দেখা হয়েছিল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে

ছবি: লেখক

ছোট–বড় সবাই ভ্রমণ করতে পছন্দ করে। ছোটবেলায় নৌকায় করে নানাবাড়িতে যখন যেতাম, সারা দিন লেগে যেত। তবু ক্লান্তি অনুভব করিনি কখনো। কারণ, নৌকাভ্রমণে নানাবাড়িতে যাওয়ার আনন্দ দূর করত সব ক্লান্তি।

বাড়ি থেকে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনলেই আনন্দে আটখানা হয়ে যেতাম। এখনো দেশ–বিদেশে ভ্রমণ করা, নতুন নতুন শহর ও প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখা ও উপভোগ করার মধ্যে রয়েছে এক মনোমুগ্ধকর অনুভূতি, যা শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করি।

আমি সেবার থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া ভ্রমণে বেরিয়েছি। বিয়ে করিনি তখন, বান্ধবী নেই বললেই চলে। বোটে করে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ঘুরে ঘুরে দেখছি। প্রতিদিনই নতুন নতুন যাত্রী নিয়ে নৌকার মাঝি এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যান। আজ মালয়েশিয়ার একটি বড় দ্বীপে যাব।

ছবি: লেখক

সেখানে থাকব এক রাত, তারপর সেখান থেকে থাইল্যান্ডের ফুকেট দ্বীপে ফিরব। বেশ দীর্ঘ সময়ের ভ্রমণ। আমার সমবয়সী এক আধুনিক অ্যারাবিয়ান মেয়ে, সেও সেদিন একই বোটে। অ্যারাবিয়ান মেয়ে একা একা, তারপর কাপড়চোপড় দেখে মনে হচ্ছে না যে সে সরাসরি আরব দেশ থেকে এসেছে। থাকে নিশ্চয়ই ইউরোপ বা আমেরিকায়!

বোট ছাড়ার কিছুক্ষণ আগেই আমার পাশে এসে বসার অনুমতি চাইল। আমি শুধু বললাম, প্লিজ। মেয়েটি শুরুতেই বেশ খোলামেলাভাবেই আলোচনা শুরু করল। ভাবলাম, তাহলে সময়টি কথা বলতে বলতে আর আন্দামানকে দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে।

এতক্ষণে জানাজানি হয়নি আমাদের পরিচয়। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমার নাম ইলাফ। আমি ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকি, তবে আমার জন্মভূমি সৌদি আরবের মদিনা শহরে। আমেরিকার ইউসিএলএ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছি, চাকরি করব নাকি বাবার দেশে ফিরে যাব? এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভাবলাম, পৃথিবীটাকে একটু ঘুরে দেখি, তাই আমার এই বিশ্বভ্রমণ।

তবে বিশ্বের সব দেশ নয়, শুধু ইউরোপসহ, এশিয়ার কিছু দেশ যেমন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং পরে অস্ট্রেলিয়া হয়ে ব্যাক ট্যু সানসেট বুলেভার্ড অথবা সৌদির মদিনা শহরে,’ বলে হাসতে লাগল।

আমি তার কথা শুনছি বটে, তবে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তখন অন্য বিষয়। যেমন মক্কা, মদিনা এসব তো মুসলিম জাতির জন্য এক পবিত্র স্থান। তারপর আরবের অবিবাহিত সুন্দরী যুবতী, বসে আছে আমার পাশে। ভাবতেই কেমন যেন গা-গতর শিউরে উঠছে।

ছবি: লেখক

ভদ্রতার খাতিরে নিজের পরিচয় কোনোমতে শেষ করে ইলাফের মদিনা শহর এবং সেখানকার সব বিষয় জানার জন্য বরং বেশি আগ্রহী হয়ে গেলাম। খুব জানতে ইচ্ছে জেগেছে তার জীবনকাহিনি। কীভাবে এবং কেন সে মদিনা ছেড়ে আমেরিকায় এবং কেনই বা একা বিশ্বভ্রমণ করছে? এসব বিষয় জানার কৌতূহল মনে তীব্র আকার ধারণ করছে।

সময়টি হবে ১৯৮৭ সাল, প্রযুক্তির যুগ নয় তখন আজকের মত। সৌদি আরব, মক্কা এবং মদিনা সম্বন্ধে যা শুনেছি মুরব্বিদের থেকে, সেটা ছাড়া অন্য কিছু জানার সুযোগ তখন ছিল না এ যুগের মতো। সুযোগ যখন এসেছে জীবনে একবার, জানতে হবে অনেক কিছু।

