আঙুরলতা–ওয়াইন এবং স্লোভেনিয়ার ভিন্টনার পরিবারের সঙ্গে সুখস্মৃতি
প্রবাহমান নদীর মতো এঁকেবেঁকে চলেছে পিচঢালা পথ। গ্রাম্য পথ। প্রকৃতি নিজের সর্বস্বকে দুই হাত ভরে উজাড় করে দিয়েছে। অথচ মানুষের হাতে গড়ে ওঠা রাস্তাগুলো প্রকৃতির এ অনুদানকে সেভাবে গ্রহণ করতে পারে নি। এ কারণে রাস্তাগুলো প্রশস্ততার দিক থেকে খুব একটা বাড়তে পারে নি। তা সত্ত্বেও রাস্তার বুক চিরে প্রতিনিয়ত ছুটে চলে বিভিন্ন ধরনের মোটরযান।
অনেক সময় পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মালবাহী লরিকেও এ সড়কপথ দিয়ে স্লোভেনিয়া হয়ে ইতালিতে ছুটতে দেখা যায়। রাস্তার দুই পাশে বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ছোট বড় পাহাড়। ভূগোলবিদের মতে এ সকল পাহাড় সমন্বিতভাবে দিনারিক আল্পস পর্বতমালার বর্ধিত অংশবিশেষ। গ্রীষ্মের শেষ। দুয়ারে কড়া নাড়ছে শরৎকাল। ঋতু পরিবর্তনের গোপন বার্তাটি পাহাড়ের মধ্যে একটু একটু করে দৃষ্টিগোচর উঠছে। গ্রীষ্মের আগমনে পাথরের পাহাড়গুলো নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল।
পাহাড়ের গায়ে ধ্বনিত হয়েছিল সবুজের বিপ্লব। তবে, গ্রীষ্মের বিদায়ের ঘণ্টা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাথরের পাহাড়ের ওপর বেড়ে ওঠা সবুজ তরুলতা যেন একটু একটু করে সবুজ রং হারিয়ে হলুদ বা কমলা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। পাখিদের কণ্ঠে গাওয়া গানও আস্তে আস্তে শূন্যে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে।
মাঝেমধ্যে এ গ্রাম্যপথ ধরে দেখা মেলে পাথরের তৈরি ঘর আর সেই সঙ্গে আঙুরের বাগান। দুই পাহাড়ের মাঝখানে লজ্জায় নত হয়ে থাকা সমতল ভূমিতে মূলত এসব আঙুরের বাগানের দেখা মিলে। শীতকালে বাতাসের কম্পনে রীতিমতো কেঁপে ওঠে এ জনপদের মানুষ। কোনো কোনো সময় বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটারের ওপরে উঠে যায়।
আমার মতো আশি কিলোগ্রাম ওজনের একজন শক্তিশালী যুবককে এ বাতাস যে কোনো মুহূর্তে উড়িয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম। স্থানীয় অধিবাসীরা এ বাতাসের নাম দিয়েছেন ‘বুরইয়া ভেটের’। বাতাসের বেগ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে এ অঞ্চলে ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে পাথর কেটে। কোনো কোনো ঘরবাড়ি আবার তিন শ থেকে চার শ বছর পুরোনো। বলা হয়ে থাকে, বুরইয়া ভেটের নাকি গোটা ইউরোপ তো বটে এমনকি সমগ্র পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহের মধ্যে একটি।
পাট যেভাবে একসময় আমাদের অর্থনীতির প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক একইভাবে এ উপত্যকার মানুষের কাছেও আঙুরলতা হচ্ছে বেঁচে থাকার প্রধানতম শক্তি। এ উপত্যকার একটি নামও রয়েছে। স্লোভেনিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা এ উপত্যকার নাম দিয়েছেন ‘ভিপাভা ভ্যালি।’ নানোস পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা পোদনানোস নামক ছোট্ট একটি গ্রাম থেকে শুরু করে এ উপত্যকা পশ্চিম দিক বরাবর ইতালির সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ভিপাভা আর আইডোসচিনা এ উপত্যকা অঞ্চলের দুইটি প্রধান জনপদ।
তাঁদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। এমনকি আমার মতো কোনো প্রাপ্তির আশায়ও তাঁরা সেখানে ছুটে যান না। পৃথিবী সত্যি সুন্দর, তবে পৃথিবীর এ সৌন্দর্য আমাদের চোখে সব সময় ধরা দেয় না। ২০২০ সালের পর বাংলাদেশে যাওয়া হয় নি। পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে যদিও ভার্চ্যুয়ালি সংযুক্ত আছি, তবে তাঁদের কাউকে দীর্ঘদিন ধরে কাছ থেকে দেখার সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত। ম্যাথিওসের পরিবারের মধ্যে নিজের পরিবারকে খুঁজে পেয়েছি।
আঙুর থেকে উৎপাদিত ওয়াইনের মাধ্যমে ভিপাভা ভ্যালি অঞ্চলে বসবাস করা বেশিরভাগ পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে আছে। কোনো কোনো পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুই থেকে তিন শতক ধরে ওয়াইন উৎপাদনের ইতিহাস। আঙুরের থেকে রস সংগ্রহ করে ফার্মেন্টেশনের মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় ওয়াইন। ওয়াইন বিক্রি করে যে টাকা আয় হয়, সেটি দিয়ে এ অঞ্চলের অনেক পরিবারের পুরো বছরের অন্ন ও বস্ত্রের সংস্থান হয়। এটা ঠিক যে বর্তমানে ওয়াইন উৎপাদনের হার কমে এসেছে।
ইংরেজিতে আঙুরের বাগানকে বলা হয় ভিনইয়ার্ড। আর যারা ওয়াইন উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত, তাঁদেরকে বলা হয় ভিন্টনার।
বেশ কয়েক মাস ধরে পকেটের অবস্থা ভালো যাচ্ছিলো না। বলতে গেলে রীতিমতো ফতুর হয়ে যাওয়ার উপক্রম। একটা চাকরি খুঁজছিলাম সাময়িক সময়ের জন্য, যাতে পকেটকে কিছুটা তরতাজা রাখা যায়। এক ক্লাসমেট নেইসকে বললাম যদি সে আমাকে কোনোভাবে চাকরি খুঁজে পেতে সাহায্য করে। গ্রীষ্মের শেষভাগ থেকে শুরু করে শরতের প্রথম কয়েক দিনকে ইউরোপিয়ানরা বলে হার্ভেস্টিং সিজন। এ সময় কৃষকেরা ঘরে নতুন ফসল তোলেন।
পাকা ফসলের ঘ্রাণে চারদিকের বাতাস সুবাসিত হয়ে ওঠে। নেইসকে বললাম এখন হার্ভেস্টিং সিজন, তাই সে যদি আমাকে কোনো আঙুর, পিচ বা নাশপাতির বাগানে ফল সংগ্রহের কোনো কাজ খুঁজে দিতে পারে, সেটা আমার জন্য সবচেয়ে ভালো হয়। এ ধরনের কাজে মালিক কখনো ডকুমেন্টের বিষয়ে কোনো ধরনের ঝামেলা করেন না। এ মুহূর্তে আমার কাছে স্লেভেনিয়ার টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট নেই। তাই ডকুমেন্টের প্রসঙ্গ আনতে হলো। এছাড়াও এ ধরনের কাজে কোনো বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না এবং মালিকপক্ষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কর্মচারীদের হাতে সরাসরি বেতন পরিশোধ করেন। ফলে, পর্বতসম ট্যাক্সের বোঝা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
নেইসের জন্ম ও বেড়ে উঠা ভিপাভা ভ্যালিতে। যেহেতু নেইস ভিপাভা ভ্যালির স্থানীয় অধিবাসী এবং এ অঞ্চলের প্রতিটি ধূলিকণা তার চেনা, তাই একটি কাজ খুঁজে দিতে তাঁকে বিশেষ কোনো বেগ পেতে হয় নি। ইনস্টাগ্রামে নেইসের মাধ্যমে আরবান নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। আরবান ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির হয়ে কাজ করছেন। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার। নিজেকে সংগীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
