হালের হিরো আলম আর বেহাল সমাজব্যবস্থা
আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমকে নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মহলে বা মিডিয়ায় নানা আলোচনা ও সমালোচনা শুনে আসছি। তাঁকে ঘিরে যেসব বাক্য প্রয়োগ করা হয়, তাতে সহজেই অনুমেয়, লোকটি বাংলাদেশে একটি বিতর্কিত চরিত্র। সত্যি বলতে কি, কখনো তাঁর ধারণকৃত ভিডিও দেখার ইচ্ছা হয়নি।
বছরখানেক আগে পরিচিত এক ভাবি মজা করে একটা ভিডিও শেয়ার করেছিলেন, সেই সুবাদে আমার হিরো আলমের কার্যকলাপ খানিকটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। ভিডিওটি ছিল টাইটানিক ছবির সেলিন ডিওনের গাওয়া ‘মাই হার্ট উইল গো অন’ গানটি, যাতে হিরো আলম নিজে গান গেয়ে মিউজিক ভিডিও বানিয়েছিলেন।
ভিডিওটি দেখে প্রথমেই লক্ষণীয় বিষয়টি ছিল, হিরো আলমের সাহস! তাঁর সাহসের তারিফ করতেই হয়। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’—এ ব্যাপারে তিনি একেবারেই উদাসীন, নির্বিকার বা নির্লিপ্ত। এটাই তাঁর সব কাজের মূলমন্ত্র।
আজ অবধি তিনি কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে নিজের খেয়ালখুশিমতো একের পর এক কাজ করে যাচ্ছেন এবং নিজ সাধ্যমতো বিভিন্ন মাধ্যমে বা ক্ষেত্রে বিরামহীনভাবে ঘোরাফেরা করছেন। চানাচুর বিক্রেতা, ডিশ ব্যবসায়ী থেকে তিনি আজ নায়ক, গায়ক, আবৃত্তিকার, লেখক, প্রযোজক, পরিচালক আর বর্তমানে রাজনীতির অঙ্গনে তাঁর জোরালো পদক্ষেপ। এ কাজগুলো আমাদের সমাজে কতজন লোক করতে পারেন?
পুঁথিগত বিদ্যা ও সুশিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই আজ তাঁর বিচরণ, যা প্রশংসার দাবিদার। সবটুকুই তাঁর নিজ চেষ্টায় বা গুণে। বগুড়ার উপনির্বাচনে দুটি আসনের প্রার্থী হয়ে সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছেন। মাত্র ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন। হিরো আলম সমাজে কতটুকু স্থান করে নিয়েছেন, এই নির্বাচনই তাঁর প্রমাণ। দারিদ্র্যের কশাঘাতে যাঁর বেড়ে ওঠা, তিনি সমাজের বঞ্চিত মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ হবেন এবং কল্যাণ বয়ে আনবেন বলেই আমার বিশ্বাস। তাঁকে নিয়ে যখন চারদিকে এত আলোচনা-সমালোচনার ঝড়, তখন ধরে নিতেই হবে, তাঁর মধ্যে বিশেষ কোনো গুণ রয়েছে, যার ফল এই জনপ্রিয়তা।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে হিরো আলমকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছিল পুলিশের পোশাক পরিধান, রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীত বিকৃত করে গাইবার অপরাধে। পরবর্তীকালে অবশ্য মুচলেকা দিয়ে ছাড় পেয়েছেন। কথা হলো, হিরো আলমের মতো লোকদের আমরা সহজেই ধরতে, বলতে ও কিছু একটা করে দেখাতে পারি। আর সমাজে যাঁরা রাঘববোয়াল বা মুখোশপরা গণ্যমান্য ব্যক্তি, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আওয়াজ তুলি না।
হিরো আলম দেশের সংস্কৃতি উচ্ছন্নে নিয়ে যাচ্ছেন—যখন এমন অভিযোগ করা হয়, তখন নোরা ফাতেহির মতো ভিনদেশি নর্তকীসম কোনো নায়িকাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে, তখন কি আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি উচ্ছন্নে যায় না? তখন বাংলা সংস্কৃতির রক্ষক যাঁরা, নিশ্চুপই থাকেন কেন?
হিরো আলম বা অন্য যেকোনো ব্যক্তিই হোক না কেন, মানুষকে প্রথম মানুষ বলে বিবেচনায় আনতে হবে এবং তাঁর সেই প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে হবে। আমরা আরেকটি খুব বড় ভুল করে থাকি তা হলো, কাউকে ঠিকমতো না জেনে বা বুঝে বিচার করে ফেলি। এটি একটি ভয়ানক বোকামি। এ নিয়ে ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে—‘Don’t judge a book by its cover’।
কার মধ্যে কী গুণ লুকিয়ে আছে বা কে কী অবস্থায় আছে, তা আমরা কেউ বাইরে থেকে ঠাওর করার ক্ষমতা রাখি না। এ বিষয়ে আমার নিজের একটি ছোট অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই, যে শিক্ষা আজও মেনে চলার চেষ্টা করি, তা হলো কাউকে হুট করে বিচার করতে নেই।
হিরো আলমের অবয়ব নিয়েও নানা রসিকতা চালু আছে। সৃষ্টির ওপরে আমাদের সরাসরি কোনো হাত নেই, সৃষ্টিকর্তা যাকে যেমন বানিয়েছেন, আমরা তাই মানি। সুন্দর-অসুন্দর একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। আবার কোনো কোনো সময় সেটা নির্ভর করে সুযোগ, সুবিধা ও পরিস্থিতির ওপর। আমাদের মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হোক। মানুষকে ছোট করে দেখার শিক্ষা থেকে বিরত থাকি। হিরো আলমের শুরুটা যেমন করেই হোক না কেন, পরবর্তী সময়টা গঠনমূলক হবে, সেই প্রত্যাশা রাখি। মনে হচ্ছে, তিনি সেই পথেই হাঁটছেন।