নিছক গল্প
আমি পুলিশের সার্জেন্ট! কীভাবে যেন ঘুষ ছাড়া চাকরিটা পেয়ে যাই। বিএসসি পাস করে ফট করে সার্জেন্ট! ভাবা যায়? কিন্তু হলো। তরুণ মন, একেবারে ছাত্রজীবন থেকেই প্রতিজ্ঞা ছিল জীবনে ঘুষ খাব না। সারদা পুলিশ একাডেমিতে ট্রেনিংয়ে গিয়ে দেখি হাবিলদার সাহেবরাসহ যাঁরা ট্রেনিং করান, তাঁদের পক্ষ থেকে একজন আমাদের তখনকার বেতনের টাকা নিয়ে নিচ্ছে! আমার মতো আরও দুজন দিতে রাজি হলাম না। মগের মুল্লুক নাকি? ওমা তিন দিন পরে দেখি সব পরীক্ষায় আমরা ফেল! একজন এসে বলে গেল টাকা না দিলে জীবনেও সার্জেন্ট হওয়া হবে না, অর্থাৎ পাস করতে পারব না। অগত্যা রাজি হলাম। আমরা ঘাউরামি করেছি বলে তিনজনকে বাড়ি থেকে আরও জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা এনে দিতে বলল, না হলে পাস হব না। সিধা কথা...মনের দুঃখে...থাক! ট্রেনিং পিরিয়ডের বেতনের টাকা দিয়ে এক ঠোঙা বাদাম পর্যন্ত কিনে খেতে পারি নাই। ভাবটা এমন তাদের বেতন তারা তুলছে। অবাক হওয়া শেষ না হতেই ট্রেনিং শেষ হলো।
প্রথমেই ডিএমপিতে পোস্টিং! রোদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জীবনের ডিউটি শুরু হলো। তখনকার দিনে সিনেমাতে পুলিশ চরিত্র খুব দেখাত। খাকি পোশাক, রেবনের সানগ্লাস! পা ফাঁক করে রাস্তায় হিরোর মতো দাঁড়িয়ে থাকা সব একে একে হয়ে যাচ্ছিল। ঘুষ খাই না...অন্য সহকর্মীরা আমাকে বাহবা দেয়। আমি নাকি পুলিশ বাহিনীর গর্ব হতে পারব। কিন্তু তারা খায়। আমার সঙ্গে নীতি তর্কে জড়ায় না। এর মধ্যে একদিন কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে ডিউটি, ট্রাক একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে মেরে দিয়ে পালাচ্ছে। আমি বোঝার আগেই ট্রাক টান দিল। আমিও সরকারি বাইক নিয়ে পেছনে ছুটলাম। সিগন্যাল দিচ্ছি থামে না। টেকনিক্যাল পার হয়ে মাজার রোডের কাছাকাছি গিয়ে আমি ট্রাকের চাকায় দুটি গুলি করলাম! থেমে গেল! চালক পালাচ্ছিল, কিন্তু ধরে ফেললাম!ওয়্যারলেসের কল্যাণে অন্য পুলিশের গাড়ি এল। কিন্তু ততক্ষণে ট্রাক শ্রমিকেরা আমাদের ঘেরাও করেছে। ড্রাইভারকে ছাড়তে হবে। আমি ছাড়ব না। কী এক শক্তি ভর করেছিল আমার মধ্যে আল্লাহ জানেন, চালক মানুষ মেরে আসছে! খুব তেজি নীতিকথার একটা প্রভাব আছে আসলে। আমি তো চালককে মারছি না। পুলিশের গাড়ি ট্রাকচালককে থানায় নিয়ে গেল। আমার বস ট্রাফিক ইন্সপেক্টর(নাম মনে আছে দিলাম না) আমাকে অফিসে নিয়ে গিয়ে কোক খেতে দিলেন। পরিশ্রম করেছেন, খান। এর পরের বাক্যই তুই! এই তুই অমিতাভ বচ্চন? ফাইজলামি করার জায়গা পাস না? হিন্দি সিনেমা দেখস তাই না? আমি সত্যি কান্না করে দিয়েছিলাম। গলার কাছে কী একটা দলা পাকিয়ে উঠছিল থেকে থেকে! শরীর কাঁপছিল আমার। দেখি সানগ্লাসটা? দিলাম। দিব্যি চোখে লাগিয়ে বললেন, ওটা তাঁর আমি যেন আরেকটা কিনে নিই। আমার কান্না তাঁকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করেনি! তুই জানিস একেবারে ওপর পর্যন্ত সপ্তাহে কত টাকা দিতে হয়? তুই নিজে প্রতি সপ্তাহে দশ হাজার টাকা করে আমাকে দিয়ে যাবি। কেমনে দিবি তোর বিবেচনা! বাপের জমি থাকলে বেঁচে বেঁচে দে। হিরো সাজবি টাকা দিবি না? তোর জন্য শ্রমিকেরা হরতাল ডাকবে। সরকার বিপদে পড়বে...!
ফট করেই আবার আপনিতে চলে গেলেন! হাসতে হাসতে বললেন এ রকম হিরো আমি ২০ বছর আগে ছিলাম। এই যে ভুঁড়ি দেখেন, এটা ঘুষের ভুঁড়ি। বাজি ধরে বলতে পারি ২০ বছর পর আপনারও ভুঁড়ি থাকবে এ রকম। আমরা কেউ সিস্টেমের বাইরে না। দু–একজন যে নাই তা না, তবে তারা ঢাকা শহরে নাই। খাগড়াছড়ি বান্দরবানে আছে! ওখানে জান নিয়ে টানাটানি, ঘুষ দিব কে? যা বললাম, সপ্তাহে ১০ হাজার। আপনাকে নিজের হাতে কিছুই করতে হবে না, কাজেই গুনাহ আপনার না।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
সত্যিই ২০ বছর পর আমার ওরকম ট্রাফিক ইন্সপেক্টরের মতো ভুঁড়ি আছে! একটা ফ্ল্যাটে আমি পরিবার নিয়ে থাকি। আর দুইটা ভাড়া দেওয়া। বাচ্চা ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রী। বউ খুশি, শ্বশুরবাড়ির পরিবার খুশি! আমার পরিবারও খুশি। যে চায় তাকেই টাকা দিই। ঘুষের তো, মায়া লাগে না। গরিব যারা সাহস করে চায় তাদেরও দিই। পাপ কাটান দেওয়ার চেষ্টা করি এসব করে, জানি কাটা যায় না। আফসোস নাই। পরকালে শাস্তি সিস্টেম থাকলে নিব। অসুবিধা নাই।
শুধু মাসের দুইটা দিন ডিউটি আছে বলে বের হয়ে গলা পর্যন্ত মদ খেয়ে বুড়িগঙ্গায় নৌকা ভাড়া করে একটু দূরে গিয়ে কাঁদি! খুব শব্দ করে কাঁদি...পানি দিয়ে পানি ধুই! হায় রে পাপ, কাটা যায় না আমি জানি!
বিঃ দ্রঃ এটি নিছক গল্প। আমরা বিশ্বাস করি পুলিশ বাহিনীতে এমন কিছু ঘটে না।