তুমি আমার অহংকার
ফারিহার সঙ্গে হাসপাতালে কাজ করছি গত ১০ বছর। ভীষণ চটপটে মেয়ে। আমার চেয়ে বছর কয়েকের বড় হবে কিন্তু ওর চপলতা সবকিছুকে হার মানায়। দেখতেও সে ভীষণ সুন্দর। আমাদের পাশাপাশি কিউবিকলে অফিস। লাঞ্চের সময় কোন রোগীর লোক কী বললেন, কোন রোগী নিয়ে চিন্তিত আমরা, এত অসুস্থ কেন, আর কীভাবে কাজ করলে এই শীতের দিনে সূর্য ডোবার আগে বাসায় যেতে পারব—নানা ধরনের কথা বলি আমরা। আমরা বলি, এটা আমাদের ভেন্ট সেশন। সব ঝামেলার সমাধান বকবক করে শেষ করে আবার চলে যাই কাজে মন ভালো করে। কাজের পরিবারের আমরা দুই সদস্য, আমাদের সবাই মানিকজোড় বলে। আসলে বন্ধুত্ব তো দেশ–কাল মানে না।
আমাদের কাজ থাকে টানা নয় দিন। মানে মাসে দুটি শনি ও রোববার আমাদের কাজ করতে হয়। অনেক সময় দুপুরে দাওয়াত থাকে। কাজের চাপে যেতে পারি না, কিন্তু গত শনিবার বিজয় দিবস পালন অনুষ্ঠান ছিল। আমি যাবই। বন্ধুরা গাইবে, আবৃতি করবে, নাচবে। ডাক্তার হলেও মন তো আছে, বিজয় দিবস এলেই কেমন গর্বে মন ভরে থাকে। যে হাসপাতালে আমরা কাজ করছি, পার্কিং লটে বেজমেন্ট দিয়ে চলে যাওয়া যায়। শাড়ি পরে দৌড়ে গাড়িতে উঠলে খুব কম লোকের চোখেই পড়ার কথা।
১৪ ডিসেম্বর খুব ভোরে কাজে গেলাম, রোগী দেখা শেষ করে দুপুরে একটু সেজেগুজে ডাক্তারদের স্লিপিং রুমে গিয়ে শাড়ি পরে নিলাম। অফিসে গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যাব, এমন সময় ফারিহা তাকাল, তারপর পরিষ্কার বাংলায় বলল, আজকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস না? এবার আমার হাঁ হওয়ার পালা আমার। তুমি বাংলা জানো? মানে আমি তো ভেবেছি তুমি স্প্যানিশ। ফারিহা হাসল, তারপর বলল অনুষ্ঠান শেষ করে খুব টায়ার্ড না থাকলে আমার বাসায় আসবে? মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। আমি বললাম অবশ্যই আসব। কিন্তু…ফারিহা হেসে বলল, সংবেদনশীল লেখক সাহেব, বাকিটুকু রাতের জন্যই তোলা থাক না।
গেলাম বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে। সবাই কী সুন্দর গাইছে, নাচছে, ফুটিয়ে তুলছে একাত্তরের সেই দিনগুলো, কিন্তু আমার মন পড়ে আছে ফারিহার কাছে। ও বাংলাদেশি? কিন্তু ও তো এ দেশের। এত সুন্দর বাংলা ও কীভাবে জানল? আমাকে কেন বলল না সে? অনুষ্ঠানে চা আর পিঠা খেলাম। আনমনা হয়ে শাড়ি ও গয়নার দোকানেও একটু ঢুঁ মারলাম। বিকেলের দিকে ফারিহার বাসায় রওনা দিলাম। শীতের ছোট্ট একটা বিকেল। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগের মুহূর্ত। ওদের বাসাটা পাহাড়ের ওপর। পাহাড় আমাকে ভীষণ টানে। গোলাপি আলোয় মুগ্ধ হয়ে একটা রাজপ্রাসাদের সামনে পৌঁছে গেলাম আধা ঘণ্টা পর।
