জীবন বদলে দেওয়া শিক্ষক

শোলকুপো ‘আঞ্চলিক’ কতা কওয়া গোষ্টির সদস্যরা
ছবি: সংগৃহীত

চরভবানীপুর। নামটার মধ্যেই এলাকার একটা পরিচয় পাওয়া যায়। প্রমত্ত পদ্মা নদী কুষ্টিয়া ও পাবনাকে আলাদা করে পশ্চিম থেকে পুবে বয়ে চলেছে। যাওয়ার পথে যখন গতি পরিবর্তন করে, তখন এক পাড় ভাঙে আর অন্য পাড়ে চর জেগে ওঠে। ঠিক এমনই অনেক চরের সমাহারে এ পলি বিধৌত এলাকাগুলো গঠিত। পাশেই আছে চর রঘুনাথপুর, চর ঘোষপুরের মতো আরও কিছু চর। সরকারি মৌজা অনুযায়ী, এসব এলাকা কুষ্টিয়া সদরের অন্তর্গত হলেও এগুলো পদ্মা নদীর অপর পাড়ে পাবনার দিকে অবস্থিত। দৈনন্দিন সব কাজের কেন্দ্রবিন্দু পাবনা হলেও প্রশাসনিক সব কাজকর্ম এখনো কুষ্টিয়া থেকেই পরিচালিত হয়।

কুষ্টিয়া সদর থানার হাটশহরিপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত এ চরভবানীপুর গ্রাম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে তখন এখানে মাত্র একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল যার নাম ‘চরভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়’। সেখানে মাত্র তিনজন শিক্ষক মোট পাঁচটি ক্লাসের পাঠ পরিচালনা করেন। চরভবানীপুরেরই আফসার উদ্দিন ও নজরুল ইসলাম স্থায়ী শিক্ষক হিসেবে আছেন। এর বাইরে কুষ্টিয়া থেকে বিভিন্ন শিক্ষক প্রেরণ করা হলেও কেউই বেশি দিন থাকেন না। কারণ, কুষ্টিয়া শহর থেকে গড়াই নদী নৌকায় পার হতে হয়। এরপর হরিপুরের দীর্ঘ রাস্তায় রিকশাভ্যানই তখন পর্যন্ত একমাত্র বাহন, কিন্তু ভাড়া বাঁচাতে সবাই হেঁটেই পার হয়ে যান।

হরিপুর পার হয়ে পথে পড়ে প্রমত্ত পদ্মা। বর্ষার মৌসুমে পদ্মার ঢেউয়ের গর্জন দূরদূরান্ত থেকে শোনা যায়। স্থানীয় লোকজন বলেন, ‘তখন পদ্মা বলতে থাকে, আমি এখন বেসামাল, তোমরা সাবধান হও।’ এ সময় খেয়া পারাপার কমে যায়। নিতান্ত দরকার না হলে কেউই নদী পার হন না। আর অন্যান্য সময়ে পদ্মার বুকজুড়ে থাকে ধু ধু বালুর চর। তখন পদ্মা নদী পাড়ি দেওয়া কষ্টের ব্যাপার। বালুর মধ্যে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর থাকে না। এমনকি তখন সাইকেলে নিয়ে গেলেও সাইকেল ঠেলার বাড়তি ভোগান্তি সহ্য করতে হয়।

চরের মানুষ হেঁটেই পার হয়ে যান। এসব মানুষের মধ্যে তখনো পাদুকা ব্যবহারের চল সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বেশির ভাগ মানুষই হাট থেকে গাড়ির টায়ারের তৈরি একধরনের রাবারের স্যান্ডেল কিনে পরেন। কারণ, সহজে ছিঁড়ে না। আর একটু সচ্ছল ব্যক্তিরা প্লাস্টিকের ফিতাওয়ালা স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরেন। কিন্তু চর পার হওয়ার সময় স্যান্ডেল খুলে বগলে নিয়ে হাঁটতে হয়। কারণ, তা না হলে হেঁটে এগোনো যায় না। বালুতে সামনের পা দিয়ে পেছনের পা এগিয়ে আনতে আনতে সামনের পা কিছুটা পিছিয়ে যায়। এভাবে হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে আসে। পায়ে স্যান্ডেল থাকলে হাঁটতে তাই অসুবিধা হয়। আর পা ফেলতে একটু এদিক-ওদিক হলেই স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম।

