ডক্টর গ্লাসের ডায়েরির পাতা থেকে
(হলমার সোডারব্যারি মূল সুইডিশ থেকে অনুবাদ)
২৩ জুন
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি উজ্জ্বল নীল রাত। জানালার পাশে বসে জীবনের ফেলে আসা অতীত নিয়ে ভাবছিলাম, কেন জীবন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে এসেছিল, তার কারণ অনুসন্ধান করছিলাম।
ভালোবাসার স্বপ্ন, আমার স্বপ্ন, একসময় মনে হয়েছে স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত হওয়ার কাছাকাছি। মধ্য গ্রীষ্মের রাত, অদ্ভুত ফ্যাকাশে রাতের স্মৃতি ফিরে আসে, সেই স্মৃতি যা সত্যিই আমার জীবনের একমাত্র বস্তু, একমাত্র জিনিস যা ম্যাপলগাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। যখন অন্য সব পুড়ে শেষ হয়ে যায় এবং ধুলা হয়ে যায় এবং কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, তখনো স্মৃতিরা দাঁড়িয়ে ধাকে।
মিডসামারে সাপ্তাহিক ছুটির মাঝামাঝি সময়ে দেশে মামার বাড়িতে ছিলাম।
মিডসামারের রাত্রী সে এক অভাবনীয় ব্যাপার। বনের শুকনা ডালপালা জড়ো করে আগুন ধরিয়ে, আগুনের লেলিহান শিখায় মাইপোল ঘিরে নৃত্য। সে নৃত্যে যৌবন উপচে পড়ে। জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মতো ভেতরেও আগুন ধরিয়ে দেয়। মিডসামার পার্টিতে অনেক যুবক–যুবতীর ভিড়ের মাঝে সেই মেয়েটিও ছিল। অনেক আগে এক পারিবারিক পার্টিতে দেখেছি। তবে পরিচয় ছিল না। হঠাৎ মনে হলো আমার এক বন্ধু একবার এক পার্টিতে মেয়েটি সম্পর্কে বলেছিল, মেয়েটির তোমার প্রতি কোমল দৃষ্টি রয়েছে, সে সারা সন্ধ্যা তোমায় দেখেছে। কিন্তু বিশ্বাস হয়নি। তাকে নিয়ে ভাবিনি, কিন্তু এখন ভাবতে হচ্ছে। মেয়েটি তার দিকে তাকাতে বাধ্য করেছে। লক্ষ করেছি সে মাঝেমধ্যে আমার দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটি সম্ভবত অনেকের চেয়ে সুন্দর নয়, তবে ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
মাইপোল ঘিরে আমরা কয়েকবার নাচলাম। আদিকাল থেকে মাইপোল উর্বরতার উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে, মাটির উর্বরতা, জীবনের উর্বরতা। তারপর ওকে উঠিয়ে নিয়ে অন্ধকার পাইনবনের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। এগিয়ে গেলাম আমরা জোড়ায় জোড়ায় পাহাড়ের মাথায় যেখানে আগুন জ্বেলে মাইপোলকে ঘিরে নাচ হবে সারা রাত সূর্য ওঠার পূর্ব পর্যন্ত। আঁধারে লম্বা পাইনবনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটি গাছের শিকড়ে হোঁচট খেলে আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। অনুভব করলাম তার নরম, দৃঢ়, উষ্ণ হাত আমার হাত আঁকড়ে ধরেছে। যেতে যেতে আমরা কি কোনো কথা বলেছিলাম? মনে পড়ে না। একটি শব্দও স্মৃতিতে নেই। শুধু তার কণ্ঠস্বর আর বনের ভেতর হাতে হাত রেখে হেঁটেছিল অনেক পথ।
