এআইয়ের ছোঁয়ায় কৃষির নবজাগরণ: সুইডেনের মাঠে ‘ছোট্ট বাংলাদেশ’ ও হৃদয়ের গল্প
একসময় কৃষি মানে ছিল প্রকৃতির ইচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া—ঘামে ভেজা শরীর, আকাশের মুখপানে চেয়ে থাকা, আর অনিশ্চয়তার সঙ্গে লড়াই। কিন্তু সেই চেনা দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। কৃষি এখন শুধু মাটি আর মানুষের গল্প নয়, এটি প্রযুক্তি, তথ্য এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্মিলনে গড়ে ওঠা এক বৈপ্লবিক অধ্যায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আজ শুধু ফসল ফলানোর পদ্ধতি বদলায়নি, বদলে দিয়েছে কৃষির স্বরূপ। এখন ডেটা বিশ্লেষণ বলে দেয় কখন বপন হবে বীজ, ড্রোন উড়ে দেখে জমির রোগ, সেন্সর জানায় জমির আর্দ্রতা, আর রোবট নিখুঁতভাবে তোলায় ফসল। এমনকি উপগ্রহ প্রযুক্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয় কখন নামবে বৃষ্টি, আর কবে ফসল তুললে মিলবে সর্বোচ্চ দাম।
এসব মিলিয়ে যে কৃষির আবির্ভাব ঘটেছে, তার নাম—স্মার্ট ফার্মিং। এটি শুধু আধুনিক কৃষির সংজ্ঞা নয়, এটি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য মিলে গড়ে তোলে টেকসই ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি।
এই কৃষিবিপ্লব শুরু হয়েছে উন্নত দেশগুলোয়, কিন্তু তার প্রতিধ্বনি পৌঁছে গেছে সুদূর উত্তর ইউরোপের সুইডেন পর্যন্ত। আর সেই প্রতিধ্বনির ভেতরেই বেজে উঠেছে আরেকটি গল্প—বাংলাদেশের শিকড় থেকে উঠে আসা এক হৃদয়ের চাষির গল্প, যে প্রযুক্তির মধ্যেও খুঁজে পায় প্রকৃতির সান্নিধ্য।
একসময় কৃষিকাজ মানেই ছিল কষ্টকর পরিশ্রম, প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার মুখোমুখি হয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। বীজ বপন, সেচ, রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ, ফসল কাটা—সবকিছুই ছিল অনুমাননির্ভর। কিন্তু এখন, সেই ঐতিহ্যবাহী চাষাবাদ রূপ নিচ্ছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এআই এখন কৃষির নীরব বিপ্লবের প্রধান চালিকা শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রে, এআইচালিত ট্রাক্টর ও ড্রোন কৃষকদের হয়ে জমি চষে, সেচ দেয়, কীটনাশক ছিটায়। নেদারল্যান্ডসে রোবোটিক গ্রিনহাউস ও মেশিন লার্নিং-চালিত পূর্বাভাসব্যবস্থার মাধ্যমে শাকসবজির উৎপাদন বাড়ছে। চীন ও ইসরায়েল নিজেদের সীমিত ভূমিকে সেন্সর ও ডেটাচালিত ব্যবস্থায় রূপান্তর করেছে সর্বোচ্চ উৎপাদনশীল চাষের মডেলে।
ভারতও স্মার্ট ফার্মিংয়ের দিকে দ্রুত এগোচ্ছে—এআইভিত্তিক মোবাইল অ্যাপে কৃষকেরা আগাম জানতে পারছেন আবহাওয়ার পরিবর্তন, রোগের আক্রমণ, এমনকি ফসল বিক্রির মেয়াদকালও।
এআই এখন শুধু জমির উর্বরতা বিশ্লেষণ করে না, বরং উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে জমির স্বাস্থ্য নির্ধারণ করে, ডেটা বিশ্লেষণ করে জানিয়ে দেয় কোন এলাকায় কোন ফসল বেশি লাভজনক, ড্রোন দিয়ে নজরদারি চালিয়ে কীটপতঙ্গ শনাক্ত করে এবং রোবট দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে ফসল তোলার কাজও করে।
এসব প্রযুক্তির সম্মিলনে গড়ে উঠছে এক নতুন কৃষিব্যবস্থা—স্মার্ট ফার্মিং—যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে নেওয়া হচ্ছে এবং প্রতিটি পদক্ষেপেই নিশ্চিত হচ্ছে সময় ও সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার।
