মন্ট্রিয়লে উদীচীর মনোমুগ্ধকর বর্ষবরণ অনুষ্ঠান

ছবি: লেখকের পাঠানো

এত বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম, দাঁড়িয়েও দেখার সুযোগ পাননি অনেকেই। তবু হলের ভেতর কোনো কোলাহল নেই। যাঁরা বসতে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা পেয়েছেন, গভীর মনোযোগে উপভোগ করেছেন পুরো অনুষ্ঠান। একটানা সন্ধ‍্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা। সময়মতো শুরু, শেষও সময় ধরেই। গত রোববার (২০ এপ্রিল) মন্ট্রিয়লের লাভোয়া হাইস্কুলের প্রবেশদ্বার থেকে অডিটরিয়াম রূপ নিয়েছিল লোকে লোকারণ্যে। বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনে উদীচীর ডাকে যোগ দিয়েছিলেন দল–মত–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সব বয়সের মানুষ।

সাবেক বিসিএস (প্রশাসন) আমলা, কবি অপরাহ্ণ সুসমিতো অনুষ্ঠানস্থলে এসেছিলেন সময়মতোই। বসে মুগ্ধ হয়ে অনুষ্ঠান উপভোগও করছিলেন। একসময় তিনি দেখেন, বসার জায়গা না পেয়ে একজন নারী অডিটরিয়ামের সিঁড়িতে বসে অনুষ্ঠান দেখছেন, সঙ্গে তাঁর ছোট সন্তানেরাও। নারীর কষ্ট ও একই সঙ্গে আগ্রহ দেখে অপরাহ্ণ উঠে দাঁড়িয়ে নারীকে তাঁর চেয়ারে বসতে দেন। কিন্তু এত ভিড় যে কবি গাদাগাদির মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও দেখার সুযোগ পাননি। ফলে অপরাহ্ণকে অতৃপ্ত মন নিয়েই অডিটরিয়াম ত‍্যাগ করতে হয়েছে। বহু দর্শককে চলে যেতে হয়েছে অডিটরিয়ামের বাইরে থেকেই!

জায়গার অভাবে ফিরে যাওয়ার আক্ষেপ, অনুষ্ঠানের থিম বৈচিত্র্যের কারণে কখনো আনন্দ, কখনো বেদনা, কখনো বজ্রকঠিন শপথের জাগরণ, কেনাকাটা, বহুদিন পর বহুজনের সঙ্গে দেখা, গল্প—এ রকম মিশ্র অনুভূতি উপহার দিয়ে উদীচী, মন্ট্রিয়ল–এর বর্ষবরণের উৎসবটি উদ্‌যাপিত হয়েছে সাড়ম্বরেই।

অনুষ্ঠান শুরুর আগে বিকেলে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয় কোট ডে নেইজ এলাকার মূল সড়ক ধরে লাভোয়া স্কুল পর্যন্ত। বাতাসের সঙ্গে কনকনে ঠান্ডার মধ‍্যেও সারিবদ্ধভাবে ব‍্যানার, ফেস্টুন হাতে করে গান গেয়ে গেয়ে এগিয়ে যান প্রচুর মানুষ। শোভাযাত্রায় শরিক হন কানাডার ফেডারেল এমপি অ‍্যান্থনি হাউসফাদার ও স্থানীয় সিটি কাউন্সিলর।

ছবি: লেখকের পাঠানো

এরপর সন্ধ‍্যায় একের পর এক মুগ্ধতা ছড়িয়ে চলতে থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শুভ দাশগুপ্তর ‘আমি সেই মেয়ে’ কবিতায় একটি নৃত‍্য হলো। অঙ্গীকারের যে দৃপ্ততা, ক্ষুব্ধতায় কোরিওগ্রাফিটি হলো অসাধারণ! পরিবেশনার অনিবার্য প্রভাব ছড়িয়ে পড়ল দর্শকদের অনেকের মধ্যেই। পাশের সারিতে বসা একজন মধ‍্যবয়স্ক নারী সশব্দে কেঁদেই উঠলেন। পাশে বসা তাঁর কিশোরী মেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে চোখ মুছতে মুছতে হল থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ পর আবার মাকে সিটে এনে বসায়। পরিবেশনার শক্তিটি এত মজবুত ছিল, মনে হয়েছে হলে বসা শুভবোধসম্পন্ন মানবিক মানুষগুলোও কেঁদেছেন। মনে মনে বজ্রমুষ্টি করে বলে উঠেছেন ‘ধূ ধূ জ্ব’লে ওঠ ধূমায়িত অগ্নি, জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নী …. , জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা ….’—(কাজী নজরুল ইসলাম)।

