প্রবাসীর পলাতক জীবন

কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা।ছবি: প্রথম আলো

বিদেশ আসলে বেড়ানোর জন্য। তবে বয়স চল্লিশের কোঠা পেরিয়ে গেলে মনে হয় সেটাও খুব বেশি জরুরি নয়। নিজের দেশ, সে দেশের মানুষকেই আমরা চিনি না, জানি না ঠিকঠাক; সে ক্ষেত্রে বিদেশভ্রমণ আসলে নিতান্তই বিলাসিতা। এর পরও আমরা বিদেশে পাড়ি দিই। একেবারে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার নানা উপায় খুঁজে বের করি। এর অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে একটা হলো, আমরা সৃষ্টির সেই আদি থেকেই যাযাবর। আদিম কালে মানুষ খাবারের সন্ধানে, নিরাপত্তার জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর হতো। সেটা হয়তো–বা জিনগতভাবে আমরা আমাদের রক্তে বয়ে বেড়াচ্ছি। আরেকটা কারণ হতে পারে, একটা সুরক্ষিত জীবনের হাতছানি। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই সময়ে পৃথিবীর সব তথ্যই এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। আমাদের চোখের সামনে উন্নত দেশগুলোর মানুষের চাকচিক্যময় জীবনাচার উন্মুক্ত। আমরা দেখি আর হাপিত্যেশ করি। আহা, এমন একটা জীবন যদি পাওয়া যেত, যেখানে কোনো কিছুর অভাব নেই, পাশাপাশি আছে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা। এই আকাঙ্ক্ষা আমাদের প্রবাসী হতে ইন্ধন জোগায়।

প্রবাসে এসে পাকাপাকিভাবে থেকে যাওয়াটা আমার কাছে বরাবরই পলাতক জীবন বলে প্রতীয়মান হয়। আমরা দেশের দুঃশাসন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির পাশাপাশি আর্থিক ও সামাজিক অনিশ্চয়তা থেকে পালিয়ে বাঁচতেই আসলে প্রবাসী হই। কোনো মানুষ দেশে সামাজিকতার বিধিনিষেধের কারণে যে কাজ করতে লজ্জা পান, একই মানুষ বিদেশের মাটিতে সেই কাজ অবলীলায় করেন। কারণ, বিদেশে কাজের মধ্যে কোনো সামাজিক বৈষম্য নেই। এখানে সব কাজই কাজ। আর সব কাজেরই মজুরি কাছাকাছি। ফলে জীবিকা নির্বাহের জন্য যেকোনো কাজই করা যায়। সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ যাঁরা দেশে তেমন কিছুই করতে পারতেন না, তাঁরাও বিদেশে এসে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে ঠিকই অর্থনীতির শক্ত খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে যান। এরপর তাঁদের বুকের মধ্যে দেশের জন্য ভালোবাসা তৈরি হতে থাকে। প্রবাসের শুরুর দিনগুলোর কঠিন সময়েও এই ভালোবাসাটা তাঁদের মনের মধ্যে থাকে, তবে সেটা প্রকাশের সুযোগ পান না। কারণ, তখন চলে প্রবাসের নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার নিরন্তর সংগ্রাম।

একবার দেশের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়ে গেলে বাকি জীবন তাঁদের কেটে যায় দেশে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিচারণা করে। দেশের প্রতি তখন অনেক কারণেই ভালোবাসা তৈরি হয়। প্রথমত প্রবাসের প্রতিষ্ঠিত, সুরক্ষতি ও স্বাবলম্বী জীবন খুবই নিস্তরঙ্গ। এখানে তেমন কোনো চড়াই–উতরাই থাকে না। বছরের প্রতিটি দিন একই রকম। যাকে সোজা বাংলায় বলে একঘেয়ে। সেখানে বৈচিত্র্যের লেশমাত্র থাকে না। ইচ্ছাকৃতভাবে যে বিনোদনের সুযোগগুলো তৈরি করা হয়, সেগুলোয়ও কোনো ঝুঁকি না থাকায় তা আর নতুন কোনো আনন্দময় অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরা দেয় না। অবশ্য প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্ম জন্মের পর থেকেই যেহেতু এখানে বড় হয়, তাই তাদের হিসাব আলাদা। প্রবাসী প্রথম প্রজন্মের জন্য তখন একমাত্র বিনোদনের বিষয় হয়ে ধরা দেয় দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি থেকে শুরু করে রাজনীতি, সরকার ইত্যাকার বিষয়।

