৃতিক শক্তির আরাধনা। এই মহাসৃষ্টির আড়ালে একজন মহাশক্তিমান লুকিয়ে আছেন এবং তিনি মানুষের কাজে পরোক্ষভাবে অংশ নিয়ে থাকেন…এই বিশ্বাস অসহায়, জ্ঞানহীন ও বিভ্রান্ত মানুষকে দিয়েছে সান্ত্বনা আর আশা। এভাবেই মিথলজি বা পৌরাণিক কাহিনির যাত্রা শুরু হয়েছে। স্বর্গের দেব–দেবী এবং পৃথিবীর বীরদের প্রচলিত কাহিনিকেই মিথলজি বা পৌরাণিক কাহিনি বলা হয়। এই গল্পগুলোর পেছনে থাকে দৃঢ় নৈতিকতা, মানবিকতা, সুবিচার, ত্যাগ বা সংগ্রামের গল্প। অনেক সময় কোনো একটা ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার ভিত্তিতেও মিথলজি সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেক সমালোচক মনে করেন। এ পর্যন্ত সংগৃহীত প্রায় সব মিথলজির গল্পে ইটারনিটি বা অনন্তকালের একটা সংযোগ থাকে। কানাডার লেইক অন্টারিওর উত্তর–পূর্বে অবস্থিত কুইন্টে উপসাগরকে ঘিরে মোহক উপজাতির মধ্যে প্রচলিত একটি মিথলজির গল্প নিয়ে আজকের এই আলোচনা।
কুইন্টে উপসাগরের ওপর নরিস হুটনি ব্রিজ
কানাডার লেইক অন্টারিওর উত্তর–পূর্বে কুইন্টে উপসাগর অবস্থিত। বিশ্বাস করা হয়, এই উপসাগরের নিচে কিছু গুপ্ত প্রসবণ থাকায় এর পানির উচ্চতা কখনো কমে না। উপসাগরটি মোহক আদিবাসীদের জন্য খুব পবিত্র জলাশয়। তারা বিশ্বাস করে, অনেক আগে এই জলাশয়ের ওপরের আকাশে একজন স্বর্গের দেবী বাস করতেন। একবার তিনি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মর্ত্যে নেমে আসেন এবং এক মৃত কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। শোকাতুরা দেবী সেই কন্যাসন্তানকে মর্ত্যেই সমাহিত করেন। কিছুদিন পর সেই কবর থেকে ভুট্টা, বিনস (একধরনের শিম) ও স্কোয়াশ (একধরনের কুমড়া) নামে তিন বোনের জন্ম হয়। মোহকরা বিশ্বাস করত, এই তিন দেবী–বোন এই উপসাগরে বাস করে এবং সৃষ্টিকর্তা মেনিটোর কাছে মোহকদের প্রার্থনা পৌঁছে দেয়। তাই মোহকরা উপসাগরে থাকা তিন বোনের জন্য নৈবদ্য দিত এবং উপসাগরটিকে দেবতার হ্রদ মনে করত।
একবার মোহকদের এক গোত্রপ্রধান তার সুন্দরী কন্যা টাইওয়ারহের সঙ্গে গোত্রের এক বীর যোদ্ধা এনোসোথকার বিয়ে ঠিক করে। এদিকে টাইওয়ারহে গোপনে মন দিয়েছে গোয়ান্ডা নামের একজনকে। গোয়ান্ডা অন্য আরেকটি গোত্রের যোদ্ধা এবং সেই গোত্রের সঙ্গে টাইওয়ারহের বাবার যুদ্ধ চলছিল। সেই সময়ে গোয়ান্ডা ছিল টাইওয়ারহের বাবার কারাগারে বন্দী এবং কারাগারেই গোয়ান্ডার সঙ্গে তার পরিচয় ও প্রণয়। এনোসোথকার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ায় টাইওয়ারহে খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় এবং গোয়ান্ডার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক টাইওয়ারহের সাহায্যে এক রাতে গোয়ান্ডা কারাগার থেকে পালিয়ে যায়। কথা ছিল উপসাগরের অন্য প্রান্তে ঝরনাতলায় টাইওয়ারহের সঙ্গে তার দেখা হবে।