কানাডায় জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা প্রজন্মের দুটি পৃথক নৃত‍্য ছিল। একটি ছিল পায়েলের পরিচালনায়। তাঁরা সবাই এখন পড়াশোনার পাঠ শেষ করে কর্মজীবনে। ব‍্যস্ততার মধ্যেও মা–বাবার মাতৃভূমির সংষ্কৃতিকে ধারণ করে অনুষ্ঠানগুলোতে পারফর্ম করার চেষ্টা করেন তাঁরা। বরাবরই এ গ্রুপটির পরিবেশনা চমৎকার হয়।

নতুন প্রজন্মের অপর গ্রুপটি ছিল কিশোরীদের নিয়ে। দীঘি ও তার গ্রুপ বাংলার বর্ষার ওপর একটি দলীয় নৃত‍্য করে। তাদের পরিবেশিত নৃত‍্য পরম মুগ্ধতায় উপভোগ করেন দর্শকেরা। বলতেই হয়, তারা প্রফেশনাল নৃত‍্যের ধারাটি সুন্দর করে রপ্ত করেছে।

গ্রামবাংলার ঐতিহ্য নিয়ে নৃত‍্যশিল্পী জসিম উদ্দিনের নৃত‍্যকণা একাডেমির দলীয় পরিবেশনাটিও ছিল উঁচু মানের। নৃত‍্যের মধ‍্য দিয়ে বাংলা, বাঙালির কৃষ্টি, সংস্কৃতি দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁরা।

ছবি: লেখকের পাঠানো

অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল একটি নাটক। টরন্টোর নাট‍্য সংঘ এসেছিল ‘পৌরাণিক’ নাটক নিয়ে। ধীরাজ ভট্টাচার্যের লেখা ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ গল্পে টরন্টোপ্রবাসী সুব্রত পুরু নাট‍্যরূপদান করেন। বিয়োগান্ত প্রেমের অমর কাহিনি এটি। অনবদ‍্য পরিবেশনা ছিল কলাকুশলীদের। পিনপতন নীরবতায় নাটকটি উপভোগ করেন সবাই। অভিনয়গুণে নাটকের শেষ অংশটি আবেগাপ্লুত করেছে দর্শকদের। নাটকে মাথিনের অসমাপ্ত প্রেমের বিরহে-বিষাদ বেদনাবিধূর করেছে হলের পরিবেশ। হৃদয়ছোঁয়া অভিনয় ছিল মাথিন চরিত্রে রূপদানকারীর। অভিনয় ছিল অনবদ্য, নাটকে অংশ নেওয়া অন‍্য সবারও।

নাটক পরিচালনায় ছিলেন সুব্রত পুরু। এতে মাথিনের বাবা ওয়াংথিন ও ধীরাজের বাবা—এই দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাহমুদুল ইসলাম সেলিম। থানাগিরির ভূমিকায় ছিলেন আশরাফ রানা, মাথিনের ভূমিকায় নাহিদ আশরাফী, হরকির চরিত্রে ইসরাত দীপ্তি, ধীরাজ ও বর্ণনাকারীর ভূমিকায় শঙ্কু পুরকায়স্থ, কিউপিড ও নদের চাঁদের চরিত্রে তাপস দেব, সাইকি ও মহুয়ার চরিত্রে অনিন্দিতা বিশ্বাস। নৃত্যাংশে ছিলেন ফারজানা সোনিয়া, সুকন্যা দাশ ও সুচেতা পুরু। সংগীত ও সুর সংযোজনায় অমিতাভ দাস, আলোক পরিকল্পনায় সেলিম চৌধুরী, আবহসংগীত পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণে ছিলেন মামুন কায়সার। আলোক প্রক্ষেপণে ছিলেন আরিফ সিদ্দিকী সেতু।

ছবি: লেখকের পাঠানো

প্রখ‍্যাত সাংস্কৃতিক ব‍্যক্তিত্ব সদ‍্য প্রয়াত সানজিদা খাতুন ও সুষমা দাস স্মরণে দুটি পৃথক গান হয়। গান করেন পুনম ঘোষ, জয়ন্ত ভৌমিক জয়, সৌমিত্র কর সুমন, শেলি দেব, মিখাইল শাফায়াত, পুষ্পিতা দেব চম্পা, কেয়া ভট্টাচার্য ও রুবি তালুকদার।

মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান করেন শাফিনা করিম, মিলি ইসলাম ও শারমিন জাহান আশা।

বর্ষবরণের দলীয় গানে অংশ নেন সঞ্চিতা দেব মুনমুন, নীপা বড়ুয়া, মধুমিতা ধর, সাগরিকা কর, রীপা ধর, মোহনা চৌধুরী, লাকী চৌধুরী, সুচিতা চৌধুরী, লিপি দাস, রত্না দেব ও সঞ্চিতা মজুমদার।

সোনালী দত্ত, সুজাতা দেব, বন‍্যা দে, মিথিলা দাস, অপর্ণা দেবনাথ, মিলি ধর, সুস্মিতা ধাম, পিংকি ধর, শ্রাবণী দে ও জয়শ্রী রায় দলীয়ভাবে করেন পয়লা বৈশাখ অনুরণিত গান। ভূপেন হাজারিকার একটি জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান দ্বৈতকণ্ঠে করেন মৃণাল পিংকু ও দেবপ্রিয়া কর রুমা।

ষড়্‌ঋতুর ওপর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেন শামসাদ রানা, রাবেয়া হোসেন ও ঈসা মেহেদী।

নারী জাগরণী নৃত‍্যে শর্মিষ্ঠা দত্ত শর্মির সঙ্গে ছিলেন পাপড়ি মিত্র, চায়না সাহা, পূরবী হালদার, সুপ্তা ভৌমিক, রিমি চৌধুরী, প্রিয়াংকা দাস, ইশিতা রায় ও শিল্পী দেব।

নৃত‍্যকণা একাডেমির পরিবেশনায় অংশ নেন জসীম উদ্দিন, দেবজ্যোতি দাস, মিথিলা দাস, জান্নাতুল ইসলাম তুষ্টি, শাকিরা হোসাইন, শ্রীতপা দাস, সৃজিতা দাস, রুহি দাস ও সপ্তর্ষি দাস। লোকনৃত‍্যে পায়েলের সঙ্গে অংশ নেয় প্রথা, ঐশ্বরিয়া, ঐশী, মিমি ও মোহনা। বর্ষা ঋতুর নৃত‍্যে ছিল দীঘি, তিথি, বিথিকা, পুষ্পিতা ও অন্তরা।

অনুষ্ঠানের শুরুতে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, মন্ট্রিয়ল শাখার সদ‍্য সাবেক সভাপতি বাবলা দেব সংগঠনের নবগঠিত কমিটির সদস‍্যদের মঞ্চে পরিচয় করিয়ে দেন। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন উদীচী, মন্ট্রিয়লের সভাপতি সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। তিনি একটি প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও সাম‍্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উদীচীর অপরিসীম কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সক্রিয়ভাবে সবার ভূমিকা রাখা অপরিহার্য। সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন দর্শক ও সহযোগিতা প্রদানকারী সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

সংগঠনের উপদেষ্টা দীপক ধর অপু স্থানাভাবে বিপুলসংখ‍্যক লোককে অনুষ্ঠান না দেখেই চলে যেতে হয়েছে বলে সংগঠনের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সবার সহযোগিতা পেলে ভবিষ্যতে আরও বড় হলে অনুষ্ঠান করার আশা করে উদীচী।

স্থানীয় নিয়মিত–অনিয়মিত একঝাঁক শিল্পীর সমন্বয়ে তৈরি অনুষ্ঠানমালায় ছিল নানা বৈচিত্র্য। গানে, নাচে, কবিতায়, নাটকে, পোশাক পরিকল্পনায় ছিল কানাডায় একখণ্ড বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। পুরো অনুষ্ঠানের প্রতিটি পর্বের পরিকল্পনা, গ্রন্থণা ও সমন্বয় করেন আয়োজক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক উপস্থাপক ও কণ্ঠশিল্পী শর্মিলা ধর। মিলি ধর ও বিপাশা দাসের সঙ্গে অনুষ্ঠান উপস্থাপনায়ও ছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানের সার্বিক শব্দ সংযোজনায় ছিলেন শাওন। আলোক ও অন‍্যান‍্য কারিগরি সহায়তায় ছিলেন আরিফ সিদ্দিকী সেতু।

অডিটরিয়ামের বাইরে ছিল শাড়িকাপড়, গয়না আর খাবারের স্টল। সেখানেও ছিল ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। সবকিছু মিলিয়ে একটি সাজানো গোছানো, পরিপাটি মনোমুগ্ধকর বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ছিল উদীচীর।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo.com