মৎস্য মারিব খাইব সুখে
প্রতিবারের মাছ শিকারের মধ্যে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার স্বাদ। কোনোটার সঙ্গেই কোনোটার মিল নেই। এবার কোথায় যাব, মাছ শিকারের অগ্রপথিক গুরুজী আখতার হোসেন ভাইকে ফোন করি। ফোনে তিনি গন্তব্যের ঠিকানা জানান। মাছ শিকারের জন্য এবার গিয়েছি বাসা থেকে পশ্চিমে ১৩৬ কিলোমিটার দূরে, প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। রাতে ঘুমানোর পূর্বেই সঙ্গে নেওয়ার সব কিছু একসঙ্গে রেখে ঘুমাতে যাই রাত ১১টায়। ভোর সাড়ে তিনটায় উঠেই মোহাম্মদ সানাউল্লাহ খান খোকন ভাইকে ফোন করি। খোকন ভাই বললেন, আপনার ভাবিও যাবে সঙ্গে। নাশতা খেয়ে কফি পানের পর নামাজ সেরে ভোর সাড়ে চারটায় রওয়ানা হই। ২০-২৫ মিনিট ড্রাইভের পর কার পুলে এসে থামি। খোকন ভাইয়ের লেক্সাস কার পুলে রেখে ভাই ও ভাবি দুজনই আমার গাড়িতে এসে বসেন। খোকন ভাইয়ের বাসা থেকে কার পুলের দূরত্ব ১০-১৫ মিনিট। এবার তিনজনের আড্ডায় দীর্ঘ পথের যাত্রা আনন্দময় হয়ে ওঠে। হাইওয়েতে সবাই আমার গাড়ি অতিক্রম করে ছুটছে ১২০-১৪০ কিলোমিটার বেগে। হ্যামিলটন ব্রিজ পার হয়ে আমরা এক্সিট নিই। ভোরের আলো ফুটে উঠলে রাতের অন্ধকার পালিয়ে বাঁচে।
লাল আভা ছড়িয়ে সুয্যিমামা শুভ সকাল বলতেই দেখি শত শত পাখি আনন্দে আকাশে ভেসে বেড়ায়। সময় ও সুযোগ দেখে আমি রাস্তার পাশেই গাড়ি থামিয়ে মামার হাসি মুখের ছবি তুলি। খোকন ভাইও গাড়ি থেকে নেমে মামার ছবি তোলেন। স্পটে পৌঁছেই দেখি মাছশিকারীদের বেশ ভিড়। ব্রিটেনের রানির জন্মদিন উপলক্ষে (ভিক্টোরিয়া ডে) ছুটির দিন হওয়াতেই সবাই এসেছে সদলবলে। আমার মাছ শিকারের গুরুজী এসেছেন সস্ত্রীক। ভাবিকে এবারই প্রথম দেখি। ভাবিও মাছ শিকারে পারঙ্গম, ভাবতেই ভালো লাগে। যদিও আমি এখনো শিক্ষানবিশ। মাছ শিকারের আনন্দের সঙ্গে আমার ছবি তোলার আনন্দ যুক্ত হয়। অন্যদের মাছ ধরা দেখে ছুটে গিয়ে সেসব নাম না জানা মাছের ছবি তুলি এবং মাছের নাম জিজ্ঞেস করি। এবারই প্রথম দেখি যে কেউ ছিপে ফাতনা ব্যবহার করছেন না। ছিপটি রেলিংয়ে বেঁধে রাখছেন সবাই। একজন ছিপ বেঁধে রাখেননি, ফলে তাঁর অন্যমনস্কতার সুযোগে মাছ ছিপ নিয়ে পগারপার! কি বিস্ময়কর ঘটনা। কারও কারও ছিপের মূল্য ৬০০ থেকে ১২০০ ডলার। ভয়ংকর অবস্থা। বেগ স্যার বলেছেন, ‘ফটোগ্রাফি করা হাতি পোষার সমতুল্য।’ নর্থ আমেরিকায় মাছ শিকারে আগ্রহী হবার পর আমার তেমনি মনে হয়! আমি ছিপ নিয়ে স্পটে যাবার পরই ওস্তাদজি বললেন, ‘আপনার জন্য তো আমি ছিপ ফেলেছি। তথাস্তু, আমার ছিপ আবার গাড়িতে রেখে আসি।’
ওস্তাদজি তো আমার ছিপে নজর রাখছেন এবং তিনি নিজেরটা ও ভাবিরটা দেখছেন। এই কারণে আমি সবার মাছ ধরা দেখি, ছবি তুলি ‘কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’। একটু পর নিজের ছিপের কাছে এসে দেখি আমার ছিপ নাই। ওস্তাদজি বললেন, ইন্সপেক্টর এসেছে। আনঅ্যাটেনডেন্ট ছিপ থাকলে সে ছিপ তুলে নিয়ে যাবে। নতুন কথা জানার পর তাকিয়ে দেখি শুরুতে যে ২০–২৫জন মাছশিকারী ছিল তার তিন ভাগের দুই ভাগই চম্পট দিয়েছেন! সবুজ রঙের পোশাক পরিহিত লোকটির বুকে ব্যাজ রয়েছে, কনজারভেশন অফিসার। তিনি উপস্থিত মাছশিকারীদের কাছে গিয়ে মাছ শিকারের অনুমতিপত্র পরীক্ষা করছেন, একই সঙ্গে ছিপ স্পর্শ করছেন এবং পানিতে ডুবিয়ে রাখা জিয়নো মাছের বাস্কেট তুলে পরখ করছেন। আমার কাছে এসে বললেন, তোমারটা? বললাম, আমি সিক্সটি সিক্স। হেসে প্রশ্ন করেন, তোমার বার্থ ডেট? জন্ম তারিখ উচ্চারণ করতেই হাসি ছুঁড়ে দিলেন। কারণ, সিনিয়র সিটিজেনদের মাছ শিকারের অনুমতিপত্র বা লাইসেন্সের প্রয়োজন নাই। তিনি আমার ফটো আইডি চাইতে পারতেন।
এরপর গুরুজির ছিপ দিয়ে মাছ শিকারে মনোযোগী হই। অগত্যা আমার ছিপে একটি মাছ আটকে গেলে মনে হলো বন্ধ্যাত্ব দূর হলো। গুরুজিকে মাছের নাম জিজ্ঞেস করলে বলেন, মনে রাখবেন ভেড়ার মাথা। এটির নাম শিপ হেড। দেড়টার দিকে গুরুজি আমাদের শিকার পর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। গত দুই বছর ধরেছিলাম সান ফিশ। সান ফিশ খেতে দারুণ মজা। একেবারে বাংলাদেশি মেনি মাছের স্বাদ। বাসায় পৌঁছে বিকালেই মাছ পরিষ্কার করে হলুদ ও লবণ মেখে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখি। সহধর্মিণী সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলে ফিশ ফ্রাই হয়ে গেলো। মাগরিবের পর গরম গরম মাছ ভাজা দিয়ে ডিনার। সে এক আনন্দময় সন্ধ্যা! পরদিন খোকন ভাই ফোনে বললেন, মাছ একেবারেই বাংলাদেশের বাইম মাছের স্বাদ। মন নীরবে শুধায়, আবার কবে যাব?
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]