ঝগড়া
ঘটনাটি ক্লাস নাইন বা টেনের কোনো এক সময়ের, সম্ভবত ১৯৯৮ সাল। কোনো কারণ ছাড়াই কোচিং ক্লাসে রবিন আর অপলার মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল।
ঢাকার একটি বালিকা বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষিকার বাসায় সকালে ব্যাচে পড়তে যেত একঝাঁক ছেলেমেয়ে। ক্লাসের বেশির ভাগ মেয়ে আর গুটি কয়েক ছেলে ছিল পাশের এক বালক বিদ্যালয়ের।
অপলাকে বাইরে থেকে একটু জেদি বলে মনে হতো। সেটি সুন্দরী বলে নাকি অন্য কোনো কারণে, তা বোঝা যেত না। কথা বলত না ছেলেদের সাথে। ছেলেরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখত, কিছু বললে কী বলে বসে, এই ভয়ে। তখন তো কিছু বলার সাহস তৈরি হয়নি অনেকেরই।
সেই ১৯৯৮ সালের কথা...
একদিন ক্লাস ছুটির পর সবাই বের হচ্ছে। ছেলে সেদিন মোটে চারজন—মিঠু, রবিন, ফাহিম আর নাসির। মজার বিষয় হলো, মনে মনে সবাই অপলাকে বেশ পছন্দ করত; কিন্তু কেউ মুখ ফুটে কিছু বলত না। রবিন ছিল কিছুটা তার ছেঁড়া টাইপের। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত। সবকিছু লক্ষ করত; কিন্তু কিছু বলত না। ফাহিম তো ভেতরে ভেতরে শেষ, তবে বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। মিঠু দু–একবার সাহস করেছিল বলার। সেই সাহসের গুড়ে বালি, মেয়ে ফিরেও তাকায় না।
যাহোক ছেলেরা যে যার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রবিনের জন্য অপেক্ষা করছে তিনতলার দরজার বাইরে। রবিনের ব্যাগ গোছানো শেষ। চেয়ারে বসে উবু হয়ে জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে গুনগুনানির চেয়ে এক-দেড় স্কেল উঁচু স্বরে গান গাইছে। কালজয়ী সেই গান—‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে...’
ক্লাসে মাত্র তিনজন মেয়ে তখন—অপলা, নীনা আর সেলিনা। অপলার বান্ধবী নীনার বাবা মোটরসাইকেল চালিয়ে তাকে নিতে আসেন। কিন্তু সেদিন দেরি হচ্ছে। সেলিনা মাত্রই বের হয়ে গেল। বাকিরা আগেই চলে গেছে। অপলা নিজের ব্যাগ গুছিয়ে অপেক্ষা করছে নীনার বাবার জন্য। উনি নীনাকে নিতে এলে সেও চলে যাবে। এর মধ্যে গানের শব্দ কানে যেতেই কী হলো কে জানে, হয়তো–বা কোনো কারণে অপলার মেজাজ আগে থেকেই খারাপ ছিল, সে রবিনকে হঠাৎ ঝাড়ি দিয়ে বসল—‘এই ছেলে, এটা কি তোমার বাসা পেয়েছ? গান গাচ্ছ কেন? গান বন্ধ করো। বাসায় গিয়ে গান গাও বা বাইরে গিয়ে, ক্লাসে না।’
ঘটনার আকস্মিকতায় রবিনের চোখেমুখে পুরোপুরি অবিশ্বাসের ছাপ। ওর মতো ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে চলা কোনো ছেলেকে কোনো মেয়ে হুট করে ঝাড়ি দিয়ে বসতে পারে, এটা সে ভাবতেই পারছে না। এই সাহস তো ছেলেদেরও নেই। এমনটা বোধ হয় সে স্বপ্নেও ভাবেনি। তাও আবার সুন্দরীর কাছে থেকে! বাকি ছেলেরাও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। আজকে যে কী হয়। শুকনা–পাতলা একটা মেয়ের এত সাহস!
নীনার বাবা চলে এসেছেন। মোটরসাইকেলের শব্দ কানে গেল। নীনা অপলাকে আস্তে আস্তে বলল, ‘চল যাই। এই টাইপের পাতি মাস্তানমার্কা ছেলের সাথে তর্ক করিস না।’ এ কথা বলে ব্যাগ নিয়ে এগোল নীনা। অপলাও এগোচ্ছিল।
ঠিক তখনই রবিন রাগের চোটে পাল্টা উত্তর দিল, ‘আমার ইচ্ছে আমি গান গাচ্ছি। তোমার সমস্যা হলে তুমি বের হয়ে যাও। তুমি আমাকে মানা করার কে? তুমি নিজেকে কী মনে করো? আয়নায় নিজেরে দেখো গিয়ে! আমাকে ঝাড়ি দিতে এসেছে।’
অপলার মেজাজ গেল আরও বিগড়ে। সেও ছেড়ে কথা বলার মতো মেয়ে নয়, ‘তোমার ইচ্ছা হলে তুমি তোমার বাসায় গিয়ে গান গাও, কনসার্টে গাও। এখানে কি তুমি গান গাইতে এসেছ? এইটা টিচারের বাসা। আর যে–ই না গলা!’