দেশের দুর্নীতি ও রাজনীতি প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় বিনোদনের উৎস। বিদেশে তো অনেক ধরনের মানুষই পাড়ি দেন। তাঁদের মধ্যে একেবারে নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে সমাজের সব শ্রেণি–পেশার মানুষই আছেন। ছাত্র, রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব—সবাই সুরক্ষিত জীবনের আশায় প্রবাসী হন। কেউ আসেন সোজা পথে, মানে আইনগতভাবে সিদ্ধ পথে। আবার অনেকেই আসেন বাঁকা পথে। অবশ্য একবার বিদেশের পাসপোর্ট পেয়ে গেলে কে কীভাবে এসেছেন সেটা আর মুখ্য বিষয় থাকে না। অনেক রাজনীতিবিদ দেশে বিভিন্নভাবে টাকা উপার্জন করে সেই টাকায় ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। অনেক সরকারি আমলারা দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জন করা টাকায় স্ত্রী–সন্তান থেকে শুরু করে পারলে চৌদ্দগুষ্টিকে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। নিজেও একটা ভিসা করে রাখেন, যাতে যেকোনো সময় চলে আসতে পারেন। অনেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুখে যতই দেশপ্রেমের কথা বলুন না কেন, দিন শেষে তাঁরাও চান তাঁদের সন্তানদের জন্য একটা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

দেশে সুশাসনের অভাব। প্রবাসে বসে এটা নিয়ে খিস্তি না করলে কোনো প্রবাসীরই পেটের ভাত হজম হয় না। দেশে প্রতিদিনই নতুন নতুন ইস্যু তৈরি হয়, তাই আমরা কোনো ইস্যু নিয়ে বেশি দিন পড়ে থাকি না। একটার পর একটা নতুন ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গরম গরম স্ট্যাটাস প্রসব না করতে পারলে প্রবাসীরা যেন প্রসব যন্ত্রণায় ভুগতে থাকেন। দেশের ইস্যুর সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন মানুষও প্রবাসে বসে জ্ঞানগর্ভ স্ট্যাটাস দেন এবং বুঝিয়ে দেন, তিনি আসলেই আমাদের ছোটবেলায় পড়া ‘সবজান্তা দাদুর আসর’–এর দাদু। দেশের ইস্যুগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এভাবে স্ট্যাটাস প্রসব করা আমার কাছে সবচেয়ে বড় ভণ্ডামি বলে মনে হয়। কারণ, সেসব দাবি আদায়ে আসলে দরকার সত্যিকারের উপস্থিতি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাতি–ঘোড়া মেরে সেসব দাবি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তবে আধুনিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটা চাপ অবশ্য তৈরি করে। আর সেই চাপ থেকে দৃষ্টি সরানোর জন্য শাসকগোষ্ঠী একের পর এক ইস্যুও তৈরি করতে থাকে। তাই নতুন ইস্যুর চাপে পুরোনো ইস্যু তখন হারিয়ে যায়। বর্তমান যুগে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে সংবাদপত্রগুলো সামাজিক স্ট্যাটাসনির্ভর সংবাদ পরিবেশন করে বেঁচে আছে। পুরো দুনিয়াটাই আসলে এখন অপার্থিব ও মেকি হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মেকি জীবন নিয়ে এখানে বেশি আলোকপাত করব না। তবে এটা সর্বজনবিদিত যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর বাস্তবের জীবনের মধ্যে যোজন যোজন ফারাক বিদ্যমান।

প্রবাসে বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গালভরা বুলি আওড়ানো আসলে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ প্রবাদের সার্থক রূপ। কারণ, এই সামাজিক স্ট্যাটাস দেখে বাসায় পুলিশ এসে হাজির হবে না। কিন্তু এই একই মানুষ দেশে থাকলে হয়তো–বা এ অন্যায়টা মেনে নিতেন। কিন্তু প্রবাসের নিরাপদ স্থানে বসে যেহেতু তেমন কিছুই করার থাকে না, তাই এগুলো নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডা করেন। সর্বোচ্চ একটা মানববন্ধন করে সবাই মিলে চা–নাশতা খেয়ে বাসায় এসে নরম বিছানায় শুয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলেন, দেশটা রসাতলে গেল। যাঁরা প্রবাসে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন তাঁদের বেশির ভাগেরই দেশের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ থাকে না। কারণ, দেশে তাঁদের তেমন কেউই থাকেন না। যাঁরা থাকেন তাঁদের জন্য মাসকাবারি সামান্য টাকা পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। তাঁরা আসলে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বৈদেশিক আয়ের মূল উৎস নন। মূল উৎস হচ্ছেন শ্রমিক শ্রেণির প্রবাসীরা। যাঁরা সব আত্মীয়স্বজনকে ছেড়ে বিদেশে এসে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের রেমিট্যান্সের শক্ত ভিত তৈরি করেন।