রোদের দিনে বালুর মধ্যে এভাবে হাঁটতে গেলে বালুর গরমে পায়ের পাতা পুড়ে কালো হয়ে যায়। বড়রা এ পুড়ে যাওয়া সহ্য করতে পারলেও ছোটদের ভীষণ কষ্ট হয়। তাই ছোটরা সাধারণত মায়ের কোলে বা বাবার কাঁধে চড়ে এ বালুর পথ পার হয়। বালুর ফাঁকে ফাঁকে একটু শক্ত মাটির জায়গা পেলে তখন মা-বাবারা বাচ্চাদের একটু নামিয়ে বিশ্রাম নিয়ে নেন।

চরভবানীপুর স্কুলের একসময়ের ছাত্র বাবলু
ছবি: সংগৃহীত

কেউই বিলাসিতা করে ছাতা ব্যবহার করেন না। কারণ, তাতে একটা হাত জোড়া হয়ে যায়। আর চরে হঠাৎ হঠাৎ দমকা হাওয়ায় বয়, যেটা ছাতাকে উড়িয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। হরিপুরের সীমান্তে পদ্মার পাড়েই আছে জোড়া বটগাছ। চর পার হয়ে এসে সবাই সেই বটগাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয় আর আশপাশের বাড়ি থেকে পানি চেয়ে নিয়ে খেয়ে তৃষ্ণা মেটায়।

চরভবানীপুরে তখনো বিদ্যুতের ছোঁয়া লাগেনি। সন্ধ্যা হলেই ঘরে ঘরে কুপি আর হারিকেন জ্বলে ওঠে। অমাবস্যার দিনগুলোতে রাতের বেলা তেমন খেলাধুলা না হলেও চাঁদ রাতগুলোতে পাড়ার মোড়ে আড্ডা ও খেলাধুলা জমে ওঠে। এখানকার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে তেমন একটা উদ্বিগ্ন মনে হয় না অভিভাবকদের। কারণ, গ্রামে আছে মাত্র একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে আছে একটা চারচালা টিনশেডের ঘর, যার বেড়াও টিনের তৈরি।

সেই ঘরে ক্লাস হয় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির। মাঝে একটা টিনের বেড়া দেওয়া। নিচে বালুর মেঝে। দরজা-জানালার জায়গায় ফ্রেমগুলো আছে, কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে পাল্লাগুলো লাগানো হয়নি। পড়া না পারলে বা দুষ্টুমি করলে স্যাররা যখনই ছাত্রছাত্রীদের তাড়া দেন, তারা বইগুলো হাতে নিয়ে জানালার ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। সেদিনের মতো আর ক্লাসে ফিরে আসে না।

চরভবানীপুর স্কুলের বর্তমান ভবন
ছবি: লেখক

দ্বিতীয় ভবনটা একটা লম্বা দোচালা টিনশেডের ঘর, কিন্তু ইটের দেয়াল দেওয়া। সেখানে মাঝে তিনটা কাঠের দেয়াল দিয়ে চারটা কক্ষে ভাগ করা। এক কোনার ছোট কক্ষটি অফিসকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অন্য তিনটিতে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হয়। সর্বমোট তিনজন শিক্ষক আর পাঁচটা ক্লাস। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস আগেই শেষ হয়ে যায়। তাই শিক্ষকেরা তিনজন ভাগাভাগি করে তিন ক্লাসের দায়িত্ব নিতে পারেন।

এভাবে কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে পাঠ্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হয়। প্রতিবছর কুষ্টিয়া থেকে একজন করে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পেয়ে আসেন আর কিছুদিন থেকেই অন্য কোথাও বদলি নিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। এই প্রান্তিক চরের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই। চাষার ছেলেমেয়েরা চাষাই হবে, এটাই যেন অমোঘ নিয়তি।
এমনই একবার প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে একজন স্যার এলেন। তাঁর গায়ের রং গ্রামের লোকের ভাষায় যেন দুধে-আলতা।

কারণ, তখন পর্যন্ত গ্রামের মানুষের কেউই এমন ফরসা মানুষ দেখেনি। জন্মের সময় চরের কেউ কেউ এমন ফরসা থাকলেও বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে মোটামুটি তামাটে একটা রূপ পায়। সেই নতুন স্যার আবার হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তখন পর্যন্ত চরের মানুষের মধ্যে একমাত্র হিন্দুধর্মের লোক। নাম রতন কুমার বাগচী। স্বাস্থ্যও একটু ভালো। গ্রামের স্কুলে পড়াতে এসে তিনি গ্রামেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ, তাঁর নিজের বাড়ি শৈলকূপাতে। যেটা ঝিনাইদহ জেলায় অবস্থিত।