আরবানের পারিবারিক পদবি ভিদমার। ভিদমার পরিবার প্রায় দুই শ বছরের বেশি সময় ধরে ভিপাভা ভ্যালিতে ওয়াইন উৎপাদন করছে। ইনস্টাগ্রামে আরবানকে ম্যাসেজ দিই। রিপ্লাই পেতে দেরি হয় নি। আরবানের বড় ভাই ম্যাথিওস তাঁদের পারিবারিক ব্যবসার দেখভাল করছেন। আরবান একটি ঠিকানা দিয়ে পরদিন সকাল আটটার মধ্যে উপস্থিত থাকতে বলেন। আমার বাসা থেকে কয়েক মাইল দূরে সেলো নামের একটি বাস স্টপেজ আছে। আমি যদি সেখানে উপস্থিত হতে পারি, তাহলে তার ভাই ম্যাথিওস কাজের স্থানে আমাকে নিয়ে যাবে।
ম্যাথিওসের নম্বরও দিয়ে দিল। ওই দিন পরীক্ষা থাকায় আরবানের কাছ থেকে আরও দুই দিন সময় চেয়ে নিলাম। নির্ধারিত দিনে আমি সকাল সাড়ে আটটার দিকে সেলোর বাস স্টপেজে যাই। এরপর ম্যাথিওসকে ফোন দেওয়ামাত্র তিনি গাড়িতে আমাকে পিক করতে আসেন। প্রথম প্রথম ভাবছিলাম যে এ ধরনের কাজে আমাকে বেশ বেগ পোহাতে হবে। প্রথমত শারীরিকভাবে আমরা খুব একটা শক্তিশালী নই ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে তুলনা করলে।
কৃষিকাজ এমনিতে অনেক কষ্টের কাজ। তীব্র রোদ, বৃষ্টি বা শীত সব ধরনের প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মাঝেমধ্যে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। এটা ঠিক যে স্লোভেনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ ইংরেজিতে পারদর্শী, তারপরেও মনের ভেতর এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল সবাই কী আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। তিন বছরের বেশি সময় ধরে স্লোভেনিয়াতে বসবাস করছি, অথচ এ দেশটির ভাষা এখনো সেভাবে রপ্ত করতে পারি নি। এ বিষয়টি নিশ্চিন্তভাবে লজ্জাজনক।
যা-ই হোক, ম্যাথিওসের থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর সব ভয় কেটে গেল। যদিও এ ধরনের কাজ ভীষণ পরিশ্রমের, তারপরেও আমাকে খুব একটা কষ্টের স্বীকার হতে হয় নি। আমার সঙ্গে বরিস নামক এক ভদ্রলোক কাজ করতেন। আমরা সরাসরি গাছ থেকে আঙুর সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে বাক্স ভর্তি করতাম। বরিস ছিলেন যথেষ্ট আন্তরিক। আমার সঙ্গে যারা কাজ করতেন, সবার বয়স ৫০ এর ওপরে। এমনিতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আমার পরিচিত যে সব বাংলাদেশি রয়েছেন, তাদের কাছ থেকে একটা অভিযোগ প্রায় সময় শুনেছি।
ইউরোপে মোটামুটিভাবে যাঁদের বয়স ৫০ এর ওপরে, তাঁদের আচরণে অনেক সময় অভিবাসীদের প্রতি বর্ণবৈষম্যের বিষয়টি ফুঁটে উঠে। আমার ক্ষেত্রে সেটা কখনো হয় নি। দুই একটি বিচ্ছিন্ন ছোটখাটো ঘটনা ছাড়া স্লোভেনিয়াতে আমি প্রায় সাড়ে তিন বছরে কোনো ধরনের বর্ণবৈষম্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করি নি।
একটানা সাত দিন ম্যাথিওসের অধীনে কাজ করেছি। সহকর্মীদের প্রায় সবাই তাঁর ফার্মে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। ভিদমার পরিবারের মালিকানায় দশটিরও বেশি আঙুরের বাগান আছে। মালিকানা শব্দটি ব্যবহার করা ঠিক হবে কি না সেটা বুঝতে পারছি না। ম্যাথিওস বললেন, স্লোভেনিয়াতে কেউ যদি আঙুরের বাগান ক্রয় করতে চান, তাহলে তাঁকে প্রায় তিন লক্ষ আশি হাজার ইউরো খরচ করতে হয়। তবে কেউ যদি সরাসরি সরকারের বা স্থানীয় চার্চের থেকে জমি লিজ নিয়ে আঙুরের বাগান তৈরি করতে চান, তাহলে সে ক্ষেত্রে বছরে তাঁকে মাত্র ৩০০ ইউরো পরিশোধ করতে হয়। এজন্য ভিপাভা ভ্যালিতে বসবাস করা বেশিরভাগ পরিবার সরকার বা স্থানীয় চার্চ থেকে জমি ইজারা নিয়ে আঙুরের খেত করেন। প্রতিবছর লিজের টাকা পরিশোধ না করলেও সমস্যা হয় না, দুই বছরে একসঙ্গে ৬০০ ইউরো দিলেও ঝামেলা হয় না।