রবিনও পাল্টা বলে যাচ্ছে, ‘ক্লাস শেষ, সবাই চলেও গেছে। এখন আমি গান গাইব না নাচব, সেটা আমার ব্যাপার, তোমার তো মাথা ঘামানোর দরকার নেই। তোমাকে এখানে থাকতে বলছে কে?’
‘অভদ্র ছেলে। কোনো ম্যানার নেই’ বলে রাগে গজগজ করতে করতে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেল অপলা।
বাকি ছেলেগুলো মিনিটখানেক পরে বের হলো। রবিনের মেজাজ তখন পুরাই সপ্তমে। নিচে নেমে রাস্তায় এসে বিড়বিড় করছে, ‘আমারে ঝাড়ি দেয়। এই মেয়ে নিজেরে কী মনে করে? ওরে আমি এখনই ধরব। ও আমারে উত্তর দিয়ে যাবে।’
সামনে তাকিয়ে দেখে অপলা তখন রিকশা ঠিক করে মাত্র উঠছে। রবিন সোজা তেড়ে গিয়ে রিকশার হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়াল, ‘এই মেয়ে, তুমি কোন সাহসে আমার সাথে এভাবে ঝাড়ি দিয়ে কথা বললে? তুমি চেনো আমাকে? আমার ইচ্ছা গান গাব না যা ইচ্ছা তা করব, তোমার কী? আমি তো তোমাকে কোনো ডিস্টার্ব করিনি?’
দিনদুপুরে রাস্তায় রিকশা আটকে রবিনের এমন মারমুখী অভিব্যক্তি দেখে অপলা এই প্রথম একটু নরম হয়। বড় বড় চোখ আরও বড় করে বলল, ‘ক্লাসে বসে তুমি গান গাচ্ছিলে দেখে আমি মানা করছিলাম। ক্লাসে তো আমি আর নীনা ছাড়া কেউ ছিল না, তাই মানা করেছি। ঠিক আছে, এখন গাও যত খুশি।’
রবিনের মাথা তখনো গরম। সে বলল, ‘তুমি রিকশা থেকে নামো। উত্তর দিয়ে যাবা। নামো।’
অপলা খুবই অবাক চোখে রবিনকে দেখছে। সে বিস্মিত। মনে মনে ভাবছে, এই ছেলের এত সাহস হয় কী করে! পরে পস্তানি সামলাতে পারবে?
এদিকে বাকি তিনজন ছেলে অবাক হয়ে দেখছে। ঠিক কী থেকে কী হলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই এত কিছু হওয়া সারা। এখন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে রবিনকে টেনে সরিয়ে আনে মিঠু। রিকশাওয়ালাকে ইশারা দেয় আগে বাড়ার জন্য। অপলার ফরসা চেহারা রাগে, দুঃখে, কষ্টে আরও যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
রবিন সরে এলেও ওর রাগ যেন কমে না। গজগজ করতেই থাকে।
অপলা বাসায় ফিরে তার রুমের দরজা বন্ধ করে দিল। এতক্ষণ রাগে–দুঃখে মুখ ভার করে ছিল। এখন চোখের কোণে রাজ্যের পানি জমা হলো। সোজা বাথরুমের দরজা খুলে বেসিনের কল ছেড়ে পানির ঝাপ্টা দিল চোখেমুখে। মুখ তুলে আয়নায় তাকিয়ে দেখতে পেল কলের পানি আর চোখের পানির ধারা একাকার হয়ে নামছে।
এর পর থেকে ক্লাসে ঢুকলেই ওদের অলিখিত শত্রুতা শুরু। একজন আরেকজনের দিকে ফিরেও তাকায় না। একদম না। রবিন বসে পশ্চিম কোনায়, অপলা বসে পুব কোনায়। কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। (এমনকি এখনো তারা পূর্ব আর পশ্চিমেই থাকে)
১০ মিনিটের মধ্যে ঝগড়া শেষ। কিন্তু রেশ থেকে গেল জীবনভর।
এরপর এসএসসি পরীক্ষার সময় চলে এলো। আপার বাসার ক্লাস শেষ হয়ে গেল। সবাই যে যার মতো ছড়িয়ে পড়ল। তখন না ছিল ফেসবুক, না মোবাইলের যুগ। কেউ কারও আর খোঁজ পেল না।
ক্লাস নাইনের সেই কিশোরবেলার এক ঘটনা এমন দুজনের মাঝে ঘটল, যার সাক্ষী শুধু তিনজন ছেলে, যারা কেউ ভোলেনি।