চরভবানীপুর স্কুলের লেখকের সহপাঠী কামাল ও গণি
ছবি: সংগৃহীত

গ্রামের একটা বাড়িতে একটা ঘরভাড়া নিয়ে তিনি থাকা শুরু করলেন। তখন পর্যন্ত মানুষটা কুমার ছিলেন, তাই হয়তো খুব বেশি ঘরের টান অনুভব করেননি। অথবা চরের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসায় আটকা পড়ে গেলেন। গ্রামের পাঠশালাতে তখন পর্যন্ত বই বলতে বোর্ডের বইগুলোই ছিল সম্বল। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মাত্র একটা বই। এর মধ্যেই বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্কের প্রাথমিক পাঠ। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছয়টা বই। বাংলা বইয়ের নাম—আমার বই। ইংরেজি বইয়ের নাম—ইংলিশ ফর টুডে। অঙ্ক বইয়ের নাম ছিল—গণিত। সঙ্গে ছিল পরিবেশ পরিচিতি সমাজ আর বিজ্ঞান। ধর্ম বইয়ের নাম ছিল—ইসলাম ধর্ম শিক্ষা।

বোর্ডের নির্ধারিত বইয়ের বাইরে যে পৃথিবীতে আর কোনো বই থাকতে পারে, এমন ধারণাই চরভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ছিল না। বাংলা ব্যাকরণ, ইংরেজি গ্রামারের নাম তখনো তারা শোনেনি। স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ বা ভাওয়াল কনসোনেন্টের সামান্যতম ধারণাও তাদের ছিল না। ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের নামের ইংরেজি বানান পর্যন্ত জানত না। এমন একটা পরিবেশের যোগ দিলেন শিক্ষক রতন কুমার বাগচী। এর পর থেকে অবস্থা বদলে যেতে শুরু করল। প্রত্যেক ছাত্র তাদের নামের ইংরেজি বানান শিখে গেল বাগচী স্যারের কাছ থেকে।

রতন বাগচী স্যার
ছবি: লেখক

পাঠ্যবইয়ের বাইরে যে গল্পের বই বলেও কিছু আছে, পৃথিবীর বুকে সেটাও তারা জানতে পারল বাগচী স্যারের কল্যাণে। স্যার শহরে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিয়ে এলেন এক গাদা গল্পের বই। কী চমৎকার বাহারি রঙের সেই বইগুলো। বইয়ের ভেতরে চমকপ্রদ সব গল্প। চরভবানীপুরের ছাত্রছাত্রীরা ছোটবেলা থেকে দাদা-দাদি, নানা-নানি, আত্মীয়স্বজনের কাছে কেচ্ছা, শ্লোক (ধাঁধা) শুনে শুনে বড় হয়েছে। তারা দেখল গল্পের বইয়েও ঠিক তেমনি সব গল্প আছে। আবার গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আঁকা আছে রঙিন ছবি। আবার কোনো কোনো বইয়ের চরিত্রের পাশে বক্তব্য লেখা। কী তাজ্জব ব্যাপার! দেখে মনে হয়, এসব চরিত্র যেন এখনই বইয়ের পাতা ফুঁড়ে বের হয়ে এসে চলাফেরা শুরু করবে।

তখনকার দিনে পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষা নিজেদের স্কুলেই হতো। হঠাৎ এক বছর নিয়ম হলো, সেবার থেকে বোর্ড পরীক্ষা হবে। সবাইকে ইউনিয়নের ঠিক করে দেওয়া কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। সব ছাত্রছাত্রী দল বেঁধে হাটশহরিপুর রওনা হয়ে গেল। সেই প্রথম তাঁদের নিজেদের গ্রামের বাইরে যাওয়া। একধরনের উত্তেজনায় তাদের মন ছেয়ে গেল। কিন্তু যখন শহরের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাদের কথা হলো তারা বুঝতে পারল তারা অনেক পিছিয়ে আছে, বিশেষ করে বাংলা ও ইংরেজিতে। কারণ, বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামারের তারা কিছুই জানে না। গ্রামে তাদের মা-বাবা তাদের স্কুলে আসতে দেয়। কারণ, প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক আর বই তো সরকার থেকেই দেয়। এর বাইরে আলাদাভাবে বই কিনতে হলে আর ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতেই চাইবে না। যাহোক, পরীক্ষার হলে এ বিষয়গুলোর উত্তর বাগচী স্যার সময়ে সময়ে এসে বলে দিয়ে যাচ্ছিলেন।