ম্যাথিওসকে একদিন কাজের ফাঁকে প্রশ্ন করলাম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ যুগে যেখানে সব কিছু ধীরে ধীরে মেশিননির্ভর হয়ে পড়ছে, সেখানে খেত থেকে আঙুর সংগ্রহ করতে আজও কেন মেশিনের তুলনায় বেশিরভাগ ওয়াইন প্রস্তুতকারক ম্যানুয়াল লেবারের প্রতি নির্ভর থাকতে অধিকমাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ম্যাথিওস জানালেন, আঙুর সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমতল ভূমিতে মেশিন ব্যবহার করা গেলেও পাহাড়ি বন্ধুর পথে মেশিন তেমন একটা কার্যকর নয়।
এছাড়াও মানুষ যেভাবে আঙুর বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সতকর্তা অবলম্বন করতে পারেন, মেশিনের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয় না। তিনি আরও বলেন, আগের বছরগুলোতে তিনি তাঁর কয়েকটি খেতে মেশিন ব্যবহার করে আঙুর সংগ্রহ করেছিলেন। মেশিনের সাহায্যে আঙুর সংগ্রহ করার সময় অনেক ক্ষেত্রে ফল থেকে বেশি পরিমাণে রস বের হয়ে যায়, তাই এ আঙুর থেকে যখন ওয়াইন উৎপাদন করা হয়, সেটা থেকে ভালো মানের ওয়াইন পাওয়া যায় না। তারপরেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে খেত থেকে আঙুর সংগ্রহের ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মেশিনেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে জানান তিনি।
ওয়াইনের কথা শুনলে আমাদের সবার সামনে সবার প্রথমে ইতালি, ফ্রান্স আর স্পেনের নাম উঠে আসে। ওয়াইন প্রস্তুতের দিক থেকে এ তিনটি দেশ কয়েক শতাব্দী ধরে সব সময় শীর্ষস্থানের জন্য লড়াই করে আসছে। এছাড়াও বর্তমানে আর্জেন্টিনা, চিলি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের নাপা ভ্যালিতে উৎকৃষ্টমানের ওয়াইন তৈরি হচ্ছে। তবে ম্যাথিওসের মতে ওয়াইন উৎপাদনের জন্য গোটা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট জায়গা হচ্ছে এ ভিপাভা ভ্যালি। তিনি কতোগুলো যুক্তি দেখিয়েছেন। প্রথমত, ভিপাভা ভ্যালি থেকে ভূ-মধ্যসাগরের শাখা হিসেবে পরিচিত আড্রিয়াটিক সাগরের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। তাই ভিপাভা ভ্যালির জলবায়ু ভূ-মধ্যসাগরীয় জলবায়ুর কাছাকাছি। আঙুর উৎপাদনের জন্য এ স্থানের মাটি আদর্শ। নাপা ভ্যালিতে আঙুরের খেতগুলোতে সজীব রাখতে কৃষকদেরকে বারবার তাঁদের জমিতে সেচ দিতে হয়, ভিপাভা ভ্যালিতে আঙুর উৎপাদনে বাড়তি সেচের খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। তাছাড়া প্রাকৃতিকভাবে এ অঞ্চলে পবিভিন্ন ধরনের পানির উৎস রয়েছে। এমনকি এখানকার মাটিতে পিএইচের পরিমাণও পর্যাপ্ত।