এরপর অপলা একদমই হারিয়ে গেল, কোথাও পাওয়া যায়নি তাকে। কিন্তু সবার মনে থেকে গেল। সবচেয়ে বেশি থেকে গেল বোধ হয় রবিনের। কারণ, এর পর থেকে সে শুধু অপলাকেই খুঁজে বেড়েয়েছে—এখানে, সেখানে, সবখানে।
পরে বহু বছর এটা নিয়ে রবিনকে মিঠু পচিয়েছে—‘তোর মতো একটা ডানপিটে ছেলেকে একটা শুকনা–পাতলা মেয়ে এভাবে ঝাড়ি দিল। তোর জীবনে এটাই মনে হয় প্রথম ঝাড়ি।’
রবিনও কম যায় না। বলল, ‘ঝাড়ি তো আমিও দিয়েছি।’
মিঠু বলল, ‘হ্যাঁ দিয়েছিস। কিন্তু সে আগে দিয়েছে। আর তোর ডোজ বেশি হয়ে গিয়েছিল।’
রবিন বলল, ‘মেয়েটার ঠিকানা দিবি, কোথায় থাকে? একদম মাথায় ঢুকে গেছে, কিছুতেই বের হয় না। কত যে খুঁজি, পাই না।’
মিঠু অবাক হয়ে বলল, ‘তুই খুঁজিস! ঝাড়িওয়ালিকে? আমি জানি না তো ঠিকানা। সে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আমিও তো খুঁজি অপালাকে।’
সময় নদীর মতো বহমান। কারও তোয়াক্কা না করেই সামনে এগোয়। কেউ কারও খোঁজ আর পায় না।
রবিন এখনো অপলাকে খুঁজছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, একদিন খুঁজে পাবেই অপলাকে। বিভিন্ন গ্রুপে, বিভিন্ন পেজে সে অপলা নামের মেয়ে দেখলেই জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি কি অমুক স্কুলের তমুক ব্যাচের সেই অপলা?’ উত্তর আসে, ‘না ভাই, আমি সে না।’ রবিন এরপরও খুঁজতে থাকে।
তাকে ঝাড়ি দেওয়ার সাহস যে মেয়ের আছে, তাকে তো মনে রাখতেই হবে, খুঁজে পেতেই হবে। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায়, সাদা ফিতা দিয়ে দুই বেণী করা, ঠোঁটের পাশে তিল, বেশ গভীর চোখের একটি ফরসা, হালকা–পাতলা মেয়ে, জুতা জোড়াও সাদা ছিল। কোথায় যে হারিয়ে গেল। রবিন জানে, একদিন খুঁজে পাবেই। শুধু জানে না কবে!
এভাবেই কেটে গেছে ২৫ বছর। হ্যাঁ, ২৫ বছর!
হঠাৎ একদিন সকালে মিঠুকে ফোন করে রবিন ঘুম ভাঙাল। বলল, ‘চল স্টার–এ গিয়ে নাশতা করি। অনেক দিন আড্ডা দিই না।’
মিঠু সময় ঠিক করে বলল, ‘আচ্ছা আসছি।’
নাশতা শেষে চা খেতে খেতে রবিন বলল, ‘অপলার কোনো খোঁজ পেয়েছিস?’
মিঠু বলল, ‘না। তবে শুনেছি, দেশে থাকে না বহু বছর। তুই এখনো অপলাকে খুঁজিস?’
রবিন বলে উঠল, ‘কখনো দেখবি, একঝাঁক পাখি এসে মাঠে বসে। ঘাস খুঁটায়, এদিক–ওদিক চায়। এর মাঝে হঠাৎ করে একটা পাখিতে তোর চোখ আটকে যাবে। এরপর পাখির ডানা, চোখ, পা, চাহনি—সবকিছু মনে গেঁথে যাবে। নিজে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মন লেগে যায়, মন পুড়ে যায়। ঠিক তখনই হুট করে ডানা ঝাপ্টা দিয়ে পাখিটা উড়ে যায়, ফেলে যায় মায়া...তীব্র মায়া। এরপর জীবনে অনেক পাখি আসে, যায়; কিন্তু ওই পাখি আর আসে না, মাথা থেকে যায় না। মায়ায় ছটফট করতে থাকে হৃদয়–মন, শান্তি লাগে না।’
রবিন এখনো খুঁজে বেড়ায় অপলাকে।
আর অপলা! থাক, কিছু ঘটনা যে না জানাই ভালো।
*লেখক: শায়লা জাবীন, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া