এমন পরিস্থিতিতেই একটা ব্যাচ পাস করে বেরিয়ে গেল স্কুল থেকে। আমি নিজে সেই ব্যাচের একজন অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ছাত্র, যে বাগচী স্যারের অকৃত্রিম স্নেহ পেয়েছিলাম। আমার নামের ইংরেজি বানানও স্যারের ঠিক করে দেওয়া। ইয়াকুবের ইংরেজি বানান যেখানে সবাই ওয়াইএকেইউবি লিখে স্যার বললেন, তোমার নামের বানান হবে ওয়াইএকিউইউবি। এখন পর্যন্ত আমার নামের এই বানান অক্ষয় হয়ে আছে। পরে জগতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)—সবখানেই এ বানান ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের পাসপোর্ট, এমনকি এখনকার অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টেও বাগচী স্যারের এ বানান অক্ষত আছে। তাই বাগচী স্যার জড়িয়ে আছেন আমার জীবনের প্রতিটি পাতায়। স্যারই আমাদের জীবন বদলে দেওয়ার প্রথম কারিগর।

সেই ১৯৯০ সালে চরভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়ে জীবনের প্রবহময়তায় এখন আমি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে স্থায়ীভাবে বাস করছি। কিন্তু মনে মনে খুঁজে ফিরছিলাম বাগচী স্যারকে। আমার শুধু স্যারের নাম জানা ছিল আর স্যারের বাড়ি যে শৈলকূপাতে, সেটা জানা ছিল। হঠাৎ একদিন চোখে পড়ে ‘শোলকুপো আঞ্চলিক কতা কওয়া গুষ্টি’ গ্রুপটা। সঙ্গে সঙ্গে সেটাতে যোগ দিয়ে স্যারের নাম দিয়ে স্যারকে খোঁজ করছি, এই মর্মে একটা পোস্ট দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেক উত্তর পেলাম কমেন্টে। একজন স্যারের ভাইয়ের নম্বর দিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে কল দিয়ে বাগচী স্যারের নম্বরটা নিলাম। এরপর স্যারের নম্বরে ডায়াল করে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছিলাম যে তিনি কি আসলেই আমাদের বাগচী স্যার কি না? কারণ, একই নামের অনেক ব্যক্তিই থাকতে পারেন।

বাগচী স্যারের একটা হ্যালো শুনেই আমার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। সেই ভরাট কণ্ঠস্বর আবারও শুনলাম দীর্ঘ ৩২ বছর পর। স্যারের হয়তোবা বয়স হয়েছে, কিন্তু স্যারের কণ্ঠের বয়স আর বাড়েনি আমার কানে। এরপর সবিস্তারে স্যারকে আমার পরিচয় দিলাম। স্যার হয়তোবা পুরোপুরি চিনলেন না এবং সেটাই স্বাভাবিক। স্যার এরপর কত শত স্কুলে কত হাজার হাজার ছাত্র পড়িয়েছেন। স্যারকে অনেক লজ্জা নিয়ে বললাম, আমার তিনটা বই বেরিয়েছে আপনি ঠিকানা দিলে আমি পাঠানোর ব্যবস্থা নিতাম। এরপর স্যারের সঙ্গে বই পাওয়ার পর আবারও কথা হলো। স্যার বললেন, একজন সহকর্মী অসুস্থ, তাঁকে নিয়ে ঢাকায় দৌড়াদৌড়ি করছেন। পড়ার সময় পাননি। এরপর আবার যখন কথা হলো স্যারের কণ্ঠে একই সঙ্গে বিস্ময় ও খুশির প্রকাশ ছিল স্পষ্ট। স্যার বললেন, ইয়াকুব, তোমার বই পড়ে আমি যেন আমাদেরও ছোটবেলায় ফিরে গেলাম বাপু। আমাদের শৈশবও তো তোমাদের মতোই অকৃত্রিম ছিল। এর পর থেকে স্যারের সঙ্গে নিয়মিত বিরতিতে আলাপ হয়।

ফেসবুকে দেখলাম আজকে শিক্ষক দিবস। তখন সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো আজকে অবশ্যই আমার বাগচী স্যারের সঙ্গে আলাপ করা উচিত। অফিস বাদ দিয়ে স্যারকে ফোন দিলাম। কারণ, নেটওয়ার্ক বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, স্যারর সঙ্গে সব সময়ই কথা বলা হয়ে ওঠে না। আজকে ফোন দিতেই স্যার ধরলেন। এরপর অনেক কথা হলো। অবশ্য মধ্যে দুবার কল ড্রপ করেছিল। স্যারকে বললাম, গত বছর দেশে গিয়ে আমাদের বন্ধু শেখের বাড়ির গণি আর কামালের সঙ্গে এবং বড় ভাই বাবলু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