মাটির পানি ধারণ করার ক্ষমতাও উল্লেখ করার মতো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বছরের প্রায় সব সময় ভিপাভা ভ্যালিতে দিনের তুলনায় রাতের তাপমাত্রা বেশ কম থাকে যা এ অঞ্চলে প্রস্তুত হওয়া ওয়াইনের মাঝে বাড়তি সুগন্ধ যোগ করে বলে তিনি জানান। ম্যাথিওসের মতে তুলনামূলক কম পরিশ্রমে অনেকটা সাশ্রয়ী মূল্যে ভিপাভা ভ্যালিতে উৎকৃষ্ট মানের ওয়াইন তৈরি করা যায়, যা পৃথিবীর অন্য কোনো স্থানে সম্ভব নয়। তবে ম্যাথিওসের বক্তব্যে কিছুটা হতাশা লক্ষ্য করা গিয়েছে। প্রথমত ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিলি ও আর্জেন্টিনার সরকারের চেয়ে স্লোভেনিয়ার সরকার বিপণন কৌশলে অনেক পিছিয়ে। তাই স্লোভেনিয়ার ওয়াইন–শিল্প এ কারণে এখনো বিশ্বজুড়ে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেক পরিবার ওয়াইন উৎপাদন করা বন্ধ করে দিয়ে বিকল্প কোনো উপায়ে জীবিকা সংস্থানের পথে হাঁটছে। এছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন ওয়াইন প্রস্তুতকারকদের কাছে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণত স্লোভেনিয়াতে গ্রীষ্মকালে খুব একটা বৃষ্টি হয় না। সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসের দিকে দেশটিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত দেখা যায়।
তবে হঠাৎ করে জুলাই ও আগস্টের দিকে তাপমাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে শুরু করে এবং এ বছর এ দুই মাস দেশটির বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বৃষ্টিপাতও হয়েছে। অতিরিক্ত বর্ষণের ফল উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সমতল এলাকায় বন্যা হয়েছিল। এ সব কারণে এ বছর স্লোভেনিয়াতে ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পিচের ফলন তেমন একটা ভালো হয় নি। নাশপাতি এ বছর চোখে ধরা দেয় নি। আর আঙুর নির্ধারিত সময়ের বেশ আগে গাছে থাকা অবস্থাতে পচতে শুরু করেছে।
ম্যাথিওসের বাগানে কয়েক প্রজাতির আঙুর রয়েছে। যেমন কনকর্ড, মাস্কাট, মারলোট, কাবারনেট ইত্যাদি। খালি চোখে আমাদের মতো সাধারণ এ সকল আঙুরের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারবে না। কেবলমাত্র যারা ওয়াইন উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা বলতে পারবেন, কোন আঙুর কোন প্রজাতির। প্রজাতিভেদে বিভিন্ন আঙুর থেকে উৎপাদিত ওয়াইনের স্বাদ ও গন্ধ আলাদা হয়ে থাকে। লাল রঙের আঙুর থেকে রেড ওয়াইন প্রস্তুত করা হয়। অন্যদিকে সাদা বর্ণের আঙুর থেকে তৈরি হয়ে হোয়াইট ওয়াইন।
সচরাচর বাসাবাড়ির জন্য যে ধরনের আঙুর কিনে থাকি, সেটাকে বলা হয় টেবিল গ্রেপ। টেবিল গ্রেপ খেতে সুস্বাদু হলেও ওয়াইন তৈরির জন্য খুব একটা আদর্শ নয়। ম্যাথিওসকে জিজ্ঞেস করলাম, শুধু কি আঙুর থেকে ওয়াইন তৈরি করা হয়? অন্য কোনো ফলের রস দিয়ে ওয়াইন প্রস্তুত করা যায় না? ম্যাথিওস আমার প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, আঙুরে চিনির পরিমাণ শতকরা ১১ থেকে ২৫ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে। বাজারে অন্য যে সকল ফল পাওয়া যায়, সেসব ফলে চিনির পরিমাণ এত বেশি হয় না। ম্যাথিওস আরও বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে অন্যান্য ফল থেকে ওয়াইন তৈরির চেষ্টা চালানো হয়েছে।
আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ব্যানানা ওয়াইন সাম্প্রতিককালে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে আঙুরের রস থেকে যতো সহজে ওয়াইন তৈরি করা সম্ভব, অন্যান্য ফলের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। এছাড়া আঙুরের রস থেকে প্রস্তুত হওয়া ওয়াইন দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ কিন্তু কলা বা অন্য যে কোনো ফলের রস থেকে তৈরি ওয়াইন খুব অল্প সময়ের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়।
