কাকতালীয়
এই যে শুনছ, একটু এদিকে আসো তো...
একটু পর মিতা আবারও বলে উঠল, এই যে ডাকছিলাম তো...
ড্রয়িং রুম থেকে মাহবুব বলে উঠল, হ্যাঁ বল...
এদিকে আসতে হবে একটু...
আমি একটা জরুরি ম্যাচ দেখছি, পাঁচ মিনিট পর আসি...? তুমি আসছ না কেন এদিকে? তুমি তো জানোই আমি খেলার সময় উঠি না!
মিতা রাগে গজগজ করতে করতে মেঝেতে বসে পড়ল, আর বলে যাচ্ছে ধ্যাৎ তারিকা ছাই, এই ব্যাটাছেলের জাতের কোথায় যে সমস্যা, নিজেকে ছাড়া কিছু বোঝে না! আমি যেতে পারলে কি আর তোমাকে ডাকি? ডাকছি যেহেতু নিশ্চয়ই কোনো প্রয়োজন আছে। প্রায় ২৮ বছর হলো সংসারের, তুমি কি এখনো জানো না আমি নিজে না গিয়ে ডাকছি, তার মানে তোমার আসার দরকার!
ব্যথায় চোখে পানি চলে এসেছে মিতার, খানিকটা অভিমানেও...লোকটা এমন কেন! ছেলেমেয়েরা কেউই কাছে থাকে না, মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে, অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, ছেলেটাও অস্ট্রেলিয়ায় মাস্টার্স করতে গেছে। মাহবুব মাস ছয়েক হলো রিটায়ার করেছে, তার পর থেকে যাবতীয় সব ধরনের খেলা দেখা বেড়ে গেছে, এই খেলা আগে দেখত না, সেটাও এখন দেখে যেমন ফর্মুলা ওয়ান, সুইমিং, টেবিল টেনিস, বক্সিং পর্যন্ত! আগেও খেলাপাগল ছিল, কিন্তু এখন আরও বেশি হয়েছে। প্রথম দিকে মিতা ভেবেছিল থাক কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাক, কিন্তু এখন দেখছে এটা মাহবুবের পুরোদস্তুর নেশা হয়ে গেছে, ভয়ংকর নেশা।
আবারও গলা উঁচিয়ে মিতা বলল, তোমার পাঁচ মিনিট এখনো হয়নি?
মাহবুব উত্তর দিল আর এক মিনিট পর আসছি, কী যে হয় তোমার মাঝে মাঝে, আমারই আসতে হবে! খালি খালি খেলার মাঝে হাঙ্গামা করো...
মিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে আছে, মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখল, পা ব্যথায় টনটন করছে, বুয়াও চলে গেছে দুপুরের পর, বিকেল প্রায় চারটা বাজে এখন।
মাহবুব এসে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল,এত রক্ত কেন মেঝেতে? কী হয়েছে তোমার? বলোনি কেন আমাকে? ইশ্ এতটা পা কাটল কী করে?
মিতা বিরক্তিকর চোখে মাহবুবের দিকে তাকিয়ে আছে, এরপর বলল তোমার প্রশ্ন শেষ হয়েছে? বলার জন্যই তো অনেকক্ষণ থেকে ডাকছিলাম, খেলা শেষ না হলে তো আবার আসা যাবে না, এদিকে একটা মানুষ মরে যাক বা পঙ্গু হয়ে যাক, কী যায় আসে কার? বাড়ির বুয়া, ড্রাইভার ডাকলেও আমি দ্রুত যাই, আর আমার জন্য দুনিয়ায় কেউ নেই।
আরে, আমি কি জানি নাকি তুমি পা কেটে ফেলছ, বলতে হবে তো। এতটা পা কাটল কী করে? দেখি ওঠো তো আগে, বলে হাত এগিয়ে দিল মাহবুব, মিতাকে ওঠাল, ডাইনিংয়ের চেয়ারে নিয়ে বসাল, রান্নাঘর থেকে ডাইনিং পর্যন্ত মেঝেতে রক্ত...
