দাস ব্যবসা ও হাইতির প্রাপ্য শোধে ফ্রান্সকে তাগাদা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দারিদ্র্য–দুর্যোগ ইত্যাদি ছাড়া হাইতি সম্পর্কে বলার তেমন কিছুই নেই। এরই মধ্যে গত দশকেরও আগে ভূমিকম্পে দরিদ্র দেশ হাইতির জানমাল সবকিছুর অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়। শুধু আড়াই লাখ মানুষই প্রাণ হারিয়েছে। পুরো দেশ এক ধ্বংসের যজ্ঞপুরীতে পরিণত হয়। সে ক্ষতি পোষানোর জন্য প্রয়োজন সরা বিশ্বের উদার সাহায্য–সহযোগিতা। গত ২০১১–এর মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কনফারেন্সে দেশটিকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ছিল ৫.৯ বিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলার। প্রতিশ্রুত সাহায্যের কণামাত্র হাইতিকে দেওয়া হয়েছে।

মাত্র ৫টি দেশ ৫৬৭ মিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলার সাহায্য পাঠিয়েছে, দেশগুলো হল ব্রাজিল, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, কলম্বিয়া ও এস্তোনিয়া।  দেশটি দরিদ্র তবে তাদের সাহসী চেতনার ফসল ফরাসি কলোনিয়াল দাসপ্রথার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি ছিনিয়ে নেওয়া। সে বহু দিন আগের কথা তখন হাইতির নাম ছিল সেইন্ট ডমিনিক। হাইতির মানুষদের দাস হিসেবে খাটিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলছিল ফরাসিরা। দাস শোষণের কারণে হাইতি ছিল ফরাসিদের সবচেয়ে বেশি লাভজনক কলোনি বা উপনিবেশ। তবে কত দিন মানুষ মাথা নিচু করে মুখ বুজে থাকবে? ফরাসি ঔপনিবেশিক দাসত্বের বিরুদ্ধে দাসেরা বিদ্রোহ করল ১৭৯১ সালে। লড়াই চলল প্রায় ১৪ বছর। হাইতির মানুষেরা ১৮০৪ সালে নেপোলিয়নের সৈন্যবাহিনীকে হারিয়ে পৃথিবীর বুকে প্রথম ব্ল্যাক রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করেন।

হাইতি মুক্তি আদায় করলে কি হবে, ফ্রান্সের ধূর্ত দাসমালিকেরা দাস হারানোর ক্ষতিপূরণ দাবি করল তাদের কাছে। তারপর ফ্রান্সের রাজা দশম চার্লস হাইতির কাঁধে ১৫০মিলিয়ন গোল্ড ফ্রাঙ্ক ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স ডেট’ নামের এক অদ্ভুত জবরদস্তিমূলক ক্ষতিপূরণের দায় চাপিয়ে দিল। যা ছিল হাইতির বার্ষিক রাজস্ব আয়ের দশ গুণ বেশি। এই অন্যায় বিবেকহীন ঋণের দাবি হাইতির মানুষ দীর্ঘদিন লাগিয়ে পূরণ করেছে। তারা ১৮২৫ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সাল নাগাদ এ জুলুম করে চাপিয়ে দেওয়া দেনা শোধ করেছে।

যে হাইতির মানুষেরা দাস প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ফরাসি উপনিবেশের কবল থেকে নিজের দেশ ও নিজেদের মুক্ত করেছিল, তাদের কাছ থেকেই ‘স্বাধীনতার ঋণ’ আদায় করা হয়; আজকের দিনে যার মূল্য ২৪ দশমিক ২ বিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলার। ভাবতে অবাক লাগে যে তখন এমন ঘৃণ্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার মতো বিবেকবান কণ্ঠ কি পৃথিবীর কোনায় কোনায় ছিল না?