মাত্র সাত দিন এ সাত দিনে অনেক কিছু শিখেছি। ওয়াইন উৎপাদন নিয়ে ম্যাথিওসের থেকে অল্পবিস্তর ধারণা পেয়েছি। গাছ থেকে সংগ্রহ করা আঙুর থেকে প্রেসের সাহায্যে রস বের করা হয়। এরপর ফিল্টারের মাধ্যমে রস পরিষ্কার করে সেডিমেন্ট ট্যাঙ্কে পাঠানো হয়। সেডিমেন্ট ট্যাঙ্কের তাপমাত্রা সব সময় শীতল রাখা হয়। প্রথমবার ফিল্টার করার পর আঙুরের রসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিভিন্ন ধরনের শক্ত পদার্থ যেমন আঙুরের বীজ বা ফলের খোসা থেকে যায়। প্রায় তিন দিন সেডিমেন্ট ট্যাঙ্কে অবস্থান করার পর এ রস আরও পরিশ্রুত হয় এবং বিভিন্ন ধরনের শক্ত পদার্থগুলো তলানি হিসেবে ট্যাংকের নিচে জমা হয়।
এরপর এ রসকে আরও একবার ফিল্টার করা হয় এবং পরে ফার্মেন্টেশনের জন্য পাঠানো হয়। ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বা ইস্টের সাহায্যে আঙুরের রস থেকে ওয়াইন প্রস্তুত করা হয়। ব্যাকটেরিয়া ও ইস্টের শরীর থেকে নিঃসৃত এনজাইম আঙুরের রসে বিদ্যমান শর্করা বিশেষত চিনিকে আর্দ্র বিশ্লেষণ করে অপেক্ষাকৃত সরল ও ক্ষুদ্র অণুবিশিষ্ট ইথানলে পরিণত করে। অ্যালকোহল বলতে মূলত ইথানলকে বোঝায়। ফার্মেশনটেশন সম্পন্ন হতে দুই সপ্তাহ থেকে দুই মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
এভাবে উৎপাদিত ওয়াইন পুরোপুরিভাবে পরিষ্কার নয়, এ কারণে ফার্মেন্টেশন শেষে আরও একবার ফিল্টারিংয়ের প্রয়োজন হয়। ম্যাথিওস জানালেন, বর্তমানে জীববিজ্ঞানপ্রযুক্তির সাহায্যে ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে বেশ কিছু প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া ও ইস্টের উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাইরে থেকে আলাদাভাবে এ সকল ব্যাকটেরিয়া ও ইস্ট যোগ করা হলে ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় এবং ওয়াইনের স্বাদ ও গন্ধ ভালো হয়।
এছাড়াও পিএইচের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অ্যাসিডের উপস্থিতির ভিত্তিতেও ওয়াইনের গুনগত মান নির্ণয় করা যায়। ফার্মেন্টেশনের পর শেষধাপে ফিল্টারিং শেষে প্রাপ্ত ওয়াইনকে ওক কাঠের তৈরি ব্যারেলের মধ্যে রাখা হয় অ্যাজিংয়ের জন্য। অনেকে বলে থাকেন যে অ্যাজিং যতো বেশি হয় অর্থাৎ ওয়াইন যত পুরাতন হয় তত এর স্বাদ বাড়ে। তবে ম্যাথিওসের থেকে জানতে পারলাম যে এ বিষয়টি পুরোপুরি সত্য নয়। কিছু কিছু ওয়াইন আছে যেগুলো অ্যাজিংয়ের ফলে স্বাদ ও গন্ধ দুই দিক থেকে গুনগত মানের উন্নতি ঘটে। আবার কিছু কিছু ওয়াইন আছে যেগুলোর ক্ষেত্রে অ্যাজিংয়ের ফলে ওয়াইনের স্বাদ ও গন্ধ উভয়ই নষ্ট হয়।
স্বাদের দিক থেকে তিন ধরনের ওয়াইন রয়েছে। প্রথমত সুইট ওয়াইন, এ জাতীয় ওয়াইন স্বাদের দিক থেকে বেশ সুমিষ্ট। এরপর রয়েছে ড্রাই ওয়াইন। এ ওয়াইন তেতো স্বাদের। এছাড়াও রয়েছে স্পার্কলিং ওয়াইন। কোকাকোলা, পেপসি, ফান্টা বা স্প্রাইটের মতো স্পার্কলিং ওয়াইনের ভেতর উচ্চচাপে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস দ্রবীভূত করা হয়। এ কারণে যে বোতলে স্পার্কলিং ওয়াইন রাখা হয় সে বোতলের মুখ খোলার সাথে সাথে বুদবুদ আকারে কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে আসে। অনেকে স্পার্কলিং ওয়াইন বলতে শ্যাম্পেইনকে বোঝেন।