সকালে বুয়া গ্লাস ধুতে গিয়ে একটা ক্লাস ভেঙে ফেলেছিল, ঠিকমতো পরিষ্কার করেনি, মনে হয় কাচের টুকরা রয়ে গিয়েছিল রান্নাঘরে, আমি তোমার আমার জন্য চা বানাতে এসেছিলাম, হুট করে পা–টা কাটল...কাচের টুকরা তো, এত ব্যথা করছে যে নড়তে পারছি না
ওহো, আচ্ছা তুমি এখানে থাকো, আমি ফার্স্ট এইড বক্সটা আনি, বেশি রক্ত পড়লে তো মনে হয় ডাক্তার ডাকতে হবে।
ডাক্তার লাগবে না, পায়ের মধ্যে কাচের টুকরাটা এখনো বিঁধে আছে, বের করে দাও, এরপর তুলা দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দুটো প্যারাসিটামল খেলেই ব্যথা কমে যাবে। এখন ব্যথা করছে ভীষণ।
মাহবুব মিতার পা ধরে ভালো করে দেখে কাচের টুকরাটা টান দিয়ে বের করল, মিতা আ আ...করে উঠল, ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেলেছে..., এরপর মিতার পুরো পা–এর পাতা ডেটল দিয়ে মুছে দিয়ে তুলার বল লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। দুটো নাপা এক গ্লাস পানি দিয়ে বলল খেয়ে নাও, তারপর চলো বিছানায় দিয়ে আসি, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ব্যথা চলে যাবে ইনশা আল্লাহ। মিতা মাহবুবের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল, তার একটু হাঁটতে কষ্টই হচ্ছে ব্যথার জন্য, শোবার ঘর পর্যন্ত আসতেই সে বেশ হাঁপিয়ে গেল। শোন, আমি আসছি, তুমি শুয়ে থাকো। বলে মিতার গায়ে একটা পাতলা কাঁথা দিয়ে গেল মাহবুব।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
মিতার হঠাৎ ২৭ বছর আগের ঘটনা মনে পড়ল, বিয়ের পরের বছর, মাহবুবের পোস্টিং তখন দিনাজপুর, মিতা অনার্স ফাইনাল দিয়েছে তখন, এরপর মাহবুবকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য সে একা দিনাজপুর গিয়ে হাজির হয়েছিল, মাহবুব তাকে দেখে এত অবাক হয়েছিল যে ওই চেহারাটা তার এখনো মনে আছে। শীতকাল ছিল কিন্তু মিতা বুঝতে পারেনি দিনাজপুরে এত ঠান্ডা হবে, ঢাকায় তেমন কোনো শীতই ছিল না। পরদিন থেকে এমন ভয়ংকর কাঁপুনি দিয়ে জ্বরে পড়ল মিতা যে বিছানা থেকে উঠতেই পারে না, বেচারা মাহবুবের অফিস থেকে ছুটি পর্যন্ত নিতে হয়েছিল, কোথাও বেড়ানো দূরে থাক বাসায় সে বউয়ের সেবা–শুশ্রূষা করতেই কয়েক দিন চলে গেল মাহবুবের। মিতা ঘুমের ঘোরে ভুল বকত জ্বর কমে না, উল্টো সর্দি–কাশি বাঁধিয়ে বসলো, মাহবুব একটুও রাগ করেনি তখন, কয়েক মাস পর নতুন বউয়ের সাথে দেখা, কোনো আদর–সোহাগ পর্যন্ত করতে পারেনি, অবস্থা এত খারাপ হলো যে মিতার বাবা এল ঢাকা থেকে তাকে নিতে। মাহবুবের নতুন চাকরির পর বেশ কয় দিন ছুটি নেওয়ায় আর তার ছুটিও ছিল না, চলে আসার সময় মিতা মাহবুবকে বলে এল শুধু শুধু এসে তোমাকে জ্বালিয়ে গেলাম, ঠিকমমতো খাওয়াদাওয়া কোরো, ছুটি পেলে ঢাকায় এসো। মাহবুব হেসে বলল, সারা জীবন রয়ে গেছে যন্ত্রণা শোধ দেওয়ার জন্য, তুমি আগে সুস্থ হও। তবে আমি জানি আমি অসুস্থ হলে তুমি এর থেকেও বেশি করতে। এরপর সারা জীবন মাহবুব আসলেই যথেষ্ট জ্বালিয়েছে, খুবই খামখেয়ালিতে ভরা চমৎকার একটা মানুষ। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিলে কম হয়ে যায়, এমন একটা মানুষকে তার জন্য জীবনসঙ্গী হিসেবে মনোনীত করার জন্য, মাহবুবের অনেক বায়না, যন্ত্রণা, আবদার ছিল জীবনভর কিন্তু ভালোবাসার কমতি ছিল না কখনো, এ জন্যই হয়তো যখন–তখন বন্ধুবান্ধব, এটা সেটা রান্নার আবদার, বিনা নোটিশে এখানে সেখানে ঘুরতে যাওয়া, আত্মীয়দের কূটচাল ইত্যাদি সব হজম করতে পেরেছে। শুধু তা–ই নয়, জীবনে সবকিছুতেই সে মাহবুবের ওপর নির্ভরশীলও হয়ে পড়েছে, মাহবুবকে না বলে সে কাজ করতে পারে না, কিছুতেই শান্তি পায় না, যেখানে ঘটুক মাহবুবকে তার বলতেই হবে। মাহবুবও অবশ্য তাই, অফিসে বাইরে যা–ই ঘটুক, সে বাড়িতে এসে রাতের খাবারের পর চা খেতে খেতে কুটকুট করে গল্প করত সেগুলো মিতার সাথে। এখন বয়স হয়ে যাচ্ছে, ভয় হয় কখন ডাক আসে...কার যে আগে আসে! ইশ্ আল্লাহ যদি দুজনকে একসাথে তুলে নিত, মাহবুব ছাড়া সে চলতে পারবে না, মিতা জানে মাহবুবও না, মুখে যা–ই বলুক।
এই নাও তোমার চা, মেঝেটা একবারে পরিষ্কার করে তারপর চা বানালাম, এ জন্য একটু দেরি হলো, তোমার ব্যথা কমেছে?
