একজন মায়াবতীর গল্প

সহপাঠীদের সঙ্গে লেখকের ভাগ্নি সেমন্তি

আমার মায়েরা ছিলেন মোট ১১ বোন আর ৩ ভাই। সেই সূত্রে আমার খালাদের আদরে আদরে বেড়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু বিয়ের সূত্রে তাঁরা বিভিন্নজন বিভিন্ন জায়গায় থাকতেন। তাই আর তাঁদের আদর তেমন একটা পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে আমার ছোটবেলায় মায়েরা যখন সব বোন মিলে নানাবাড়ি নায়রে যেতেন, তখন সবার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হতো। আমি অবশ্য তাঁদের সবাইকে চিনতামও না।

আমাদের গ্রামেই আমার মায়ের পরের বোনের বিয়ে হয়েছিল। মা আমাকে প্রায়ই বিভিন্ন জিনিস আনতে তাঁদের বাড়ি পাঠাতেন। কিন্তু আমি লজ্জায় যেতে পারতাম না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে ফিরে এসে বলতাম যে জিনিসটা তাঁদের নেই। এমন না যে খালা আমাকে আদর করতেন না। খালা প্রচণ্ড আদর করতেন এবং এখনো করেন। গত বছর দেশে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল।
এরপর একসময় পড়াশোনার জন্য কুষ্টিয়া ছেড়ে ঢাকায় এসে বুয়েটের হলে বসবাস শুরু করলাম। এরপর চাকরিসূত্রে স্থায়ীভাবে ঢাকায় থাকা শুরু করলাম। তাই মা, খালা ডাকগুলো দেওয়ার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। সেই জায়গাগুলো পূরণ করল বন্ধুবান্ধবের ভাইবোনের মেয়েরা। ছোটদের দেখলেই আমার দুরন্ত শৈশবের কথা মনে পড়ে যেত। বিশেষ করে মেয়েশিশুদের মনে হয় ফুলের কুঁড়ি। তারা যখন একই রঙের পোশাক পরে স্কুলে যায়, তখন আমার কাছে মনে হয় একঝাঁক পরী দল বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে।

আমার বন্ধুবান্ধব সবাই আমার কাছে নিজের পরিবারের সদস্যের মতো। তাই তাদের আত্মীয়স্বজনও আমার নিজের আত্মীয়স্বজনের মতো। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তাদের আত্মীয়স্বজনদের বাসায় গেলে সবার আগে সেই বাড়ির শিশুদের সঙ্গে আমার ভাব হয়ে যায়। হয়তোবা তারা আমার আচার-আচরণে, কথাবার্তায় তাদের সমকক্ষ কেউ মনে করে। এমনই একবার সাগর ভাইয়ের সঙ্গে তাঁদের এক বোনের বাসায় গিয়েছিলাম। সাগর ভাই আমার বন্ধু শিশিরের বড় ভাই। সেই সূত্রে আমাদের সবারই বড় ভাই হয়ে গিয়েছিলেন। এখনো তা-ই আছেন।
বাসাটা ছিল ঢাকার আজিমপুর কলোনিতে। বাসায় গিয়ে দেখি আপুর দুটি মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। আমাদের পরিবারে আমরা তিন ভাই। কোনো বোন নেই। তাই বরাবরই মেয়েরা আমাদের কাছে আদরণীয়। তাদের সঙ্গে নিমেষেই ভাব হয়ে গেল। বড়জন তখন মাধ্যমিকের ছাত্রী, আর ছোটজন যত দূর মনে পড়ে তখনো স্কুলের আঙিনায় পা রাখেনি। এরপর তাদের দুই বোনের সঙ্গে চলল আমার গুটুর গুটুর ফুসুর ফুসুর অনেক গল্প। বড়জন (সেঁজুতি) একটু লাজুক, কিন্তু সেই তুলনায় ছোটজন (সেমন্তি) অনেক চটপটে। তাদের সঙ্গে কত যে গল্প হয়েছিল, তার ইয়ত্তা নেই। তবে এটুকু মনে আছে, আসার আগপর্যন্ত ছোটজনের সঙ্গে আমার গল্প চলছিল।

সেদিনই আমি বড়জনের সঙ্গে মা আর ছোটজনের সঙ্গে খালা সম্পর্ক পাতিয়ে ফেললাম। একসময় বাংলাদেশে এমন পাতানো সম্পর্কের অনেক কদর ছিল। আমার দাদির একজন পাতানো ভাই ছিলেন। তিনি প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসতেন। আমার দাদিও নিয়মিত তাঁদের ওখানে গিয়ে থাকতেন। বাড়িতে কোনো কিছু নিয়ে মনোমালিন্য হলে সেই পাতানো ভাইয়ের বাসায় গিয়ে ডুব দিতেন। আমার কাছেও আমার এই মা-খালার গুরুত্ব অপরিসীম। আমার মায়ের এখন বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের সংসার আলো করে এসেছে এক রাজকন্যা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সব খবরই এখন হাতের মুঠোয়। যদিও আমার সঙ্গে এখনো আমার নাতনির অফিশিয়ালি দেখা হয়নি।
খালামণি নাকি আমাকে প্রথম দেখে ভেবেছিল আমি কালো মেকআপ নিয়ে এসেছিলাম। সেই কথাই নাকি আপু আর দুলাভাইকে বলেছিল। সাগর ভাই খালামণির সঙ্গে আমার একটা ছবি তুলেছিলেন। খালামণি আমাকে সেই ছবি পাঠালে নিজেকে অনেক তরুণ মনে হচ্ছিল। এরপর খালামণির সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল বন্ধু শিশিরের বিয়েতে। তখন বুদ্ধি করে মা আর খালামণিকে আমার দুই পাশে বসিয়ে ছবি তুলে রেখেছিলাম। আমি এখনো ঘুরেফিরে ছবিগুলো দেখি। আসলে সুখস্মৃতিগুলোই তো আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সঞ্চয় ও চালিকা শক্তি।