এদিকে সকালে কারাগার থেকে গোয়ান্ডার পালিয়ে যাওয়ার খবর জানাজানি হয়ে গেলে কারারক্ষীদের মধ্যে শোরগোল পড়ে যায় এবং তারা গোয়ান্ডাকে খুঁজতে বের হয়। টাইওয়ারহে হঠাৎ দেখতে পায় যে চল্লিশটি ক্যানু নিয়ে তার বাবা গোয়ান্ডাকে ধরতে আসছে। এদিকে গোয়ান্ডাও খুব দ্রুত তার ক্যানু নিয়ে পালাতে শুরু করে এবং দেবতার হ্রদের মাঝখানে একটি দ্বীপে ঘাসের জঙ্গলে দ্রুত আত্মগোপন করে। সারা দিন কারারক্ষীরা গোয়ান্ডাকে খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। সন্ধ্যা নেমে এলে দেবতার হ্রদের ওপর চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ে। সে আলোয় হ্রদের পানিতে গাছের কালো লম্বা ছায়া জোনাকির আলোয় ঝিলমিল করতে থাকে। চমৎকার সেই রাতে টাইওয়ারহের গোত্রের মানুষেরা উৎসবের আয়োজন করে। নারী, শিশু, যুবক সবাই নাচের আনন্দে মেতে ওঠে এবং টাইওয়ারহেও সবার সঙ্গে আনন্দ করার ভান করে। তারপর সুযোগ বুঝে একসময় চুপিচুপি সাবধানে হ্রদের অন্য প্রান্তে ঝরনাতলায় গিয়ে গোয়ান্ডার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
টাইওয়ারহে সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও এনোসোথকা তাকে অনুসরণ করে হ্রদের প্রান্তে পৌঁছে যায় এবং চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘টাইওয়ারহে আমি তিনবার বলেছি যে আমি তোমায় ভালোবাসি। আমার সঙ্গে এক্ষুনি চলো।’
টাইওয়ারহের বাবাও এসে পৌঁছে যায় এবং রেগেমেগে বলতে থাকে, ‘এনোসোথকার সঙ্গেই তোমার বিয়ে।’
নিরুপায় টাইওয়ারহে জানে যে এনোসোথকাকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার ছোট হৃদয়ে ঝড় ওঠে। অসহায় চোখে সে তাকায় দেবতার হ্রদের অন্য তীরে, যেখানে লম্বা ঘাস আর ঘন বৃক্ষের আড়ালে অপেক্ষায় আছে তার হৃদয়ের রাজা গোয়ান্ডা। হঠাৎ করেই টাইওয়ারহে শরীরে স্বর্গীয় শক্তি ভর করে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নোঙর করে রাখা ক্যানুতে। দ্রুত ক্যানু ছুটতে থাকে হ্রদের অন্য পাড়ে, যেখানে গোয়ান্ডা আছে। পেছনে পেছনে ছুটে আসতে থাকে এনোসোথকা।
একসময় টাইওয়ারহে গোয়ান্ডার খুব কাছে চলে আসে। কিন্তু সময় বেশি নেই। পেছনে এনোসোথকা ছুটে আসছে খুব দ্রুত। টাইওয়ারহে একসময় বুঝতে পারে যে গোয়ান্ডার কাছে পৌঁছানোর আগেই এনোসোথকা তাকে ধরে ফেলবে। কোনো উপায় না পেয়ে টাওয়ারহে আর গোয়ান্ডার কাছে না গিয়ে ঝরনার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অক্ষম আক্রোশে অসহায় গোয়ান্ডাও টাইওয়ারহেকে বাঁচানোর জন্য ঝরনার প্রচণ্ড ঘূর্ণিজলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তীব্র স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাদের। প্রেমপাগল এক তরুণ আর তরুণী হারিয়ে যায় অথই জলে। সারা রাত ধরে গোত্রপ্রধান আর এনোসোথকা, দলের সবাইকে নিয়ে টাইওয়ারহেকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু টাইওয়ারহের খোঁজ মেলে না।