শ্যাম্পেইন একধরনের স্পার্কলিং ওয়াইন। ফ্রান্সের উত্তরপূর্বে শ্যাম্পেইন নামক এক অঞ্চল রয়েছে। ওয়াইন উৎপাদনের জন্য এ অঞ্চল বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। কেবলমাত্র এ অঞ্চলে যে সকল স্পার্কলিং ওয়াইন উৎপাদন করা হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে শ্যাম্পেইন নামক এ ট্রেডমার্কটি ব্যবহার করা যায়। ম্যাথিওসকে জিজ্ঞেস করলাম বছরে সর্বোচ্চ কী পরিমাণ ওয়াইন তাঁরা উৎপাদন করতে পারেন। ম্যাথিওস জানালেন, যে এ মুহূর্তে বছরে তাঁরা প্রায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার লিটার পর্যন্ত ওয়াইন উৎপাদন করতে পারেন, যদিও বছর তাঁরা এর অর্ধেক পরিমাণ ওয়াইন প্রস্তুত করে থাকেন।
এ বছরে আঙুরের ফলন ভালো না হওয়ায় তাঁদের পরিবারের সবাই বেশ নিরাশ। তাই এ বছর তাঁরা আশানুরূপ ওয়াইন প্রস্তুত করতে পারছেন না। এছাড়াও তিনি আরও জানান যে ওয়াইনের গুণগত মান ধরে রাখতে হলে এ বছর তাঁদের বোতলপ্রতি ওয়াইনের দাম বাড়াতে হবে। তিনি আফসোসের সঙ্গে জানান, গত ৩০ বা ৩৫ বছরের মধ্যে এ বছর ব্যবসা সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ম্যাথিওসের অধীনে কাজ করেছি মাত্র এক সপ্তাহ। সত্যি কথা বলতে এ সাত দিন ছিল স্লোভেনিয়াতে আসার পর আমার প্রবাসজীবনের সেরা সময়। ম্যাথিওসের আচরণ সব সময় ছিল বন্ধুসুলভ। কাজের বাইরেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হতো। ম্যাথিওসের বয়স ৩৪ বছর। তাঁর বাবা হার্নান্দো অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত। এ কারণে তিনি পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেছেন। এছাড়াও বর্তমানে তিনি বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। স্লোভেনিয়ার কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সরাসরি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তিনি চান স্লোভেনিয়া আরও বেশি অভিবাসনবান্ধব রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠুক এবং এ দেশের বিভিন্ন সিস্টেমে পরিবর্তন আসুক। পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনার পাশাপাশি তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর ইউনিভার্সিটি অব লুবলিয়ানা থেকে স্নাতোকোত্তর করছেন।
আমাদের মাঝে ধারণা রয়েছে পাশ্চাত্য সমাজে পরিবার প্রথা তেমন একটা শক্তিশালী নয়। স্লোভেনিয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি সত্য নয়। ম্যাথিওসের যখন বিয়ে হয় তখন তাঁর বয়স ছিল ২৭ বছর। বর্তমানে তিনি তিন সন্তানের জনক। ম্যাথিওস জানান যে ত্রিশে পা রাখার পূর্বে তিনি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন যে অন্ততপক্ষে তাঁর দুইটি সন্তান থাকবে। এ দিক থেকে তিনি সফল হয়েছেন এবং স্লোভেনিয়ার সমাজ ব্যবস্থা অনুযায়ী বেশিরভাগ মানুষ নাকি ত্রিশের আগে বিবাহ কাজ সম্পন্ন করে অন্তত একটি সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করেন। অবশ্য বর্তমানে উঠতি বয়সী অনেক তরুণ–তরুণী এ সকল বিষয়ের তেমন ধার ধারেন না।