আব্বা কাঁধে তুলে নিল আমায়

বাবা দিবস পালিত হয়েছে ১৬ জুন। এ–সংক্রান্ত পাঠকের পাঠানো লেখা থেকে বাছাই করা লেখা প্রকাশিত হচ্ছে দূর পরবাসে।

‘ভালো হোক, মন্দ হোক, বাবা আমার বাবা।’ না, বাক্যটি শুধু আমার একার নয়; সব সন্তানের জন্য প্রযোজ্য। বাবাকে এক্সট্রা ভালোবাসা দিতে ১৬ জুন পালিত হচ্ছে বাবা দিবস। বাবা দিবস আর মা দিবস দুটি আলাদা আলাদা দিনে পালিত হওয়ায় কেন যেন আমার কাছে একটু ডিভোর্স ডিভোর্স ভাব লাগে।

প্রথম আলো বাবা দিবসে বাবাকে নিয়ে লেখা আহ্বান করেছে। সব সংসারের বাবাই কিন্তু তার সন্তানদের জন্য কাঁধ পেতে দেয়। লেখা আহ্বান করে সেখানে প্রথমে যে ছবি ছাপিয়েছে, তা যথার্থ হয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক বাবা তার সন্তানকে আদর–ভালোবাসার সঙ্গে কাঁধে তুলে নিয়ে ঘুরছে। এত সুন্দর একটা মহব্বতের ছবি দেখে আমার মনে পড়ে গেল আমার ছোটবেলার একটি ঘটনা। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগের ঘটনা, যে ঘটনা দিব্যি মনে আছে আমার।

আমি ক্লাস থ্রিতে। সবে বাইসাইকেল চালানো শিখেছি। সিটে নয়, রডের ওপর বসে হাফ প্যাডেল, মাঝেমধ্যে ফুল প্যাডেল দিতে পারতাম। তখনকার দিনে আমাদের বাড়ি থেকে নিকটবর্তী বাজার ছিল সাচিলাপুর।

আমি নতুন বাইসাইকেল ড্রাইভার, ফুর্তি অন্য রকম। আমি ধান্দায় থাকতাম, আব্বা অফিস থেকে কখন বাড়ি ফিরবে। আব্বা অফিস থেকে ফিরে বাইসাইকেল রাখামাত্র আমি সাইকেল নিয়ে দে ছুট।

একদিন সাইকেল চালাচ্ছি, হঠাৎ আব্বার ডাক। ভাবলাম, সাইকেল চালানোর অপরাধে পিটুনি খাওয়া লাগবে। আমি খরগোশের মতো কাঁপতে কাঁপতে আব্বার কাছে গেলাম। কাছে যাওয়ামাত্র তৎকালীন ১০ টাকা আমার হাতে দিয়ে সাচিলাপুর থেকে চিনি কিনে আনতে বলল। এটা আমার সাইকেল কর্তৃক প্রথম দায়িত্ব পাওয়া। এ জন্য খুশিতে আত্মহারা। মা হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ ধরিয়ে দেখেশুনে সাইকেল চালানোর পরামর্শ দিল।

হাফপ্যান্ট আর হাফহাতা গেঞ্জি পরে সাইকেলের রডে বসে প্যাডেল মেরে ছুটছি সাচিলাপুর বাজারের উদ্দেশে। মাঝপথে একটা খাল ছিল। সেই খাল দিয়ে মাঠ থেকে পানি সব সময় নেমে হানু নদে প্রবেশ করত। এই চলার পথে বাঁশ দিয়ে চটা তৈরি করে সেই চটা দিয়ে চওড়া মাচা বানিয়ে খালের ওপর দেওয়া হতো। জনসাধারণ তার ওপর দিয়ে খুব সহজে আসা–যাওয়া করতে পারত।

খালের দুপাশে খুবই ঢালু। আমার পক্ষে তখন সাইকেল চালিয়ে অপর প্রান্তে ওঠা সম্ভব ছিল না। তাই সেখানে পৌঁছে সাইকেল থেকে নামতে বাধ্য হলাম। সাইকেল ঠেলে ঠেলে খাল পার হয়ে আবার সাইকেল চালাব। শরীরে ফুর্তি অন্য রকম। সাইকেলে ওঠার আগে পকেট চেক করার কথা মাথায় এল। ১০ টাকা পকেটে আছে তো?

