বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ: সময়ের দাবি, দায়িত্বের ডাক
বিশ্ব বাস্তবতায় নতুন চাহিদা। বিশ্ব এখন আর আগের মতো নেই। প্রতিনিয়ত অস্থিরতা, সংঘাত, দুর্নীতি আর নেতৃত্বহীনতার মাঝে আমরা এগোচ্ছি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। অথচ আমরা জানি, ভালো কোনো কিছু দ্রুত শিখি না, কিন্তু পৃথিবীর কোথায় কী ভুল হচ্ছে, তা খুব দ্রুত জানি। এই শেখার ঘাটতি আর নৈতিক শিক্ষার অভাব আমাদের তরুণ প্রজন্মকে অনিশ্চয়তা, আত্মবিশ্বাসহীনতা ও শৃঙ্খলার সংকটে ঠেলে দিচ্ছে। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং সময়ের দাবি।
সুইডেনের বাস্তবতা: শান্তির দেশেও প্রস্তুতির ডাক
১৯০১ সালে সুইডেন সিদ্ধান্ত নেয়, ১৮ বছর পূর্ণ হলে প্রত্যেক নাগরিককে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে। শারীরিক বা মানসিক কারণে কেউ উপযুক্ত না হলে তাঁকে ছাড় দেওয়া হয়। এই প্রশিক্ষণ তিন মাসের বেসিক ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে শুরু হয়ে এক বছরের বেশি সময় চলতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে ৬১৫ দিন পর্যন্ত।
২০১০ সালে এই বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হলেও ২০১৭ সালে তা আবার চালু করা হয়, এবার নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই।
সুইডেন শান্তির দেশ, তবু কেন এই সিদ্ধান্ত?
উত্তর একটাই, রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা, সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা এবং জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করা। এ প্রশিক্ষণ কেবল যুদ্ধের জন্য নয়, জীবনের জন্য প্রস্তুতির পাঠশালা।
একই ছাদের নিচে দুই বাস্তবতা: জনাথান বনাম জেসিকা
এই বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের প্রভাব আমি শুধু রাষ্ট্রীয় নীতি দিয়ে নয়, নিজের পরিবার দিয়েই উপলব্ধি করেছি। আমার ছেলে জনাথান ও মেয়ে জেসিকা, দুজনই সুইডেনে বড় হয়েছে। কিন্তু তারা পেয়েছে দুই ভিন্ন বাস্তবতা। জনাথানের সময় (২০১০–১৭) সুইডেনে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ স্থগিত ছিল। ফলে তার সেই প্রস্তুতিমূলক অভিজ্ঞতা হয়নি। অন্যদিকে যখন জেসিকা ১৮ বছর বয়সে পৌঁছল, তখন সুইডিশ সরকার আবার বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ চালু করে। একদিন তার কাছে সামরিক নিয়োগ কর্তৃপক্ষের চিঠি এল—অনলাইনে ফরম পূরণ করতে হবে, মেডিকেল পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, পরে নির্ধারিত সময়ে প্রশিক্ষণে যোগ দিতে হবে।
প্রথমে তার চোখে ছিল অবাক হওয়ার প্রতিক্রিয়া—হঠাৎ যেন জীবনের চেনা গতি রুদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র একটি দায়িত্ব তুলে দিল কাঁধে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আমি জেসিকার চোখে যে বদল দেখলাম, তা অবিশ্বাস্য। সে আগের চেয়ে আত্মবিশ্বাসী, সময়নিষ্ঠ, দায়িত্ববান হয়ে উঠল। নিজের শরীর, মন, সময়—সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখার অভ্যাস গড়ে উঠল।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