আমরা পাহাড়ের মাথায় উঠে এলাম। অন্য যুবক–যুবতীরা আমাদের আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে মাইপোল ঘিরে আগুন জ্বালানো হয়ে গিয়েছিল। আমরা তৃণভূমিতে জোড়ায় জোড়ায় ভোরের আলোর অপেক্ষায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে বসলাম। পর্বতচূড়ায় আগুন জ্বলছে। মাথার ওপর বিশাল ও উজ্জ্বল নীল চাঁদ। নিচে বরফময় প্রশস্ত উপসাগর ও প্রণালি। তখনো তার হাত আমার হাতের ওপর। ধীরে ধীরে আদর করার সাহস নিয়ে তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকালাম এবং দেখলাম তার ত্বক রাতের ফ্যাকাশে আকাশে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে এবং তার চোখ অশ্রুতে পূর্ণ। কিন্তু মেয়েটি কাঁদেনি, শান্তভাবে শ্বাস নেয়। চুপচাপ বসেছিলাম আমরা, কিন্তু আমার ভেতরটা গান গেয়ে ওঠে। পুরোনো দিনের গান। বাতাসে পুরো পৃথিবী আমাদের নিচে নাচছিল।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
রাত গভীর। আমরা অনেকক্ষণ এভাবে বসে রইলাম। যুবক–যুবতীরা একে অপরের সঙ্গে এই রাতেই মিলিত হয়। মিলিত হয় জীবনের উর্বরতার জন্য। শীতল বাতাস বইছে। দু-একজন উঠে ঘরের দিকে পা বাড়াল। চলে গেল, কে যেন বলে উঠল, পূর্ব দিকজুড়ে মেঘ, সূর্য দেখা দেবে না। ধীরে ধীরে ভিড় কমে গেল, আমরা ছিলাম, শেষ অবধি আমরা ছিলাম। অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম, সে স্থিরভাবে আমায় দেখল। তারপর আমি আমার দুহাতের ভেতর তার কোমল মুখ তুলে নিলাম। তার নরম অধর পূর্ণতায় ভরে গেছে। চোখ দুটি অর্থ ফোটা ফুলের মতো ফুটে আছে। সে সময় তার অধরে চুমু দিলাম। হালকা ও নির্দোষ চুম্বন। সে চোখের পাপড়ি খুলে আবার বন্ধ করে। আমরা দীর্ঘ চুম্বনে আবদ্ধ হলাম। তার শরীর শিহরিত হলো। তারপর গালে গাল লাগিয়ে একে অপরকে অনুভব করলাম। এ সময় কে যেন তাকে ডাকল। সে ঝাঁকুনি দিয়ে বাঁধনমুক্ত হয়ে পাইনবনের ভেতর দিয়ে হালকা পায়ে দৌড়ে গেল।
এরপর তাকে আর দেখিনি। দশ বছর হয়ে গেছে। আজ থেকে দশ বছর আগে। আজও যখন সে রাতের কথা ভাবি, আমি অসুস্থ অনুভব করি। পরের দিন আমরা দেখা করব, সে সম্পর্কে চিন্তা করিনি। তা হয়নি। মেয়েটির মা–বাবা ধারেকাছে কোথাও থাকতেন। হয়তো পরে কোনো দিন আমরা দেখা করব, একসঙ্গে থাকব কিন্তু সেদিন আর আসেনি। পরদিন বিকেলে বৃষ্টির ভেতর আমায় শহরে ফিরতে হলো। দিন কয়েক পর খবরের পাতায় দেখলাম বান্ধবীর সঙ্গে ঝিলে সাঁতার কাটতে গিয়ে মারা গেছে মেয়েটি। সেই থেকে দশ বছর হয়ে গেল।
আমি প্রথমত হতাশ ছিলাম। কিন্তু আমার ভেতরের প্রকৃতি ছিল প্রকৃতই শক্তিশালী। আগের মতো কাজ করে গিয়েছি। শরতে ডিগ্রি পেলাম, কিন্তু ওর জন্য কষ্টও পেয়েছি। রাতে প্রায়ই ওকে দেখতাম। দেখতাম সাদা কাপড়ে মোড়া দেহটি সামুদ্রিক শৈবাল ও কাদার মধ্যে জলের ওপর শুয়ে হাসছে। চোখ দুটি খোলা, মুখও খোলা, যে মুখে চুম্বন করেছিলাম। লোকজন নৌকা নিয়ে ওকে জল থেকে তোলে। নরম বুকে শ্যাওলা লেগে আছে, যে বুক আমার হাত স্পর্শ করেছিল। এরপর অনেক সময় লেগেছিল নিজেকে নতুন করে অনুভব করতে। তারপর বছরের পর বছর কেটে গেল এবং জীবন আমাকে পাশ কাটিয়ে গেল।