এদিকে স্বর্গের দেবীর তিন কন্যা এই ভালোবাসার সাক্ষী ছিল। তারা দেখেছিল টাইওয়ারহে আর গোয়ান্ডার ভালোবাসা কতটা পবিত্র এবং নিখাদ। তাই তিন কন্যা প্রেমিক যুগলকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়। উপসাগরের নিচে থাকা একটা পাথরের দেয়ালের অন্য পাশে তারা টাইওয়ারহে আর গোয়ান্ডার আত্মাকে নিয়ে যায়। সেদিন থেকে দেবীকন্যাদের সহায়তায় টাইওয়ারহে আর গোয়ান্ডার অশরীরী আত্মা উপসাগরের নিচে চিরকালের জন্য সুখে বাস করতে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের লেখক জোসেফ ক্যাম্পবেল (১৯০৪-১৯৮৭) তাঁর ‘দ্য মাস্ক অব গড’ সিরিজের ‘ক্রিয়েটিভ মিথলজি’ গ্রন্থে বলেছেন, মানবসমাজে মিথলজির চার ধরনের ভূমিকা আছে। প্রথমত, মানুষের পক্ষে অপার্থিব জগৎ এবং জন্মমৃত্যুর অপার রহস্য নিজের চোখে দেখা সম্ভব নয়। মিথলজির গল্প ও মিথলজিতে ব্যবহার করা বিভিন্ন প্রতীক মানুষকে এই জগৎ ও রহস্যকে বুঝতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন সময়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হওয়ার আগে পৃথিবী, মহাজগৎ, প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য বিষয়ে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের সুযোগ ছিল কম। কাজেই মানুষ মিথলজির মাধ্যমে এই জ্ঞান লাভ করত। ক্যাম্পবেলের ভাষায় সেই সময় মিথলজি ‘প্রটো সায়েন্স’ হিসেবে কাজ করত। তৃতীয়ত, সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় মিথলজির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন সমাজগুলোকে টিকে থাকার জন্য আইন প্রণয়ন করতে হতো এবং এসব আইন তৈরির সময় তারা মিথলজির ওপর নির্ভর করত। কারণ, তারা বিশ্বাস করত, মিথলজি দেবতাদের সৃষ্টি এবং পবিত্র। কাজেই রাষ্ট্রের আইন, সামাজিক রীতি, নৈতিকতা ইত্যাদির জন্য মিথলজিনির্ভরতা ছিল খুবই গ্রহণযোগ্য একটি পন্থা। সবশেষে মানুষের জীবনে নানা পর্যায়ে মানসিক ও আবেগীয় সংকট আসে। সেই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য মিথলজি একজন ব্যক্তিকে জীবনের প্রতি ধাপে নির্দেশনা দেয়।
উত্তর আমেরিকার মিথলজিগুলো আদিবাসীদের মধ্যে মৌখিকভাবে প্রচলিত এবং কোনো সুনির্দিষ্ট লেখক নেই। গল্পগুলোতে দেব–দেবীর উপস্থিতি, পৃথিবীর মানুষের কাজে তাদের অংশগ্রহণ এবং পৃথিবীর সমান্তরালে থাকা আরেকটি অতিপ্রাকৃতিক জগতের উপস্থিতি থাকে। মোহক উপজাতির এই মিথলজির গল্পটিতেও স্বর্গের দেবীর তিন কন্যার উল্লেখ আছে। এই গল্প থেকে এটাও জানা যায় যে প্রাচীন সময়ে উপজাতিগুলোতে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ছিল এবং বিয়ের ক্ষেত্রে নারীর মতামতের কোনো মূল্য ছিল না। বিভিন্ন প্রাচীন গোত্রগুলোর মতো এখানেও পেশিশক্তির প্রাধান্য ছিল। মিথলজির গল্পগুলো খুব সরল আর সহজ হওয়ার কারণেই সম্ভবত ধরে নেওয়া হয় যে মিথলজির গল্প শিশুতোষ সাহিত্য গোত্রের। কিন্তু সাহিত্যে এবং জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অগ্রযাত্রায় মিথলজি বা পৌরাণিক কাহিনির অসামান্য ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। বরং বলা যায়, মিথলজির মধ্য দিয়ে জানাটা অনেক বেশি সৃজনশীলতার ও আনন্দের।
*লেখক: সামিনা চৌধুরী, টরন্টোয় বাস করছেন এবং কানাডা পোস্টে কর্মরত
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]