যখন ১৮২৫ সালে দাস হারানোর জন্য ফরাসি দাসমালিকেরা দারিদ্র্যপীড়িত হাইতির কাছে ক্ষতিপূরণ আদায়ে মত্ত, তখন কিন্তু পৃথিবীতে দাসপ্রথা বেআইনি। হাইতি এই অন্যায়ভাবে আদায় করা অর্থ ফেরত চেয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিল। ফরাসি মদদে ২০০৪ সালে হাইতির সরকারকে উৎখাত করা হলে ঐ অর্থ আদায়ের মামলা বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।

ঐ পুতুল সরকার কার স্বার্থে অর্থ আদায়ের মামলা চালিয়ে যাওয়া বাদ দিয়েছিল? যারা পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, অবশ্যই তাদের স্বার্থে। কারা তাদের ক্ষমতায় বসিয়েছিল? ফ্রান্সের মদদ অবশ্যই।

আজ পৃথিবীতে বিবেকবান কণ্ঠ আছে তাই ভূমিকম্পে চরম দুর্দশাগ্রস্ত হাইতির পূনর্গঠনে যখন দরকার ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলার, তখন একাডেমিক নোয়াম চমস্কি, কানাডার অধিকারকর্মী নাওমি ক্লেইন, আফ্রিকান-আমেরিকান নাগরিক অধিকারকর্মী কর্নেল ওয়েস্ট ও বেশ কজন ফরাসি দার্শনিক ফ্রান্সকে আহ্বান করেছেন, হাইতির ২৪ দশমিক ২ বিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলার ফেরত দিতে। তাঁরা বলছেন, ফ্রান্স হাইতির ন্যায্য অর্থ ফেরত দিলে সাহায্য ও দান যতটুকু পাওয়া যায়নি, সে ঘাটতি পূরণ হবে।

অনেকেই জানে না কলোনিয়ালিজমের ছোবল কেমন ছিল? ফ্রান্সের কলোনিয়াল কামড়ে আজও হাইতির মতো অসহায় দরিদ্র দেশে ন্যায্যা পাওনার কথা বলে যে সরকার তাকে উৎখাত করা হয়, রক্ত ঝরে।

হাইতিতে ২০১০ সালে ১২ জানুয়ারি ভূমিকম্প যে গভীর ক্ষতি সাধন করেছে, যে কষ্টে মানুষ পড়েছে, তা থেকে বাঁচার জন্যই ঐ অর্থ তাদের দরকার। ফ্রান্সকে ঐ অর্থ ফেরত দেওয়ার আহ্বানে আরও স্বাক্ষর করেছেন ইউরোপ, কানাডা ও ফিলিপিনের পার্লামেন্টারিয়ানরা।

পৃথিবীতে বিবেকের কণ্ঠ জাগ্রত আছে এখন। তারা গর্জনে সোচ্চার নন, জ্ঞান ও তথ্যের ভিত্তিতে ক্ষোভে ও ধিক্কারে তারা প্রকাশ করেন তস্করদের কুকীর্তি, অসহায় মানুষের পক্ষ থেকে তুলেন নায্য পাওনা শোধের দাবী।

এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে কোনো এক দুর্যোগের পর হাইতিতে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন মানবিক সাহায্য নিয়ে হাজির হয়। সাহায্যের নামে সেসব সংগঠন হাইতি থেকে অনেক শিশুদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসে। অসহায় দারিদ্র্য ও দুর্যোগপীড়িত হাইতির এইসব শিশুদের তারা ব্যবসার কাজে ব্যবহার করে। কী ব্যবসা? যে ব্যবসাতে মুনাফা প্রচুর। পর্নগ্রাফি নির্মাণের ব্যবসা। বিষয়টি মিডিয়াতে ফাঁস হয়ে যায়। মানবিক সাহায্যের লেবাস গায়ে জড়িয়ে হাইতি থেকে পর্নগ্রাফির জন্য শিশু সংগ্রহের এই জঘণ্যতম কর্ম ওয়ার্ল্ড মিডিয়াতে আলোচিত হয় ও নিন্দিত হয়। মার্কিন সরকারও এ বিষয়ে কি কি সব পদক্ষেপ নেবে বলেছিল তখন। কিন্ত সে পথ মাড়ায়নি।

  • 'গার্ডিয়ান–এ প্রকাশিত একটি খবরের আলোকে লিখিত