যেমন চিন্তা তেমন ফল। পকেটে টাকা নেই। ডান পকেটে হাত দিই, টাকা নেই। বাঁ পকেটে হাত দিই, টাকা নেই। পেছনের পকেটে? ফাঁকা পকেট, হাতে কিচ্ছু বাধে না। টাকা নেই। ব্যাগ হাতড়াতে থাকি, সেখানেও নেই । টাকা রেখেছিলাম প্যান্টের পকেটে, এটা নিশ্চিত ছিলাম। তবু গেঞ্জির পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে পকেট বড় করে ফেলেছিলাম।

টাকা আর পাওয়া গেল না। এখন কি আমি বাড়ি চলে যাব? টাকা হারিয়ে ফেলেছি, এ খবর যদি আব্বা শোনে, তাহলে আমার আর নিস্তার নেই। সাইকেল চালানোর ফুর্তি এখন আমার ধূলিসাৎ হয়ে গেল। সামনের দিকে যাব, নাকি পেছনে দিকে, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। অবশেষে কাঁদতে কাঁদতে বাজারের উদ্দেশে রওনা হলাম।

বাজারের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এ কারণে, বাজারে রাধু কাকার বড় একটা দোকান ছিল। আব্বার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তাঁর। আব্বা সেখান থেকেই কেনাকাটা করত। মাঝেমধ্যে আমি রাধু কাকার দোকানে যেতাম আব্বার সঙ্গে। সেখান থেকেই রাধু কাকার সঙ্গে চেনাজানা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে রাধু কাকার দোকানে গিয়ে উঠলাম। আমাকে কাঁদতে দেখে কাকা এগিয়ে এলেন আমার কাছে।

রাধু কাকা আমার কাছে জানতে চাইলেন, কী হয়েছে? কেঁদে বললাম, আব্বু আপনার দোকান থেকে চিনি কেনার জন্য ১০ টাকা দিয়েছিল, কিন্তু পথে হারিয়ে ফেলেছি। আব্বু ভীষণ পেটাবে। তাই আপনি আমার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে চলেন এবং আব্বাকে বলেন যে আমাকে যেন না পেটায়। আমার খুব ভয় হচ্ছে।

রাধু কাকা বললেন, আমি তোমাকে চিনি দিচ্ছি। তুমি চিনি নিয়ে বাড়ি চলে যাও। আমি রাধু কাকার কথামতো চিনি নিয়ে বাড়িতে গেলাম। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় যতটা ফুর্তিতে ছিলাম, বাড়িতে প্রবেশ করার সময় মুখমণ্ডল ছিল গম্ভীর। ভয়ে টাকা হারানোর কথা লুকিয়েই রাখলাম। চিনি যখন এসেছে, নিশ্চয়ই টাকা দিয়ে কিনে এনেছি।

বাড়িতে সবার সঙ্গে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলাম। খেলাধুলা ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু চোরের মন পুলিশ পুলিশ। কখন আব্বা জেনে যায় ঠিক নেই। জেনে গেলে কখন যে পেছন থেকে এসে ঘাড়টা মটকায়, এমন ভয় ছিল মনে।

বিষয়টি গোপন রেখেই রাতে ঘুমাতে গেলাম। মনের মধ্যে আঁকুপাঁকু করছিল। আব্বা আমার পাশে শুয়ে। চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছি। মধ্যরাতে স্বপ্ন, পুলিশ আসার স্বপ্ন। পুলিশ আমাকে ধরবে। স্বপ্ন কত খারাপ! আব্বাকে না এনে পুলিশ এনেছে। স্বপ্নের মধ্যে আমি পুলিশ পুলিশ বলে চিৎকার করে উঠলাম। সবার ঘুম ভেঙে গেল। মুরব্বিরা তড়িঘড়ি করে আমাকে লবণপানি ফুঁ দিয়ে খেতে দিল। আমি খেয়ে নিলাম।

সকালে আব্বা অফিসে যাবে। আব্বার অফিস রাধু কাকার দোকানের দিকেই। নিশ্চয় আজ রাধু কাকা আব্বার কেছে হাঁড়ি ভাঙে দেবেন। সুতরাং আমি সারা দিন ভয়ে থাকলাম। আব্বা অফিস থেকে ফিরে নিশ্চয় আমাকে পিঠের ছাল ওঠাবে।

বিকেলের আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। কখন আব্বা আসে। ওই যে আব্বা আসে সাইকেল চালিয়ে। আমি এক দৌড়ে একটা রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে আছি। আব্বা অফিস থেকে এসে খাবার খেয়ে আমার খোঁজ নিচ্ছে। এবার আর নিস্তার নেই আমার। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে আমাকে পেয়ে গেল। তখন আমার কান্না দেখে কে! শুরু হলো কান্না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছি। আব্বা তখন আমাকে কাঁধে তুলে নিল। কাঁধে তুলে নিয়ে আব্বা বলতে লাগল, টাকা হারিয়েছে তাতে কী হয়েছে, তুমি গতকাল বাজার থেকে সুন্দরভাবে ফিরে এসেছিলে, সেটাই তো আমার বড় আনন্দ ছিল।
 

দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]