ভিক্ষাবৃত্তি

ফাইল ছবি

আমি দেশ ছেড়েছি দুই যুগ আগে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পড়াশোনা শেষ করে চলে এসেছি। কুইন্সল্যান্ডের গোল্ডকোস্ট শহরে। এখানেই শিকড় গেড়েছি দেড় যুগ হয়ে গেল। দুই ছেলের জন্ম এই শহরেই। বড় হয়ে গেছে ওরা, ১৫ আর ১০ বছর বয়স যথাক্রমে। এ শহরে খুব বেশি বাংলাদেশি নেই, সব মিলিয়ে হাজারখানেক হবে। পর্যটকের শহর বলেই পরিচিত সবার কাছে। খুব সুন্দর, পরিচ্ছন্ন আর ছিমছাম। এখানে বাস্তুহীন অথবা ভিক্ষুক নেই বললেই চলে। কদাচিৎ চোখে পড়ে দুই একজন বাস্তুহারা বা হোমলেস লোক শহরের সাউথপোর্ট অথবা সার্ফারস প্যারাডাইস এলাকায়। সাধারণত পথের পাশে অথবা কোনো দোকানের সামনে চুপচাপ বসে থাকাই এঁদের কাজ। সামনে হয়তো একটা টিনের কোটা অথবা কাগজের বাক্স পড়ে থাকে। পথিকেরা কেউ কেউ দু–একটা কয়েন অথবা নোট ফেলে দিয়ে যান পথ চলতে গিয়ে। কাউকে সাধারণত বিরক্ত করেন না এই বাস্তুহারা লোকেরা। এই শহরের বেশির ভাগ মানুষ অবস্থাসম্পন্ন অথবা ছিমছাম পর্যটক। অবস্থাসম্পন্ন বলতে বোঝাচ্ছি যে মোটামুটি সবারই মাথা গোজার ঠাঁই আছে, ঘরে খাবার আছে, বিনোদনের জন্য টিভি আছে, গরমে ঠান্ডা হওয়ার জন্য মাথার ওপর ফ্যান অথবা শীতাতপনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা আছে, খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ আছে, যাতায়াতের জন্য গাড়ি আছে, আরও আছে সরকারের কাছ থেকে ফ্রি চিকিৎসাব্যবস্থা। আর কী চাই? শহরের প্রাণকেন্দ্র হলো সার্ফারস প্যারাডাইস, সেখান থেকে ১৫–২০ মিনিটের গাড়ি চালানো দূরত্বে আমাদের বাসস্থান। আমাদের খুব একটা যাওয়া হয় না শহরে।

শহর থেকে একটু দূরেই, অক্সেনফোর্ড সাবার্বে থাকি আমরা। এখানে একেকটি পাড়া অথবা মহল্লাকে সাবার্ব বলেই চিনে সবাই। আমি আমার পরিবারের সবাইকে নিয়ে মাসে–দুই মাসে একবার যাই ইনালা নামক ব্রিসবেন শহরের কাছাকাছি এক সাবার্বে। সেখানে যাওয়া হয় মূলত বাংলাদেশি দোকান থেকে দেশীয় মাছ, মসলা অথবা ভিয়েতনামিজ শপিং সেন্টারে তাজা শাকসবজি কেনার জন্য। ইনালা শপিং সেন্টারের প্রবেশপথেই এক হোমলেস অথবা বাস্তুহারা লোককে প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়। আমার দুই ছেলেই সেটা লক্ষ্য করেছে বহুবার। গাড়ি থেকে নামার আগেই তাই দুজনেই আমার কয়েন বাক্স থেকে পয়সা হাতে নিয়ে সঙ্গে রাখে। প্রবেশপথেই মাছের দোকান। আমার সঙ্গে মাছের দোকানে খুব একটা প্রবেশ করে না ওরা। কিন্তু আমি ভেতর থেকে লক্ষ্য করে দেখেছি, দুই ভাই একসঙ্গে হোমলেস ওই ভিখারিকে গাড়ি থেকে নিয়ে আসা কয়েনগুলো দিতে। কয়েন দেওয়ার পর দূর থেকে মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থেকে দুজনেই খুব খুশি হয় বাস্তুহারার নীরব হাসি দেখে। আমার দুই পুত্রের হৃদয়ের মহত্ব আমারও ভালো লাগে খুব। গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম ব্রোঞ্জার আগে টুকিটাকি বাজারসদাই করতে। এবার আর ওই হোমলেস বা বাস্তুহারাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। দুই ছেলেই একটু হতাশ হলো, আবার মনে মনে খুশিও হলো অনেক এ ভেবে যে নিশ্চয়ই লোকটার কোনো একটা সুব্যবস্থা হয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করে ফেলল, ‘বাবা, ওই লোকটা কি বাড়ি খুঁজে পেয়েছে?’ আমি জবাব দিলাম, ‘খুব সম্ভবত ওকে কোনো হোমলেস শেল্টার এ নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ ছেলেরা আনন্দচিত্তে বাকি সময় আমার সঙ্গে বাজারে ঘুরে বাসায় চলে এল।

