আপনার চেয়ে আপন যেজন
বিকেল বেলায় চায়ের মগ নিয়ে বাগানে মগ নিয়ে বসলাম, অমনি একটি শালিক পাখির অতি সাবধানী আগমন, এক শালিকে দুঃখ হয়, দুই শালিকে খুশি, সেটা মনে করে মনের মধ্যে দুঃখ হলো বৈকি। হঠাৎ দেখি আর এক শালিক পাশে এসে বসল, এক জোড়া শালিক পাখি, মনটা এতক্ষণে জুড়াল। দুই শালিকে খুব খুশি, কিচিরমিচির শব্দ করে কত কথা বলে যাচ্ছে দুটি শালিক। হঠাৎ করে আরও একটি শালিক এসে জোগ দিল, তিন শালিক! অতিথি আসবে আজ... এই রে, আরও একটা শালিক এল, চার শালিকে বেশ ব্যস্ত...
খুবই সাবধানে চায়ের মগে চুমুক দিলাম কিন্তু চোখ সেদিকে আটকে আছে। ভাবছি শালিক পাখির ও সখা আছে মনের কথা বলার, অথচ কিছু মানুষ এক জীবনে কত রকমের মানুষ পায়, কিন্তু পায় না মনের মানুষ।
একসঙ্গে এক ছাদের নিচে থেকেও অনেক সময় দুজন মানুষের বাস হয় দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে। কী নিদারুণ অসুখী হয়ে তারা গোটা জীবন পার করে দিচ্ছে।
কার জন্য? অথবা কেউ কখনো খুঁজেই পায় না মনের মানুষ বা খুঁজতে জানে না বা খুঁজে খুঁজে হাল ছেড়ে দিয়ে ক্লান্ত প্রাণ এক।
কেউবা আবার কপালগুণে পায় কিন্তু ধরে রাখতে পারে না, আবার কেউ এত দেরিতে পায় যে ততদিনে হাত পা শেকলে আটকে পরে, থাকে না শেকল ভাঙার উপায়!
প্রকৃতি সবকিছুই জোড়ায় জোড়ায় দেখতে ভালোবাসে, এ যেমন গরমকালে কারও উঠানে একটি সাপ বের হলে সবাই সাবধান করে দেয় আর একটি আসবে শীঘ্রই, সাপ ও জোড়ায় জোড়ায় বেড়ায়। কখনো দেখি পাখির ঝাঁক, বুঁনো হাঁসের পাল, মাছেরাও দল বেঁধে চলে। তবে প্রাণিকূলের মধ্যে একমাত্র কিছু মানুষ একা থাকতে পছন্দ করে, কেন?
কেউ কি ভেবে দেখেছেন, কেন?
একাকি থাকা মানুষেরা নিঃসন্দেহে মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়। কিন্তু কেন তারা সঙ্গীবিহীন একা জীবন বেছে নেন?
বিশ্বাস হারিয়ে, প্রিয়জনকে হারিয়ে, স্বার্থপরতায় নিঃশেষ হয়ে, মনের মতো কাউকে না পেয়ে, হতাশা থেকে, নিদারুণ দুঃখবোধ থেকে, প্রতারিত হয়ে, নিঃসঙ্গতাকে উপভোগ করে, নির্জনতাকে ভালোবেসে, কল্পনার জগতে ডুবে গিয়ে, আর্থিক অচ্ছলতার কারণে, পরকীয়া করে, দম্ভ আর অহমিকা থেকে, ভালোবাসার অভাব থেকে, চরম অবহেলা থেকে ইত্যাদি কোনো না কোনো কারণে মানুষ নিজেকে একা করে ফেলে।
কারণ যা–ই হোক না কেনো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা কিন্তু
অপর কোনো মানুষ দ্বারাই সৃষ্ট। মানুষ একমাত্র প্রাণী যে অন্য মানুষের ক্ষতি করে, মানুষই একমাত্র প্রাণী যে সমাজের তৈরি করা বেড়াজালে নিজেকে আটকে ফেলে।
তারপর ছটফট চোটপাট সবই করতে থাকে।
হঠাৎ করে যদি কোনো কাক মরে যায়, তখন তার পাশেও কিন্তু ঝাঁকে ঝাঁকে চেনা অচেনা শত শত কাক এসে হাজির হয়। একে বলে স্বজাতির প্রতি ভালোবাসা।
এমনটা অনেক প্রাণীর বেলাতেই,
শুধু কেবল মানুষ যদি কোনো বিপদে পড়ে, তাহলে আর একজন মানুষ কিন্তু অনায়াসেই পাশ কাটিয়ে চলে যায়, যেন কিছুই হয়নি, যতক্ষণ না নিজের ঘাড়ে বিপদ এসে হাজির হয়। অনেকে তো পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় বিষবাক্য ছড়িয়ে দিয়ে যায়, যেমন ভালোই হয়েছে, হবেই তো এমন! বা যা হয় হোক, আমার কি!
আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির সেরা জীব আমরা। প্রতিনিয়ত তার উদাহরণ কীভাবে দিয়ে চলেছি...
একটুও বিবেক বা মন বলে কিছু কাজ করে না।
একটু কাক হতেও কারও ইচ্ছে করে না, যারা পৃথিবীর উচ্ছিষ্ট খেয়ে প্রকৃতিকে পরিষ্কার করে চলছে, আর আমরা মুখ দিয়ে উচ্ছিষ্ট বের করে সম্পর্ককে বিষাক্ত কলুষিত করে চলেছি।
দিন দিন মানুষ একা থেকে আরও একা হয়ে যাচ্ছে।
সম্পর্কের বাঁধন আলগা আর ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
সম্পর্ক স্থাপনে কেউ এক–পা এগোলে, পরের পরিণাম ভেবে কেউ দুই–পা পেছাচ্ছে। কেউ কাও ওপর বিশ্বাস বা আস্থা রাখতে পারছে না।
আচ্ছা, এমন কেনো হয়ে যাচ্ছে?
যে কোনো দ্বিপাক্ষিক মানব সম্পর্কে যে তিনটে অতি আবশ্যক বিষয় থাকা উচিত বলে আমি মনে করি
তা হলো:
১.ভালোবাসা/মায়া,
২.পারস্পরিক সন্মান বা শ্রদ্ধাবোধ
৩. একে অপরের প্রতি বিশ্বাস।
অতঃপর সম্পর্ককে সুন্দর রাখতে ‘সময়’ এর কোনো বিকল্প নেই, পারস্পরিক সময় না দিলে সম্পর্কে মরিচা পরতে শুরু করে। একে অন্যকে দেওয়া সুন্দর, প্রাণোচ্ছল সময় ঐ তিনটি বিষয় এর স্থিরতা ও ভিত্তিপ্রস্তর দৃঢ় শক্ত এবং মজবুত করে। যেই সম্পর্ক আপনি টিকিয়ে রাখতে চান সেই সম্পর্ককে অবশ্যই যথাযথ সময় দিতে হবে।
একটা স্থায়ী মজবুত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনটিই গুরত্বপূর্ণ, যেকোনো সম্পর্কেই একটির অনুপস্থিত থাকলে সম্পর্ক শীতল হতে থাকে, দুইটির অনুপস্থিতি সম্পর্ক নড়বড়ে হতে শুরু করে, তিনটের অনুপস্থিতি হলে সেই সম্পর্ক আসলে মরে যায়, জীবন্ত লাশ হয়ে লোক দেখানো সম্পর্ক বয়ে না বেরিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা দুই পক্ষের জন্যই মঙ্গল।
মানব সম্পর্কের উন্নয়নে মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে, কিচিরমিচির করা শালিক পাখিদের মতো। একজন আসলে আর একজন, এরপর আর একজন, এরপর আরও, এরপর দলে দলে...
সম্পর্কগুলো দিবস কেন্দ্রীক না হয়ে নিত্যদিনের হোক। সত্যিকারের ভালোবাসা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ছড়িয়ে যাক মানুষের অন্তরে, লোক দেখানো ভালোবাসা ঢাকা পড়ুক সত্যিকারের ভালোবাসার জোয়ারে।
ভালোবাসার মায়ায় বাঁধা পড়ুক মানবজীবন।
*লেখক: শায়লা জাবীন, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]