মিতা বিছানায় শোয়া থেকে আধশোয়া হয়ে উঠে বসল, মাহবুব মিতার পেছনে একটা বালিশ দিয়ে দিল, বলল হেলান দিয়ে বসো, এরপর বিছানার পায়ের কাছে গিয়ে বসল।
এত দূরে গিয়ে বসলে যে, আমার পাশে বসো...
তোমার চেহারা পর্যবেক্ষণ করার জন্য দূরে এসে বসলাম, যেন বুঝতে পারি তোমার ব্যথা কতখানি...ডাক্তার ডাকব কি না।
ওহ, কিন্তু আমার তো তোমার কাঁধে মাথা রেখে বসতে ইচ্ছা করছে, ব্যথা এখনো আছে...তবে কমে যাবে।
কিছু খাবে? তো বলো এনে দিই, খেয়ে একবারে ঘুমিয়ে যাও। ঘুমালে ব্যথা কমে
না, না কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না, চা–টা মজা হয়েছে, তুমি এত ভালো চা বানাও, এটা জানতে আমার ২৮ বছর লাগল।
তুমি তো কিছু করতে দাও না আমাকে, আর চা বানানো তো তোমার চা বানানো দেখেই শিখেছি, আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া যে সে আমাকে এত ভালো একটা বউ জীবনসঙ্গী হিসেবে দিয়েছিল। কত মানুষের কত কিছু শুনি, তোমার ওপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে একটা জীবন আমি কি নির্বিঘ্নেই কাটিয়ে দিলাম, এমনকি এই অবসর জীবনেও খেলাধুলা নিয়ে কাটছে, তোমারও তো অবসরের সময়, কিন্তু এখনো তুমি সংসার সামলে যাচ্ছ, ছেলেমেয়েদের বড় করতে গিয়ে চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছ, ওদের পেছনে আমার খরচ বাঁচাতে গিয়ে টিচার না দিয়ে নিজে পড়িয়েছ, প্রতিবছরই ওরা খুবই ভালো রেজাল্ট করেছে, আমি তোমাকে সংসারে ১০০% খাটিয়েছি, অথচ তোমাকে কোনো দিন কোনো বেতন দিইনি এ জন্য।
ইশ্, কী বলছ এসব! ওরা কি আমার বাচ্চা না? তুমি কি আমার না? এই সংসার আমার সংসার না?
মাহবুব উঠে মিতার কাছে এসে বসল, মিতার মাথা কাঁধে রেখে বলল, না মিতা, আমি ছাড়া কিছুই তোমার একার না, বাকি সব আমাদের, বাচ্চারা আমাদের, সংসার আমাদের, শুধু আমি তোমার। আল্লাহর কাছে চাই যখন ওপারের ডাক আসবে, তখন যেন আমার সাথে তোমাকেও ডাকে, তোমাকে ছাড়া আমি কোনো পারেই থাকতে পারব না, যদিও খুবই স্বার্থপরের মতো আবদার, যাবে আমার সঙ্গে একসাথে পরপারে?
মিতা মাথা ঘুরিয়ে মাহবুবের দিকে তাকাল, চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, কিছু বলতে পারল না। মাহবুবের পাঁচ আঙুলের ভেতরে নিজের পাঁচ আঙুল রেখে মাথা নাড়ল শুধু।
মাহবুব মৃদু হেসে মিতার কপালে চুমু দিল।
‘খুব বেশি কিছু চাইনে
শুধু আমার সমান বাঁচো,
কমবেশি নয় কিছুতেই
শুধু এভাবেই ভালোবেসো।’