গত বছর জুলাই মাসে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে কয়েক সপ্তাহের ছুটি কাটাতে। এবার ছুটিতে বেশির ভাগ সময় কেটেছে নিজের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। একদিন সকালবেলা দুই ছেলেকে নিয়ে আমার শ্বশুরবাড়ি; অর্থাৎ বাচ্চাদের নানাবাড়ি মুন্সিগঞ্জে যাচ্ছিলাম। যাত্রাপথে শহরের চাষাড়া থেকে কিছু খাবারদাবার কেনার জন্য থামলাম। গাড়ি পার্ক করতে বললাম আমাদের ড্রাইভার শাহ আলমকে ঠিক সোনালি ব্যাংকের সামনের পার্কিংয়ে। সকাল নয়টা বাজে মাত্র, কিন্তু শহরে গাড়ি আর লোকজনের ভিড় প্রচণ্ড। ভিড় দেখে আর খুব গরম থাকায় ওদের আর গাড়ি থেকে নামতে বলিনি। দুই ছেলেকে গাড়িতে রেখে আমি খাজা মার্কেটের নিচে থেকে মিষ্টি কিনছিলাম। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি প্যাকেট করার অর্ডার দিচ্ছিলাম। হঠাৎ খুব ছোট একটা ৮–৯ বছরের ছেলে আমার পিঠে হালকা টোকা দিল। আমি ফিরে তাকাতেই খুব করুন চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে একটা মিষ্টি কিনে দেবেন? অনেক দিন মিষ্টি খাইনি।’

আমি তাকিয়ে থাকলাম ছেলেটির দিকে আর মনে হলো, সত্যি কথা বলছে। আমার ছোট ছেলের বয়সী হবে। আমার ছেলেদের জোর করেও সহজে একটার বেশি দুটি মিষ্টি খাওয়ানো যায় না, আর এই ছেলে বলছে সে অনেক দিন মিষ্টি খায়নি। জানি না, কী ভাবলাম তখন। দোকানদারকে বললাম, এ ছেলেকে ওর পছন্দমতো সব মিষ্টির প্যাকেট করে দাও। তারপর ওই ছেলেকে বললাম, ‘তোমার যেই মিষ্টি খেতে ইচ্ছা করছে বলো, এ দোকানদার প্যাকেট করে দেবে।’ সে খুব উৎসাহ নিয়ে চার প্রকারের মিষ্টি পছন্দ করল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আরও কিছু ভালো লাগলে বলো।’ কিন্তু সে শুধু চারখানা মিষ্টি নিয়েই মহাখুশি। ওর খুদে মুখের খুশি দেখে আমার ভেতরটাও আনন্দে ভরে গিয়েছিল। ছোট ছেলেটি মিষ্টি নিয়ে একটু দূরে দাঁড়ানো এক নারীর সামনে খুব উত্তেজিত হয়ে মিষ্টির বাক্স দেখাল। খুব সম্ভবত ছেলেটির মা হবেন। দুজনের প্যাকেট খোলার ব্যস্ততা দেখে আমি আর দাঁড়ালাম না। আমার মিষ্টির বাক্সগুলো নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। এরপর গাড়িতে ফিরে এসে দেখি, গাড়ির চারপাশে ভিক্ষুকের ভিড়। ড্রাইভার তাঁদের সরিয়ে আমাকে গাড়িতে বসার দরজা খুলে দিল। আমাদের যাত্রা শুরু হওয়ার পর দেখলাম, বড় ছেলে আমার দেওয়া ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বসে আছে। ব্যাগে আমি টাকা রেখেছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘গরিবদের জন্য টাকা খুঁজছিলে?’ একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না কাকে দেব আর কত দেব।’ আমি মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা দুই ভাইয়ের হাতে দিয়ে বললাম, ‘সামনে আরও ভিক্ষুক দেখতে পাবে, তাঁদের দিয়ো।’ দুই ভাই খুব আগ্রহের সঙ্গে গাড়ির দুই জানালায় চেয়ে পুরোটা পথ পারি দিল নানাবাড়ি যেতে যেতে। কিন্তু অবাক ব্যাপার, সেদিন আর কোনো অভাবগ্রস্ত ভিখারি চোখে পড়েনি। দুজনেই একটু মন খারাপ করেছিল। আমি সান্ত্বনা দিয়েছি এই বলে যে ‘যাওয়ার পথে কাউকে না কাউকে পেয়ে যাবে। আমাদের দেশে সবকিছুর অভাব থাকলেও, ভিক্ষুকের অভাব নেই।’