এটি শুধু উৎপাদন বাড়ানোর কথা নয়—এটি ভবিষ্যতের টেকসই কৃষি গঠনের রূপরেখা, যেখানে খাদ্যনিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং কৃষকের অর্থনৈতিক মুক্তি একসূত্রে গাঁথা।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে ১৮ কোটির বেশি মানুষ অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে বসবাস করছে, সেখানে প্রতি ইঞ্চি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারে খাদ্য উৎপাদন করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এর ওপর ঘন ঘন বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব কৃষিকে করে তুলেছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
আরও বিপদ হলো দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাপনা ও বিষময় খাদ্য উৎপাদনের ভয়াবহ প্রবণতা। কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে না পারা, নকল সার-বীজ, বিষাক্ত কীটনাশক, ভেজাল খাদ্য—সবকিছু মিলে খাদ্যনিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য দুটিই আজ হুমকির মুখে।
এই পটভূমিতে বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর কৃষিব্যবস্থা আর বিলাসিতা নয়—এটি এখন সময়ের দাবি, জাতীয় অগ্রাধিকারের প্রশ্ন। এআইচালিত স্মার্ট ফার্মিং শুধু আধুনিক কৃষিকাজ নয়, এটি গোড়া থেকে কৃষিব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের এক ঐতিহাসিক সুযোগ।
বিশ্বব্যাপী স্মার্ট ইন্টেলিজেন্ট সিস্টেমে রূপ নিচ্ছে কৃষি। সেন্সর জমির উর্বরতা পরীক্ষা করে বলে দিচ্ছে কখন, কতটুকু সেচ প্রয়োজন। ডেটা অ্যানালিটিকস বোঝাচ্ছে কোনো অঞ্চলে কোন ফসল লাভজনক এবং রোগপ্রতিরোধী। ড্রোন ও রোবট ব্যবহার করে কীটনাশক প্রয়োগ ও ফসল তোলা হচ্ছে সুনির্দিষ্টভাবে, অপচয় ছাড়াই।
উপগ্রহ প্রযুক্তি আগাম বন্যা বা খরার পূর্বাভাস দিয়ে কৃষকদের বিপদ থেকে রক্ষা করছে। এমনকি এআই এখন বাজারে ফসলের চাহিদা ও দাম পূর্বাভাস দিয়ে কৃষককে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছে—কবে ফসল বিক্রি করলে লাভ বেশি হবে।
এই পরিবর্তন শুধু জমিতে ফসল ফলানোর পদ্ধতি নয়, কৃষকের জীবনধারাও বদলে দিচ্ছে। বুদ্ধিমান প্রযুক্তির সহায়তায় উৎপাদন বাড়ছে, খরচ কমছে এবং কৃষক তার পেশাকে আবার সম্মানের চোখে দেখতে পারছেন।
বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে কৃষিই সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান, সেখানে এআই–নির্ভর কৃষি মানে শুধু খাদ্য উৎপাদন নয়—এটি দারিদ্র্য হ্রাস, স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো এবং টেকসই অর্থনীতি গঠনের অন্যতম ভিত্তি।
এই অগ্রগতি আমাদের জন্য শুধু সম্ভব নয়, বরং একান্ত প্রয়োজনীয়। একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের কৃষিকে আর পেছনের পথ ধরে চলা চলবে না। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে—তথ্য, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের আলোকে—আমাদের পথ বেছে নিতে হবে।
কৃষিকে শুধু একটি পেশা হিসেবে দেখা যথেষ্ট নয়—এটি আমাদের অস্তিত্ব, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ভিত্তি। তাই একে নতুন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বুদ্ধিমত্তা ও মানবিকতার সমন্বয়ে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের কৃষকদের হাতে ডিজিটাল প্রশিক্ষণ, ডেটাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং সরকারি সহায়তায় সহজলভ্য স্মার্ট যন্ত্রপাতি তুলে দেওয়া এখন জরুরি। প্রযুক্তি যতই থাকুক, যদি কৃষক তাঁর উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পান, তবে সব উন্নয়নই বৃথা।
মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য রোধ করে সরাসরি কৃষক-বাজার সংযোগ, অনলাইন মার্কেটপ্লেস ও কৃষিপণ্যের ফেয়ার প্রাইস মডেল গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
একটি টেকসই কৃষিব্যবস্থায় নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ ও যন্ত্র ব্যবহারে সুবিধা নিশ্চিত করা এবং কৃষক পরিবারগুলোর জন্য স্বাস্থ্যসেবা, শিশুশিক্ষা ও আবাসন নিশ্চিত করাই হবে প্রযুক্তির টেকসইত্ব রক্ষা করার প্রধান শর্ত।
সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, কৃষি খাতকে ‘চিরকালীন সমস্যা’ হিসেবে দেখার পরিবর্তে একে জাতীয় সম্ভাবনার খাত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। পরিকল্পিত বাজেট, দুর্নীতিমুক্ত নীতি ও ফলাফলনির্ভর বাস্তবায়ন ব্যবস্থা ছাড়া কোনো সংস্কার টিকবে না।
প্রযুক্তি আমাদের হাতে শক্তি দিয়েছে, বুদ্ধিমত্তা দিয়েছে, কিন্তু মাটি চাষের অন্তর্নিহিত স্নেহ—তা আসে হৃদয় থেকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জমিতে সূক্ষ্মতা আনতে পারে, ফসলের পূর্বাভাস দিতে পারে, কিন্তু একটি ধনেপাতাগাছের গন্ধে শৈশব খোঁজার অনুভব—তা কখনোই কোনো যন্ত্র জানে না।
আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক সন্ধিক্ষণে—একদিকে বিষ, প্লাস্টিক, ভেজাল আর দুর্নীতির শিকড়গাঁথা খাদ্যব্যবস্থা; অন্যদিকে প্রযুক্তি, প্রকৃতি ও দায়িত্ববোধের এক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।
এই বাংলাদেশে যেখানে ১৮ কোটি মানুষ একমুঠো বিশুদ্ধ খাবারের জন্য লড়ছে, সেখানে কৃষিকে আর ‘গ্রামীণ পেশা’ হিসেবে দেখার সময় নেই—এটি এখন মুক্তির কৌশল, বাঁচার বিজ্ঞান।
যখন সারা বিশ্বে প্রযুক্তি কৃষিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে, আমি নিজেও সামারে সুইডেনের মাঠে ছোট্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি: আমার হাতে উৎপাদিত কৃষি ও হৃদয়ের গল্প সূর্যের আলো আর বৃষ্টির ছোঁয়ায়—প্রবেশ করেছি কৃষির এক নতুন অধ্যায়ে।
কয়েক বছর ধরে আমি নিজ হাতে চাষ করেছি বাংলাদেশের পরিচিত সবজিগুলো—পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, বেগুন, পালংশাক, পুঁইশাক, ধনেপাতা, লালশাক, শিম, গাজর, কপি, আলু, লাউ, কুমড়া—যা একসময় মনে হতো অসম্ভব।
কিন্তু এখন:
• এআই–নির্ভর আবহাওয়া বিশ্লেষণ,
• সময় ও তাপমাত্রাভিত্তিক বীজ বপন পদ্ধতি,
• জমির মান অনুযায়ী সার প্রয়োগের গাইডলাইন,
এসব প্রযুক্তির সহায়তায় অসম্ভবকে সম্ভব করা গেছে।
তবে শুধু প্রযুক্তি নয়—এই অভিজ্ঞতা ছিল আমার শিকড়ের সঙ্গে এক আত্মিক সংযোগ। প্রবাসে থেকেও মাটির গন্ধ, স্মৃতির লালশাক, ধনেপাতার সুবাস—সব ফিরিয়ে এনেছে হৃদয়ের ভেতর।
তাই আমাদের ফিরে যেতে হবে মাটির কাছে—কিন্তু এবার শুধু গাঁয়ের ইছামতী বিলের পথ দিয়ে নয়, ফিরতে হবে স্যাটেলাইটের চোখ, সেন্সরের স্পর্শ, আর ডেটার আলো হাতে নিয়ে।
চলো নতুন এক প্রতিজ্ঞায় শপথ করি—
যেখানে কৃষক হবেন একেকজন মাটির বিজ্ঞানী,
শাকসবজি হয়ে উঠবে সুস্থতা ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি,
আর প্রযুক্তি ও প্রকৃতি মিলেমিশে গড়ে তুলবে এক নতুন সভ্যতা—সবুজ, টেকসই, মানবিক।
এটি শুধু প্রযুক্তির নবজাগরণ নয়—
এটি এক নৈতিক বিপ্লব।
যেখানে আমরা শিকড়কে আবার ছুঁয়ে দেখি,
ভালোবাসার গন্ধে ভরে তুলি জমিন,
এবং ভবিষ্যতের দিকে হাঁটি—মাথা উঁচু করে।
প্রযুক্তি নিখুঁত করে—
কিন্তু হৃদয়ই গড়ে তোলে সেই ফসল,
যার নাম—ভবিষ্যৎ।
* লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন [email protected]
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]