দরজায় বেল দেওয়ার আগেই দরজা খুলে গেল। শাড়ি পরা ভদ্রমহিলা যে ফারিহার মা, তা কেউ না বলে দিলেও বুঝতাম। ওদের চেহারায় এত মিল। সালাম দিলাম। উনি বললেন, এসো, মামণি। তো তোমাদের অনুষ্ঠান কেমন হয়েছে? বললাম, দারুণ! কিন্তু ফারিহা যে বাংলাদেশি, এত দিনে কখনো বুঝিনি। ও বলে না কেন? উনি বললেন, মামণি, ও যে বাবা ছাড়া বড় হয়েছে। ওর জীবনে আমি চেষ্টা করেছি সব অপূর্ণতাকে পূর্ণ করে দিতে। কিন্তু না দেখা বাবাকে আমার মেয়ে খুব মিস করে। চলো ডিনার করে নিই। তোমরা তো সাতটার পর আর কিছু খাও না। পেঁপে দিয়ে ডাল, রুই মাছ, গরুর মাংস আর শিম ভাজি—আমার সব প্রিয় খাবার সাজানো। খাওয়ার পর ব্যাকইয়ার্ডে হিটার চালিয়ে আমরা তিনজন বসলাম।
ফারিহা চা হাতে বসল। আমি বললাম, খালাম্মা, কিছু মনে না করলে জিজ্ঞাসা করি, ওর বাবা কোথায়? কেন সে বাবা ছাড়া বড় হয়েছে? খালাম্মা বললেন, অনেক গভীর কষ্টের কথা মা; ঘটনা খুব বেশি বড় না যদিও। ১৯৬৯ সালে আমি আর ফারিহার বাবা ডাক্তারি পাস করি। বিয়েটা হয় ইন্টার্নি করার সময়। বিয়ের জন্য দুই পরিবারের অমত ছিল। কারণ, আমি চাইতাম দেশের বাইরে যেতে আর ওর বাবা চাইত দেশে থাকতে। বিয়ে করার পরপর আমরা সুযোগ পেয়েছিলাম বাইরে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার, কিন্তু ফারিহার বাবা রাজি হলেন না। দেশ মাকে অনেক কিছু দেওয়ার আছে ওঁর। দুজনে তখন একটা হাসপাতালে চাকরি করি, ১৯৭০ সালের মাঝে ফারিহা এল জীবনে। দেশ তখন প্রতিবাদে উত্তাল। ওর বাবা সব সময় বলতেন আমরা মেয়েটাকে স্বাধীন দেশে বড় করব, তুমি দেখে নিয়ো। ও ডাক্তার হয়ে দেশে সেবা করবে। তারপর এল ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ। মাঝরাতে একজন অসুস্থ রোগী দেখানো দরকার বলে কিছু লোক নিয়ে গেল ওর বাবাকে বাসা থেকে। উনি আর ফিরে আসেননি। আমি বছর দুয়েক পর সরাসরি চাকরি নিয়ে এ দেশে আসি। গল্পগুলো শুনে শুনে কতটা মনে গেঁথে নিয়েছে ফারিহা, আমি জানতাম না। তারপর অনেক সময় পার হয়েছে।
ও বিয়ে করেনি, এ দেশে আর বাংলাদেশে দুটি এতিমখানা চালায় ও। ও হ্যাঁ, বাংলা যতটুকু পেরেছি, ওকে আমি শিখিয়েছি, কিন্তু ইউ সি বার্কলে ইউনিভার্সিটিতে ও বাংলা ভাষাতেও গ্র্যাজুয়েশন করেছে। আমি বললাম, ফারিহা, তোমার বাবা খুব গর্ববোধ করতেন আজকের তোমাকে দেখলে। ও হাসল। বলল, আমি কিন্তু গাইতেও জানি, শুনবে?
বললাম শোনাও। ওর পিছে পিছে গেলাম ওর পিয়ানোর রুমে। ও গাইছে
‘একটি বাংলাদেশ
তুমি জাগ্রত জনতার
সারা বিশ্বের বিস্ময়
তুমি আমার অহংকার’...