শুনে স্যার খুবই খুশি হলেন। তারপর বললাম, অবশ্য আমাদের ব্যাচের ফার্স্ট বয় ইশারতের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি, পরের বার অবশ্যই চেষ্টা করব। স্যার এরপর বইয়ের প্রসঙ্গ আনলেন এবং বললেন, ইয়াকুব আমাকে একটা ব্যাপার খুবই ভাবাচ্ছে জানো। তোমার লেখা পড়ে যেটুকু বুঝলাম তুমি বাংলাদেশকে অন্তরে ধারণ করো, কিন্তু তুমি আবার বিদেশে থাকো। আমি বললাম, এটাই হয়তোবা নিয়তি, স্যার। এরপর বললেন, তোমার বইয়ে বেশ কিছু বিলুপ্তপ্রায় শব্দ আছে, যেগুলো এখন আর ভদ্রলোকেরা ব্যবহার করেন না, যেমন: বায়োরদাড়, কাবারি, কাইজা, ওম, সাঁজাল, মিনসে ইত্যাদি।

আর কি চমৎকারভাবেই না তুমি তার প্রয়োগ করেছ তোমার লেখায়। তোমার লেখার মাধ্যমে এই শব্দগুলো বেঁচে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস। আমি লজ্জায় শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ বলে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম। এরপর স্যার বললেন, ইয়াকুব তুমি লেখালেখিটা ছেড়ো না। সৃষ্টিকর্তা সবাইকে এই প্রতিভা দেন না। তোমাকে ভালোমতোই দিয়েছেন, তুমি এটার চর্চা চালিয়ে যাবে, তোমার কাছে আমার এটাই অনুরোধ।

এরপর স্যারের সঙ্গে ফেসবুকে যুক্ত হলাম। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্যারের চেহারায় পরিবর্তন এলেও আমি শারীরিক গঠনে স্যারকে ঠিকই চিনলাম। চরভবানীপুরের মতো অজপাড়াগাঁয়ে থিতু হওয়া একজন শিক্ষক। যার হাত ধরে বদলে গিয়েছে একটা প্রান্তিক পদের জনগোষ্ঠীর জীবন বোধ। আমাদের ব্যাচের ইশারত পরে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে এখন একটা গার্মেন্টসে কর্মরত। গণি, কামাল ওরা এলাকাতে থেকেই ব্যবসা করছে।

আমাদের সিনিয়র বাবলু ভাই গ্রামেই চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। আমাদের জুনিয়র আলতাফ এখন পুলিশের ঢাকা বিভাগের সাব ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত। এগুলোকে খুবই সামান্য অর্জন মনে হতে পারে যে কারও কাছে। কিন্তু আমরা জানি, এগুলো একটা প্রান্তিক চর এলাকার জনগোষ্ঠীর জন্য কত বড় অর্জন। সভ্যতার সব ধরনের সুবিধাবঞ্চিত একটা জনগোষ্ঠীর গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাওয়ার গল্প এগুলো।
চরভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যেই ক্যাম্পাসে আমরা পড়তাম সেটা ইতিমধ্যেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

সেই সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে বহু মানুষের ঘরবাড়ি। পরে স্থান পরিবর্তন করে আবারও নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সেই ভবনের কারুকাজ খুবই দৃষ্টিনন্দন। গত বছর দেশে বেড়াতে গিয়ে প্রথমে তাই স্কুলটা দেখতে গিয়েছিলাম। এরপর খুঁজে পেলাম বন্ধু গণি, কামাল ও বাবলু ভাইকে। তখনই মনে পড়ে গিয়েছিল বাগচী স্যারের কথা। তারপর ঠিক গল্পের মতো করে স্যারকে খুঁজে পাওয়া ৩২ বছর পরে। আমাদের সময়ের অকৃত্রিম শিক্ষকদের আমরা মনে রাখব, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। যারা আমাদের জীবনের চাকাটা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। আসলে মানুষের প্রাথমিক শিক্ষার ধাপটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আমাদের দেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকেরাই সবচেয়ে অবহেলিত। আমার ব্যক্তিগত পরামর্শ হচ্ছে সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতনে প্রাথমিকে নিয়োগ দেওয়া উচিত।

তাহলেই বদলে যাবে দেশের শিক্ষার চরিত্র তথা দেশের চরিত্র। আমরা হয়ে উঠব স্বনির্ভর জাতি। কারণ শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর সেই মেরুদণ্ড তৈরির ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা।

শিক্ষক দিবসে (৫ অক্টোবর) দুনিয়ার সব শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। আমাদের জীবনের শুরুর শিক্ষকেরা যেন যথাযথ মর্যাদায় সমাজে অধিষ্ঠিত হতে পারেন সেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি। কারণ, শিক্ষকেরাই মানুষ গড়ার আসল কারিগর।