প্রবাসীরা দেশের একটাই উপকার করে থাকেন, সেটা হলো দেশের জনসংখ্যার ওপর চাপ কমান। তাঁরা দেশের যেসব চাকরি ছেড়ে আসেন সেগুলোয় কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এসব প্রবাসী দেশ থেকে এমন পরিমাণ অর্থ গায়েব করে দেন, যেটা দেশের অর্থনীতির অনেক বড় ক্ষতিসাধন করে। শ্রমিক শ্রেণির প্রবাসীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশে টাকা পাঠান। আর দেশের ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ ও আমলারা সেই অর্থ অন্য পথে বিদেশে পাঠিয়ে সেখানে তাঁদের নতুন সাম্রাজ্য তৈরি করেন। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। জানি না এভাবে কত দিন চলবে। তবে সাধারণ অর্থে যাঁদের প্রবাসী হিসেবে ধরা হয়, তাঁরা এমন নন। তাঁরা বিদেশের মাটিতে এসে নিজের ভিত্তি নিজেই তৈরি করে নেন।

দেশ থেকে পালিয়ে, দেশের অভাবকে পেছনে ফেলে, দেশের সব সমস্যা থেকে গা বাঁচিয়ে বিদেশের মাটিতে সচ্ছল জীবনযাপন এলে তা দোষের কিছু নয়। আর বিশ্বায়নের এ যুগে সেটাই স্বভাবিক। কিন্তু দেশের সঙ্গে যোগাযোগটা রাখা জরুরি। কারণ, এই অভাগা দেশটাই আমাদের বিদেশের যোগ্য করে গড়ে তুলেছিল। তাই দেশের সমস্যা ও সম্ভাবনায় দেশের পাশে থাকাটা জরুরি, বিশেষ করে সংকটের সময়গুলোয়। গত কয়েক দিনের ঘটনায় প্রবাসীরা যেভাবে দেশের চলমান অবস্থার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন, সেটা আসলেই অনুকরণীয়। দেশের ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে এগিয়ে এসেছেন প্রবাসের সব শ্রেণি–পেশার মানুষ।

আমার খুবই অবাক লেগেছে প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্মের কথা ভেবে। তারা বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে দেশের খবর পড়েছে এবং সে বিষয়ে অভিভাবকদের কাছে জানতে চেয়েছে। তারাও বেশির ভাগই ছাত্র। যাদের বয়স দেশে আন্দোলনকারী ছাত্রদের প্রায় কাছাকাছি। দেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলা আন্দোলনের একপর্যায়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দুই শতাধিক নিহত হয়েছেন। যদিও দেশের সরকার বিভিন্নভাবে সেটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, তারা ইন্টারনেট বন্ধ করার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আসলে তারা ছত্রদের ভয় পেয়েছে এবং সেটা ঢাকতেই অনেক উদ্ভট কর্মকাণ্ড করছে। কারণ, তারা জানে, ছাত্রদের কোনো প্রাণের মায়া নেই। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও প্রবাসী প্রজন্ম দেশের খবর রাখত সব সময়।

প্রবাসজীবনেও আসলে দেশের সমস্যা থেকে পালিয়ে বাঁচার কোনো উপায় নেই। যেভাবে পারা যায় দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাঁদের কথা অবশ্য ভিন্ন, যাঁরা পূর্বসূরিদের দুর্নীতির টাকায় প্রবাসের নকল সুখের প্রসাদ গড়েছেন। নাহলে প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে কী জবাবদিহি করবেন! দেশের মানুষের প্রাণেরই মূল্য না থাকলে উন্নয়ন দিয়ে কী হবে? কারণ, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।