অধ্যাপক হান্নানের মতো প্রতিষ্ঠানপ্রধান যদি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকত

বাংলাদেশসহ বিশ্বের শতাধিক দেশে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের নিয়ে লেখা প্রকাশিত হচ্ছে ‘দূর পরবাস’-এ।

অধ্যাপক এম এ হান্নান
ছবি: সংগৃহীত

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের একেবারে শুরুর দিকে—স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠার অল্প কিছুদিন আগের কথা। এ রকমই একটা রাজনৈতিক অস্থির সময়ে একদিন হাজির হয়েছিলাম বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (বিআইটি) খুলনা ক্যাম্পাসে, যা বর্তমানে খুলনা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বা কুয়েট নামে পরিচিত।

উদ্দেশ্য ছিল প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক অর্জন। মনে একদিকে উৎকণ্ঠা, অন্যদিকে উত্তেজনা নিয়েই উপস্থিত হয়েছিলাম প্রথম দিনের নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিষ্ঠানের ওরিয়েন্টেশনে। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক এম এ হান্নান, যিনি আমার আজকের লেখার মূল চরিত্র।

ভদ্রলোকের অতি সাধারণ বেশভূষা—ফুলহাতা শার্টের হাতা প্রায় অর্ধেক ভাঁজ করা, শার্টের নিচের দিকটা প্যান্টের ভেতরে না দিয়ে বাইরে রাখা, প্যান্টের নিচের দিকে কয়েকটা ভাঁজ করা, যাতে করে প্যান্ট গোড়ালির ওপরে থাকে, মাথায় টুপি, আর ছাঁট না দেওয়া কাঁচাপাকা দাড়ি। ভদ্রলোক আমাদের অনেক কথাই সেদিন বলেছিলেন। যেমন ‘আমরা ঘোড়াকে পানির কাছে নিতে পারি, কিন্তু পানি পানের কাজটি ঘোড়াকেই করতে হবে।’

যার অর্থ ছিল বিআইটিতে পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ প্রশাসন নিশ্চিত করবে, কিন্তু পড়াশোনার মূল কাজটি আমাদেরই করতে হবে। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘তোমরাসহ এ প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭৫০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। আর আবাসিক হলগুলোয় এর চেয়ে বেশি সিট আছে। সুতরাং তোমাদের কাউকে যদি কেউ রাজনৈতিক দলগুলোয় যোগদানের বিনিময়ে হলে সিট দেওয়ার কথা বলে, তাহলে আমাকে বলবে, আমি স্থান-কাল-পাত্রভেদে এর সমাধান করব।’

এ কথা বলার পর আমরা হাততালি দিতে থাকি। উনি আমাদের থামিয়ে বলেন, ‘দেখো, এ ক্যাম্পাসে আমাদের দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখা আছে। তোমরা ইচ্ছা হলে রাজনীতি করবে, না হলে না করবে। এ বিষয়ে কোনো রকম জোরাজুরি এখানে চলবে না। তবে মনে রাখবে, এ ক্যাম্পাসে যেকোনো কারণেই হোক না কেন, কোনো ধরনের মারামারি, হাতাহাতি, রক্তপাত চলবে না। এর কোনোরূপ ব্যত্যয় ঘটলে আমি কথা দিচ্ছি, হয় সে বা তারা ক্যাম্পাসে থাকবে, না হয় আমি।’

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

সত্যি বলতে কি, আমি চার বছর কয়েক মাস ক্যাম্পাসে ছিলাম, যেখানে আমার প্রোগ্রামের সময় ছিল চার বছর। আমার অবস্থানের সময় দেখেছি, প্রতিবছরই নিয়ম করে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো, শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়ে নতুন বর্ষে যেত, আমরা যার যার ইচ্ছেমতো রাজনীতি করতাম, বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো। অথচ কখনোই দেখিনি একজন শিক্ষার্থী অন্য আরেকজনের সঙ্গে কারণে বা অকারণে হাতাহাতি–মারামারি করেছে।

আর রক্তপাত! সে তো ছিল আমাদের ধারণার বাইরে!

পাঠক, আপনারা ভাবতে পারেন, ছোট ক্যাম্পাস, ওখানে এগুলো সম্ভব ছিল! আসলে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আমাদের দেশের প্রতিটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুলনা বিআইটির মতোই ছিল (ইন্টার্নি ডাক্তাররা ছাড়া)।

অথচ ওই সময়ে মেডিকেল কলেজ প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতো। যেমন আমার এক স্কুলের সহপাঠী ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে তারই কলেজের অন্য সহপাঠী কিন্তু প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হাতে নিহত হয়েছিল। আমার আরেক বন্ধু বরিশাল মেডিকেল কলেজে তারই দু–এক বছরের বড় শিক্ষার্থী, কিন্তু প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কর্মীরা তার হলের রুম পুড়িয়ে দিয়েছিল। আমার বন্ধু ভাগ্যের গুণে সেবার জীবনে বেঁচে গিয়েছিল!