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর শিক্ষা—কোরো না ভিক্ষা। স্কুলজীবনে সেটাই শিখেছিলাম। দেশের ভিক্ষুক শ্রেণির অধিকাংশ কোনো কাজকর্ম করার চেষ্টাই করে না, ঠিক যেন অস্ট্রেলিয়া অথবা আমেরিকার হোমলেসদের মতো। অথচ এঁরা চাইলেই কাজের কোনো অভাব হবে না। উন্নত দেশগুলোর সরকার অথবা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যায় এঁদের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বাসস্থান আর চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। আর আমাদের দেশের মানুষগুলো তাঁদের ভিক্ষা করার স্বাধীন জীবন ছেড়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করার কথা চিন্তাও করেন না কখনো। সরকার সেখানে চেষ্টা করার বৃথা চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছে। যিনি নিজেকে বদলাতে চান না, তাঁকে স্বয়ং বিধাতাও বদলান না। অস্ট্রেলিয়াতে যাঁরা শারীরিক অথবা মানসিকভাবে আংশিক অথবা সম্পূর্ণ অক্ষম, যাঁরা কানা, খোঁড়া, লেংড়া, লুলা অথবা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী, তাঁদের সবাইকেই সরকার একটা ভাতা দেয়। পাক্ষিকভাবে সবার অ্যাকাউন্টে সেই ভাতা জমা হয়ে যায়। দৈনন্দিন জীবন যাপনের জন্য সেটা যথেষ্ট। তবু সবাইকেই আরও বিভিন্ন রকমের সহায়কমূলক ট্রেনিং দেওয়া হয় স্বাবলম্বী হয়ে কাজ খুঁজে নেওয়ার জন্য। আর আমার সোনার দেশ বাংলাদেশে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকেও অন্ধ, কানা, পঙ্গু করে দেওয়া হয়, অ্যাসিড ঢেলে ঝলসে দেওয়া হয় ভিক্ষাবৃত্তি করার জন্য। দেশে যদি ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হতো, তাহলে অর্ধেক জনসংখ্যা নিজেদের বিকলাঙ্গ করে ফেলত সেই ভাতা নেওয়ার জন্য। একটু কষ্ট করলেই কিন্তু চাকরি জুটে যায়, খাবার জুটে যায় অথবা বাসস্থানও জুটে যায়। কিন্তু মানসিকভাবে এমন জাতিকে কে শেখাবে যে ইচ্ছা না করলে সুন্দর আর স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায় না। শুধু মনের ইচ্ছাটাই পারে অনেক কিছু গড়ে দিতে আর এক বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসতে।

আমি বসে আছি সেই পরিবর্তন দেখার আশায়। আমি না দেখলেও, আমার সন্তানের যেন দেখে যেতে পারে সেই পরিবর্তন।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]