জনাথানও দেশপ্রেমিক, ছোটবেলা থেকে খেলাধুলার মাধ্যমে সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে। কিন্তু আমি দেখেছি, রাষ্ট্র যদি নাগরিকের কাছে শুরুতেই বলে, ‘তুমি আমার, আমি তোমার’, তাহলে সেই বন্ধনটা হয়ে ওঠে গভীর, হৃদয়স্পর্শী।
একই পরিবারের দুই সন্তান, কিন্তু রাষ্ট্রীয় অংশগ্রহণে গড়ে ওঠার ধরন একেবারেই আলাদা। জেসিকার মুখে আমি শুনেছি এক গভীর উপলব্ধির কথা, ‘বাবা, আমি চাই না এই দেশ কখনো যুদ্ধের মধ্যে পড়ুক। কিন্তু যদি পড়ে, তাহলে আমাকেও তো প্রস্তুত থাকতে হবে।’
এই এক বাক্যেই আমি উপলব্ধি করেছি, বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ কেবল শারীরিক কসরত নয়, এটা আত্মার ভিত তৈরি করে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা: প্রস্তুতি ছাড়া ভালোবাসা অর্থহীন
আমরা কর্মক্ষেত্রে, মঞ্চে, এমনকি সরকারি প্রশিক্ষণকেন্দ্রেও মুখে বলি, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ কিন্তু ভালোবাসা কি কেবল সুরেই সীমাবদ্ধ থাকবে? যদি সেই প্রিয় দেশ একদিন বিপদের মুখে পড়ে, তাহলে কি শুধুই গান গেয়ে তা রক্ষা করা যাবে?
১৯৭১ সালে আমরা শত্রুর মুখোমুখি হয়েছিলাম। কেউ লড়েছে, আবার কেউ ভয়ে পালিয়েছে। কেউ রাজাকার হয়েছে, কেউ শহীদ হয়েছেন। যদি সবার মধ্যে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ থাকত, তাহলে কি সেই চিত্রটা ভিন্ন হতো না?
আমি বিশ্বাস করি, জীবনের শুরুতেই যদি একজন নাগরিক দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, তাহলে সে কখনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বেইমানি করতে পারে না। দুর্নীতি কমে, আত্মবিশ্বাস বাড়ে, শৃঙ্খলা আসে—আর সবচেয়ে বড় কথা, একটি দায়িত্বশীল প্রজন্ম গড়ে ওঠে।
উপসংহার: সময় এসেছে সাহসী সিদ্ধান্তের, বিশ্ব এখন আর নীতিতে চলে না, চলে শক্তির ভাষায়। ‘জোর যার, মুল্লুক তার’—এই বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশেরও প্রয়োজন প্রস্তুতি।
তাহলে আমরা কেন এখনো পিছিয়ে?
আমাদের তরুণদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ কেবল প্রয়োজন নয়, এটা একটি নৈতিক পুনর্জাগরণের ভিত্তি। এটা হবে নেতৃত্ব তৈরির, জাতীয় ঐক্য গঠনের, আত্ম-পরিচয় নির্মাণের এক ঐতিহাসিক সুযোগ।
আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশ কি প্রস্তুত নয় এই সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য?
পরিশিষ্ট: এবার আপনার কথা বলার পালা। এই লেখা কেবল একটি ভাবনার সূচনা। কিন্তু ভবিষ্যৎ নির্মাণ শুধু লেখক নয়, পাঠকেরও দায়িত্ব।
তাই প্রশ্ন রাখছি আপনার কাছে—
আপনি কি চান না, বাংলাদেশের প্রতিটি তরুণ শিখুক—কীভাবে নিজের জন্য নয়, দেশের জন্যও গড়ে উঠতে হয়? আপনি কি চান না, এই প্রস্তাব সংসদে উঠুক, মিডিয়ায় আলোচনা হোক, জাতীয় বিতর্ক তৈরি হোক?
তাহলে এখনই সময়, এই লেখাটি শেয়ার করুন, মত দিন, বিতর্ক শুরু করুন।
কারণ, যদি আপনি না বলেন, তবে কে বলবে?
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]