যাহোক, স্নাতক পাস করবার পর আমরা (আমি এবং আমার অন্য সহপাঠীরা) অতি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছিলাম, আমাদের সহপাঠীরা অন্য প্রতিষ্ঠানে তখনো তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী!

পাস করবার কয়েক মাস পরের কথা। এরই মাঝে দেশের বাইরের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করার একটা অফার পেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা একটা শর্ত দিয়েছিল যে আমাকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মূল সার্টিফিকেটের কপি ওদের দিতে হবে। কিন্তু আমাদের তো সমাবর্তন ছাড়া মূল সনদ দেওয়া হতো না। বেশ ভাবনায় পড়েছিলাম, হঠাৎই মনে হলো হান্নান স্যারের সঙ্গে দেখা করলে কেমন হয়?

পাঠক, বিআইটির শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় কখনোই হান্নান স্যারের অফিসে গিয়েছি কি না, তা মনে করতে পারলাম না। তারপরও যেমন ভাবা তেমন কাজ। একদিন হান্নান স্যারের অফিসে হাজির হলাম। অতি ভয়ে দুরুদুরু বক্ষে আমতা-আমতা করে স্যারকে বললাম, ‘স্যার, আমি কয়েক মাস হলো পাস করেছি আর ইতিমধ্যে বিদেশে মাস্টার্স করার একটা অফার পেয়েছি।’

মনে হলো স্যার বেশ খুশি হলেন। বললেন, ‘কংগ্র্যাচুলেশনস! খুবই ভালো কথা।’

আমি এবারে হাত কচলিয়ে বললাম, ‘কিন্তু স্যার, একটা সমস্যা হয়েছে। ওরা তো আমার মূল সার্টিফিকেট দেখতে চায়। অথচ গত বছরই একটা সমাবর্তন হয়েছে আর আমাকে তো সার্টিফিকেটের জন্য পরবর্তী সমাবর্তনের অপেক্ষা করতে হবে, যা কবে হবে, কেউই জানে না। এ অবস্থায় আপনার কি কিছু করার আছে?’

আমার বক্তব্য শুনে স্যার আমার দিকে তাকিয়েই রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর উনি বললেন, ‘তুমি এক কাজ করো, সার্টিফিকেটের ফি জমা দিয়ে ব্যাংক রসিদটা আমাকে দিয়ে যাও।’

আমি অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে স্যারকে রসিদটা দিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, ‘স্যার, এরপর আমার কী করণীয়?’

স্যার উত্তরে বললেন, ‘আগামী সপ্তাহের শেষের দিকে আমার সঙ্গে দেখা করবে।’
পরের সপ্তাহে স্যারের অফিসে যেতেই উনি আমাকে মূল সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। আমি আবারও ভয়ে ভয়ে স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্যার, এটা কীভাবে সম্ভব হলো, যদি বলতেন?’

মৃদু হেসে স্যার বললেন, ‘দেখো, এ সপ্তাহের গোড়ার দিকে আমি ঢাকাতে বিআইটি কাউন্সিলের মিটিংয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে তোমার বিষয়টা উপস্থাপন করি এবং তাদের অনেক কষ্টে রাজি করাই। তুমি জানো কি না জানি না, আমাদের বিআইটির ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম!’

ছাত্র থাকা অবস্থায় শুধু ভাবতাম, হান্নান স্যার একজন কঠোর প্রশাসক! কিন্তু সেদিন বুঝেছিলাম, তিনি তার ছাত্রদের ভালোর জন্য সবই করতে পারেন!

এ ঘটনার পর তিন দশকের মতো সময় পেরিয়ে গেছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বিপুল জলরাশি। এর মাঝে আমার সঙ্গে স্যারের আর কোনো দিন দেখা হয়নি।

কিন্তু আমি প্রায়ই হান্নান স্যারের কথা বিভিন্ন স্থানে বলি আর ভাবি, ওনার মতো প্রশাসক বা প্রতিষ্ঠানপ্রধান যদি বাংলাদেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে থাকত, তাহলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্রমোন্নতি কেউ কি ঠেকাতে পারত?

সবশেষে বলি, আমার শিক্ষক অধ্যাপক এম এ হান্নান আজও বেঁচে আছেন। পরম করুণাময় ওনাকে সুস্থ রাখুন।

  • লেখক: ক খ হাসান, অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগারি, কানাডা

  • লিখতে পারবেন আপনিও। লেখার শিরোনামের ওপর ‘শিক্ষক দিবসের লেখা’ শব্দটি লিখবেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]