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আর ন্যাটোতে স্লোভেনিয়ার অংশগ্রহণ নিয়ে ম্যাথিওসের থেকে তাঁর মন্তব্য জানতে চেয়েছিলাম। ম্যাথিওস ন্যাটো জোটের বিরোধী। তাঁর মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রতি নির্ভর না হয়ে ইউরোপের প্রত্যেক দেশের উচিত সামরিক খাতে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠা। তিনি মনে করেন যখন কোনো দেশ ন্যাটো জোটে যোগদান করে তখন সে দেশ প্রতিরক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে যা ওই দেশের সর্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আসলে কোনো দেশ সম্পর্কে ভালো মতো জানতে চাইলে সে দেশ ভ্রমণের পাশপাশি কয়েক মাস সেখানে অবস্থান করাটা বিশেষভাবে জরুরি। এছাড়াও সবচেয়ে অপরিহার্য বিষয়টি হচ্ছে সে দেশের প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে প্রকাশ্যভাবে মেলামেশার পাশাপাশি তাঁদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা। এ কাজ থেকে এ শিক্ষাটি পেলাম। ম্যাথিওস ও বরিসের মতো মানুষদের সঙ্গে কাজ করার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত আনন্দের। প্রত্যেক দিন দুপুরে ম্যাথিওস আমাদের সবাইকে খাবার দিয়ে যেতেন।
একেবারে গ্রামীণ ছোঁয়া, গ্রামের বাড়িয়ে সচরাচর যে ধরনের খাবার তৈরি করা হয়, সে ধরনের খাবার দিয়ে মুক্ত বাতাসে অন্যান্য সহকর্মীদের নিয়ে একসঙ্গে লাঞ্চ করার অভিজ্ঞতা ছিল মনে রাখার মতো একটি বিষয়। ম্যাথিওসের প্রতিবেশী ও অনেক কাছের বন্ধু খেত থেকে আঙুর সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে ওয়াইন উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন কাজে তাঁকে সহায়তা করে থাকেন।
তাঁদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। এমনকি আমার মতো কোনো প্রাপ্তির আশায়ও তাঁরা সেখানে ছুটে যান না। পৃথিবী সত্যি সুন্দর, তবে পৃথিবীর এ সৌন্দর্য আমাদের চোখে সব সময় ধরা দেয় না। ২০২০ সালের পর বাংলাদেশে যাওয়া হয় নি। পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে যদিও ভার্চ্যুয়ালি সংযুক্ত আছি, তবে তাঁদের কাউকে দীর্ঘদিন ধরে কাছ থেকে দেখার সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত। ম্যাথিওসের পরিবারের মধ্যে নিজের পরিবারকে খুঁজে পেয়েছি।
তাঁর বাবা ও মায়ের থেকে ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়েছি। ভবিষ্যত জীবনে হয়তো বিভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গে আমাকে সংশ্লিষ্ট হতে হবে, হয়তো একদিন স্লোভেনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। তবে এ সাত দিন আমার প্রবাস জীবনে শ্রেষ্ঠ সময় হয়ে থাকবে। যদি কখনো টাইম মেশিন উদ্ভাবন হয়, তবে আমার প্রথম প্রয়াস থাকবে বারবার এ দিনগুলোতে ফিরে যাওয়া।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একদিন আমিও ওই সাত দিনের কথা ভেবে মনের অজান্তে কেঁদে উঠব এ বলে—
‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না—
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
কান্নাহাসির বাঁধন তারা সইল না—
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি॥’
লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।