প্রথমে যতটা ভেবেছিলাম বোটের সময়টা কিছুটা বোরিং হবে, এখন মনে মনে ভাবছি, সময় মনে হয় দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। সবকিছু জানা যাবে না। কী জিজ্ঞেস করতে কী উল্টাপাল্টা জিজ্ঞেস করে ফেলি এবং শেষে দেখা গেল ঝামেলায় পড়লাম! দরকার নেই বাবা। আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবর নেওয়ার কী দরকার? এমন করে ভাবছি মনে মনে! এর মধ্যে ইলাফ এটা–সেটা বলছে আর আমি উত্তর দিচ্ছি। তবে আমার মন তখন নানা কথা বলছে।

ইলাফ হঠাৎ নাম ধরে বলল, ‘রহমান, কিছু যদি মনে না করো, তবে আমি কি তোমাকে আমার স্বল্প সময়ের একজন বিশ্বস্ত বন্ধু মনে করতে পারি?’

না চাইতেই বৃষ্টি!

আমি ঠিক শুনছি তো? নাকি ভিমরতিতে ধরেছে আমাকে, যেটা মনে মনে ভাবছি, সেটাই শুনছি না তো? মাথাটাকে একটু নাড়া দিয়ে ইলাফকে বললাম, আমাকে একটু চিমটি দাও তো!

সে বলল, কেন?
আমি বললাম, আমি ঠিক আছি কি না, জানতে চাই।
সে চিমটির পরিবর্তে স্প্যানিশ স্টাইলে মুখে একটু আদর করে বলল, কি, সবকিছু ঠিক আছে?

আমি একটু লজ্জা পেয়েছিলাম বটে, তবে কিছু না চাইতে পাওয়া, আগে এমনটি ঘটেনি। তাই বেশ অস্থির হয়ে পড়েছিলাম সেদিন সেইক্ষণে।

যা–ই হোক, অনেক প্রশ্ন, অনেক কথা বলতে বলতে সময় শেষ, বোট এসে লাংকাউভি আইল্যান্ডে থেমে গেল।

এবার বিদায় নেওয়ার পালা।

ও মা! বিদায় পড়ে থাক, ইলাফ নিজ থেকে বলতে শুরু করল, ‘তোমাকে পেয়ে কী যে ভালো লাগছে! আজ দুজন মনের আনন্দে ঘুরব। আমার না প্রায় এক মাস ভ্রমণের সময় পার হয়ে চলছে, কারও সঙ্গে মনের মতো করে মেশা হয়নি, এমনকি কথা বলাও হয়নি, কী যে ভালো লাগছে তোমাকে পেয়ে!’

আমি সুইডেনে একে তো গেস্ট স্টুডেন্ট, তারপর খণ্ডকালীন কাজ করে লেখাপড়ার খরচ জোগাই, ছোট ভাইবোনের কিছু সাহায্য করি। সবকিছুর পরও খুব অল্প এবং সীমিত বাজেটের মধ্যে আমার এই যাত্রা, ক্ষণিকের বান্ধবীর সঙ্গে লাংকাউভি আইল্যান্ডে কীভাবে ঘুরব?

এটা ভাবতেই নিজের মাথা ঘুরতে শুরু করেছে তখন। এমন সময় মিরাকলের মতো আকস্মিক ঘটনা ঘটতে শুরু করতে লাগল। মিরাকেলের কথা শুনেছি, জীবনে মিরাকলের সুযোগ আসেনি, তবে সেদিন এসেছিল। ইলাফ নিজ থেকেই বলতে শুরু করল, ‘রহমান, তোমাকে বোটেই বলেছি, আমি তোমার একজন ভালো বন্ধু হতে চাই, তোমাকে মনের কথা বলতে চাই, আমার গোপন কথা শোনাতে চাই।’

আমি বললাম, কেন, আমি তো না বলিনি তখন! ‘তাহলে শোনো, আমি বড়লোকের মেয়ে। তুমি ভাবতে পারো, আমি ভ্রমণে অর্থ দিয়ে সঙ্গী কিনতে চাই। আমার সম্পর্কে তোমার এমন খারাপ ধারণা হোক, সেটা আমি চাই না।

আমি বললাম, কী করতে হবে, বলো আগে শুনি!
ইলাফ বলল, ‘আমি তোমার সঙ্গে ঘুরতে চাই, তুমি যা করবে তা–ই করব, তুমি যা খাবে তা–ই খাব, তুমি যে হোটেলে থাকবে, সেখানে থাকব।’ আমি সব ঠিকঠাকমতো শুনছি। তবে হোটেলের কথা বলতেই বললাম, এক রুমে?
ইলাফ বলল, হ্যাঁ।

আমি তখন বললাম, আমি তো হোটেলই নিইনি। ভাবছি, খোলা আকাশের ওই মিটিমিটি তারার আলোতে লাংকাইভি আইল্যান্ডের বালুতে রাত কাটাব। পারবে এসব করতে?
ইলাফ বলল, ‘তাহলে আজ পরীক্ষা হয়ে যাক পারব কি না! তবে আমরা সবকিছু ফিফটি ফিফটি শেয়ার করব।’ এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে! মানে ইলাফের কথা শুনে শান্তি ও স্বস্তি পেলাম।

হঠাৎ দেখি রাস্তায় ডাব। কিনলাম দুটো। ইলাফ জীবনে ডাবের পানি পান করেনি। বললাম, পান করো, সমস্যা নেই। ডাবের পানি পান করে ও বলল, ‘জীবনে অনেক পানি পান করেছি। তবে এমন অমৃত পান করিনি এর আগে।’ শুনে বেশ ভালোই লাগল।

আমরা দুজন হাঁটছি আর নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছি। এদিকে দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে। এমন সময় ইলাফ বলে বসল, ‘রহমান, যদি কিছু মনে না করো, তাহলে আমার সঙ্গে আমার হোটেলে চলো। আমি একা একা চলাফেরা করছি, তাই আগেভাগেই হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছি। তবে কথা দিচ্ছি, আমরা চাঁদের আলোতে লাংকাউভি আইল্যান্ডের শেরাটন হোটেলের সমুদ্রসৈকতে একসঙ্গে ঠিক তোমার মনের মতো একটা পরিবেশে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দেব।’

আমি রাজি হয়ে গেলাম। একটা টুকটুক মানে রিকশায় করে শেরাটন হোটেলে এসে হাজির হলাম। ইলাফ রিসিপশনে গিয়ে বলল, ‘আমরা দুজন সাগরপাড়ে সময় কাটাব। তার জন্য প্লিজ ব্যবস্থা করো।’ হোটেল কর্তৃপক্ষ চা, কফি, ডাব এবং আমাদের বসার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করে ফেলল অল্প সময়ের মধ্যে। এতক্ষণে রাত বারোটা বেজে গেছে।

রাতে অনেক কথা হয়েছিল তবে যে কথা বলেছিল ইলাফ তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে, সেটা ছিল এ রকম—ইলাফ তার আমেরিকান বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে করে মূলত একা একা বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছে। ইলাফের পরিবার সব মেনে নিয়েছিল, শুধু মেনে নিতে পারেনি তার বয়ফ্রেন্ডকে। কারণ সে ছিল ইহুদি। আমি শুধু প্রশ্ন করেছিলাম, সমস্যা কোথায়? উত্তরে ইলাফ শুধু বলেছিল, ‘সমস্যা আমার নয়, মা–বাবার। তারা সব মানতে রাজি, শুধু বয়ফ্রেন্ড ইহুদি, এটা ছাড়া।’

আমি সুইডেনে থাকি, এখানকার বেশির ভাগই খ্রিষ্টান। আমি কখনো এদের ধর্ম এবং বর্ণ নিয়ে এ যুগে ভাবি না। ভাবি দুর্নীতি, মনুষ্যত্ববোধ আর অনীতি নিয়ে।

ইলাফ আমার মতের সঙ্গে একমত পোষণ করল। ইলাফের সঙ্গে সময় কাটানো ছিল আমার জীবনের এমন একটি ঘটনা, যা ঘটেছিল বহু বছর আগে। আমার প্রতি ইলাফের কিছুটা দুর্বলতা লক্ষ করেছিলাম। সম্পর্কের মোড় ঘুরতে পারত সেদিন বা পরেও। কিন্তু বন্ধু হতে চেয়ে কীভাবে প্রেমিক বলে গণ্য হব! কেন যেন দুটি মন একজায়গায় হলেও সে মন দুটি জুটি বাঁধার মতো হয়নি সেদিন।

তাই বিদায়বেলায় কথা দিয়েছিলাম, যোগাযোগ থাকবে। যোগাযোগ ছিল বন্ধু হিসেবেই, কারণ সব ফুল ফোটে না আবার ফুল ফুটলেও ফল হয় না। আমার জীবনের বিশাল পরিবর্তন ঘটে সে সময়। সম্পর্ক তিলে তিলে বিলীন হয় যায় সময়ের সঙ্গে। আজ এত বছর পর ইলাফের কথা মনে পড়ল!