আমার মা এখন স্বামী-সংসার নিয়ে ব্যস্ত, তাই অন্তর্জালে সামান্য যে কথাবার্তা, সেটা হয় খালামণির সঙ্গেই। আমার সেই ছোট্ট খালামণি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ছোটবেলায় দেখতে যেমন আদুরে ছিল, এখনো তেমনি সুন্দরী আছে। খালামণির সঙ্গে খণ্ড খণ্ড কত স্মৃতি। একবার খালামণি প্রথম আলোর মঙ্গলবারের ক্রোড়পত্র নকশার জন্য মডেল হয়েছিল। ছোট শিশুদের সাজগোজের সেই ছবিতে খালামণিকে কি সুন্দর লাগছিল। আমি তখন প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সন থেকে খালামণির ছবিগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছিলাম। পরে কালের স্রোতে সেই ছবিগুলো হারিয়ে ফেলেছি।
আমি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বড় ভক্ত অনেক কারণে। তিনি বাংলাদেশের মানুষের মনস্তত্ত্ব সবচেয়ে ভালো বুঝতেন বলেই আমার ধারণা। তিনি আমাদের বইপড়া শিখিয়েছিলেন। তিনি আমাদের সৌন্দর্যবোধও শিখিয়েছিলেন। তাঁর গল্পের সব তরুণীই অসম্ভব সুন্দরী। এখন খালামণিকে দেখলে আমার তাই বেশি করে তাঁর কথা মনে পড়ে। আমার খালামণি প্রাকৃতিকভাবেই স্নিগ্ধ সুন্দর। মুখটার দিকে তাকালে মনে হয়, কোনো এক শান্ত নদীর দিকে তাকিয়ে আছি। আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, তিনি মনে হয় হিমু সিরিজের ‘রুপা’ আমার খালামণিকে কল্পনা করেই লিখেছিলেন। যা হোক, আমি যদি কখনো উপন্যাস লিখি, তবে আমার গল্পের নায়িকারা হবে আমার খালামণির মতো নিরহংকার, সুন্দরী।

অনেক দিন হয়ে গেল ফেসবুক থেকে দূরে। সেই সঙ্গে লেখালেখি থেকেও। একগাদা বই জমে গেছে। সেগুলো পড়ছি। তাই লিখে নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। খালামণির জন্মদিন সামনে আসাতে ভাবলাম আবার একটু লেখার চেষ্টা করা যাক। আমার খালামণি তার মায়ার জাদুতে পরিবারের সবাইকে যেমন বেঁধে রেখেছে, ঠিক তেমনি বেঁধে রেখেছে সহপাঠীদের। আমি খালামণির চোখ দিয়ে নতুন প্রজন্মের ভাবনাকে দেখি। অনেকেই বলে থাকেন নতুন প্রজন্ম আদবকায়দা, পড়াশোনা কিছুই শিখছে না। কিন্তু আমি খালামণির বন্ধুদের দলকে দেখি আর আশান্বিত হই।
আমার খালামণি শতায়ু হোক—জন্মদিনে এমনটাই প্রত্যাশা। খালামণির মায়ার বাঁধনে একসময় পুরো বিশ্ব বাঁধা পরবে। এটাই আমার আশা। আমার খালামণি নিজ গুণে আপন করে নিক তার চারপাশের সবকিছুই। তার মায়ার পরিধি দিন দিন বাড়তে থাকুক। যতটা মমতা নিয়ে সে তার চারপাশকে আপন করে নেবে, তার চেয়ে বহুগুণ মায়া নিয়ে যেন তার চারপাশ তাকে আপন করে নেয়। এভাবে আমরা যদি সবাই সবাইকে আপন করে নিতে পারি, তাহলে পুরো বিশ্বই একটা পরিবারের রূপ নেবে একসময়। বেঁচে থাকুক আমাদের মায়েরা, খালারা। আমরা বেঁচে থাকি তাদের আদরে, মায়ায়।
অনেক দিন হয়ে গেল আমার মা-মণি ও খালামণির সঙ্গে দেখা নেই; কিন্তু সেটা আমাদের সম্পর্কে কোনো দূরত্ব তৈরি করেনি। আসলে অকৃত্রিম সম্পর্কগুলো তো এমনই হয়। যেখানে কোনো চাওয়া-পাওয়ার বিষয় থাকে না। থাকে শুধু বিনিসুতার মায়ার বাঁধন। আর থাকে একে অপরের জন্য অন্তরের অন্তস্তলের হৃদয় নিংড়ানো দোয়া, শুভকামনা ও ভালোবাসা। তবে আশা করি খুব শিগগিরই মা-মণি ও খালামণির সঙ্গে দেখা হবে। আমি অধীর আগ্রহে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছি।