গোপন চিঠি

অলংকরণ আরাফাত করিম

প্রায় পাঁচ বছর পর দেশে যাচ্ছে নাহিদ। সব ফর্মালিটি শেষ করে পিয়ারসন বিমানবন্দরে গেট নম্বর আঠাশের সামনের ডিপার্চার লাউঞ্জে এসে বসছে। বিমানের এই টরন্টো -ঢাকা সরাসরি ফ্লাইট খুব ভাল একটা উদ্যোগ হয়েছে। সময় এবং ডলার, দুটোরই সাশ্রয়। আরো ভালো লাগছে বোর্ডিংয়ের জন্য আপেক্ষায় থাকা সবাই বাংলায় কথা বলছে।

-কি খবর নাহিদ? কেমন আছো?

প্রশ্ন শুনে নাহিদ ঘুরে তাকাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী রীমা। হাতে লাল একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে নাহিদের পেছনই দাঁড়িয়ে। মাত্রই এসেছে হয়তো। কারণ বসার সময় নাহিদের মনে আছে যে পেছনের সারিটা খালি ছিল। রীমার পরনে জিন্স আর একটা আকশী রঙের কুর্তা। একটা কালো শাল গলার পাশে ফেলে রাখা। এই রীমার সাথে ১৮ বছর আগের বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা রীমার কোনো মিল নেই। এই রীমা রীতিমত সুন্দরী। ভরাট শরীর, ঝলমলে হাইলাইট করা চুল, চোখমুখে স্বাস্থ্যের আভা।

নাহিদ অবাক গলায় বললো,

-আরে রীমা যে! কি খবর? টরন্টোতে কবে এসেছো?

-এইতো দুই ঘন্টা আগে এলবারটা থেকে এসে পিয়ারসনে ল্যান্ড করেছি। তারপর বিমান বুথে চেক ইন করে আসতে যা সময় লাগল। এতো হুড়িহুড়ি গেল!

- তা যা বলেছো। কানাডার সব বাঙালীরাই বিমানেই দেশে যাচ্ছে এখন। গুড ফর আস। প্রাউড অফ বিমান।

নাহিদ দেশের অহংকারে কিছুটা অহংকারের হাসি হাসলো। তারপর আবার জিজ্ঞাসা করলো,

-একা যাচ্ছো?

-না, একা না। ইমরান আছে। ও কফি কিনতে গেছে।

কফির কথা শুনে, আর পাশেই স্টারবাক্সের একটা কফির দোকান দেখে নাহিদের মনে হলো মাথাটা জ্যাম হয়ে আছে। তারও একটা কফি দরকার। এমন সময় দুইকাপ কফি হাতে ইমরান ফিরে এল। রীমা ইমরানের দিকে তাকিয়ে বললো,

-পরিচয় করিয়ে দেই ইমরান। ও নাহিদ। আমরা ইউনিভার্সিটিতে একই ব্যাচ ছিলাম। নাহিদ ক্যামিস্ট্রিতে পড়তো। এখন টরন্টোতে থাকে।

-নাইস টু মিট ইউ। নাহিদ হ্যান্ড শেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।

যদিও ফেসবুক দেখে দেখে নাহিদ রীমার স্বামীকে চিনে গেছে এতোদিনে। রীমারা এলবারটাতে থাকে। অনেক বেড়ায় আর ফেসবুকে সুন্দর সুন্দর ছবি পোস্ট করে। ইমরান দেখতে সুদর্শন এবং খুব ভালো গান গায়। রীমা ইমরানের গানের ভিডিও পোস্ট করে অনেক। নাহিদ কখোনো রীমার ছবিতে লাইক বা কমেন্ট দেয় না। বলা যায় খুব যত্ন করেই লাইক বা কমেন্ট দেয় না। কিন্তু প্রায় প্রতিদিন একবার রীমার প্রোফাইল ঘুরে আসে। রীমা ছিল নাহিদের ইউনিভার্সিটি জীবনের গোপন ভালোবাসা। নাহিদ খুব ভদ্রতা করে বললো,

-এদিকটাতে এসে বসতে পার তোমরা। গল্প করা যাবে। বোর্ডিং-এর এখনো অনেক দেরী আছে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রীমা আর ইমরান নাহিদের মুখোমুখি সিটে বসতেই নাহিদের বুকে হাতুরীর শব্দ শুরু হলো, যেটা ইউনিভার্সিতিতে রীমাকে দেখলেই সে টের পেতো। নাহিদের মনে হলো রীমার স্বামী ইমরান বুঝে ফেলতে পারে সেই শব্দ। নাহিদ প্রাণপনে শান্ত গলায় বললো,

-রীমা, তোমরা বস। আমারও একটা কফি লাগবে। নিয়ে আসি।

বলেই নাহিদ স্টারবাক্সের দিকে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কফির লাইনে দাঁড়ালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাশ রীমা। তাকে দেখে নাহিদ ধাতস্ত হতে সময় নিচ্ছে। কোনো মানে হয় না এই বয়সে এই ইমোশনের। রীমা ইকোনমিক্স-এ পড়তো। দেখতে সুন্দরী ছিলো না, কিন্তু ছেলেরা রীমার প্রেমে পড়তো। প্রেমে পড়তো রীমার গুণের আর স্মার্টনেসের। নাহিদও রীমার জন্য উতলা ছিল। অনেক বার মনে মনে ভেবেছে, সব লজ্জা ভুলে রীমাকে বলতে হবে। কিন্তু বলা হয়নি। পরীক্ষার আগের রাতগুলোতে জেগে জেগে পড়ার সময় মাথায় শুধু রীমাই থাকতো। কিন্তু কেউ জানতো না। অথচ দূর থেকে দেখা ছাড়া রীমার সাথে কথা হয়নি কখনো। রীমাও নাহিদকে চিনতো শুধুমাত্র ব্যাচমেট হিসেবে।

প্রায় মধ্যরাতে হলের বন্ধুরা কে কার সাথে প্রেম করছে, কে কার ক্রাশ এই নিয়ে তুমুল আড্ডা হতো। নাহিদ সবসময় ছিল চুপচাপ। সেই আড্ডার অনেকেই রীমাকে পছন্দ করতো কিন্তু রীমার কাছে গিয়ে বলার মতো সাহস কারোই ছিল না। রীমার কথা আর ব্যক্তিত্ব রীমার চারিদিকে একটা বৃত্ত সৃষ্টি করে রাখতো যে রীমার কাছে যাওয়াটা বাধো বাধো লাগতো সবারই। কেউ কেউ থাকে এমন, যাদের খুব কাছে যাওয়া যায় না।

সে সময় মোবাইল ছিল না। টেক্সট করাও যেতো না। প্রেমপত্রের যুগ ছিল। নাহিদ একবার নিজের নাম গোপন করে রীমাকে চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠিতে নাহিদ তার মনের যত আকুতি জানিয়ে লিখেছিল ভালবাসার কথা। রীমাও এড়িয়ে যেতে পারেনি। উত্তর দিয়েছিল। চিঠি লেখালেখি প্রেম অনেক দিন চলেছিল। তারপর একদিন রীমা দেখা করতে চাইলো। কথা ছিল বেলা দুইটায় ক্লাস শেষে নাহিদ আসবে নিরব রেস্টুরেন্টে। নাহিদকে রীমা বলেছিল নীল শার্ট পরে আসতে। কারণ নাহিদ রীমাকে চিনলেও রীমাতো নাহিদকে কখনো দেখেনি। সেদিন শুক্রবার ক্লা শেষে রীমা গিয়েছিল কি—না, নাহিদ জানেনা কিন্তু নাহিদ যায়নি। শেষ মুহুর্তে যত লজ্জা আর সংকোচ তাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। মনে হচ্ছিল রীমা যদি নাহিদকে দেখে আর এগুতে না চায়, তখন কী হবে! যদি বলে ক্লাসমেটের সাথে সে সম্পর্কে জড়াতে চায় না, তখন কী হবে! যদি রীমা নাহিদকে দেখে পছন্দ না করে তখন কী হবে! কি অদ্ভুত টানাপোড়েন! কি অসহ্য এই ‘না হওয়া’ বা ‘হতে পারে’ প্রত্যাখান!

একটা মিডিয়াম ব্ল্যাক কফিতে একচামচ মধু মিশিয়ে কাগজের কফি মগ নিয়ে ফিরে এসে রীমাদের সাথে বসলো নাহিদ। রীমা জিজ্ঞাসা করলো

-কত দিনের জন্য যাচ্ছ দেশে?

--তিন সপ্তাহ। তোমরা?

-আমরা মাত্র দশ দিন থাকব। ছোট ভাইয়ের বিয়ে, তাই খুব অল্প সময়ের জন্য যাওয়া।

-ও আচ্ছা। নাহিদ ভাবনায় ডুবে গেল আবারও।

ফার্স্ট ইয়ার থেকে মাস্টার্স। এই চার বছরে রীমার সাথে মাত্র একবার কথা হয়েছে নাহিদের। সেদিন র‍্যাগের রেলী শেষে সবাই ক্যাফিটেরিয়াতে ছবি তুলেছিল। তখন রীমার পাশে দাড়ানো একটা গ্রুপ ছবি আছে নাহিদের। রীমা ইকোনমিক্সের বন্ধুদের সাথেই ছবি তুলছিল, কিন্তু এক সময় নাহিদ বলেই ফেলে,

-রীমা, তোমার সাথে আমার কখনো ছবি তোলা হয়নি। তারপরই সেই ক্লিক।

তখন ক্যামেরার ফিল্ম থেকে ছবি প্রিন্ট করে নিতে হতো। সবাই সব ছবি প্রিন্ট করাতো না। কে জানে রীমার কাছে সেই ছবি আছে কি-না কিন্তু নাহিদ খুব গোছানো মানুষ। ইউনিভার্সিটির সব ছবি গুছিয়ে একটা এলবাম বানিয়েছে সে। সেখানে সেই ছবিটা খুব যত্ন করে রাখা। রীমার সাথে ফেসবুকে যুক্ত হওয়ার আগে মাঝে মাঝে সেই ছবিগুলো দেখতো সে। আর এখন সে রীমাকে রীতিমত স্টক করে। প্রতিদিন একবার দেখতে হবেই রীমার পোস্ট। রীমার একটা মাত্র ছেলে, এলবারটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে-- সব জানে নাহিদ। মাস ছয়েক আগে রীমারা সুইজারল্যান্ডে বেড়াতে গেল। রীমা ফেইসবুকে অনেক ভিডিও দিয়েছে সুইজারল্যান্ডের। কি এক আকুল তৃষ্ণা নিয়ে রীমার সব খবর রাখে নাহিদ।

-কোনো কাজে যাচ্ছো নাকি এমনিতেই বেড়াতে? রীমার প্রশ্নে ফিরে এলো নাহিদ তার ভাবনার জগত থেকে।

-একটু কাজেই যাচ্ছি বলা যায়। মা মারা যাওয়ার পর মায়ের নামে থাকা বাড়িটা ডেভলাপারকে দিচ্ছি। তাই সাইন করতে হবে।

নাহিদ বাড়ির ছোট ছেলে। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির আগে থেকে সবসময় মনে হতো ভালো রেজাল্ট করে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হতে হবে। সারাদিন ডুবে থাকতো পড়া আর ল্যাব নিয়ে। যারা মানবিক বা সমাজবিজ্ঞানের শাখায় পড়তো, তারা বিকেলে আড্ডা দিত, কবিতা পড়তো, প্রেম করতো। কিন্তু নাহিদ তখন ক্লান্ত পায়ে হলে ফিরে ল্যাব রিপোর্ট লিখতো। নাহিদ জানে যদি ইউনিভার্সিটিতে কোনো মেয়েকে সে প্রেম নিবেদন করতো, সে রীমা। কিন্তু বলা হলো না কখনো। তারপর মাস্টার্স করার জন্য টরন্টো -তে চলে আসে নহিদ। তারপর প্রায় পনেরো বছর চলে গেল। মা যতদিন ছিলেন, বিয়ের জন্য চাপাচাপি করতেন। কেন যে বিয়ে করতে পারলো না নাহিদ, সেটাও মাঝে মাঝে ভাবে সে। রীমাকে কি সে আজো ভুলতে পারেনি?

‘অল প্যাসেঞ্জারস ফর ফ্লাইট নাম্বার বিজি ২০৮ আর রিকোয়েস্টেড টু লাইন আপ ফর বোর্ডিং’—মাইক্রোফোনে এনাউন্সমেন্ট ভেসে এল। নাহিদ উঠে দাঁড়ালো। কাঁধের কালো শালটা গলায় জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো রীমাও। ইমরান রীমার লাল ট্রলী ব্যাগটা হাতে নিল। তিনজন এগিয়ে গেল বোর্ডিং-এর লাইনে। রীমাকে দেখে নাহিদের কি বিষন্নতা এলো? মানুষের মনটা দেখা গেলে কি পৃথিবীটা সহজ হতো?

*দূর পরবাসে লেখা ও ছবি পাঠানোর ইমেইল [email protected]