এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের পথে এক যাত্রা
হিমালয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা এভারেস্ট বেস ক্যাম্প একটি সাধারণ ট্রেক নয়; এটি প্রকৃতির সঙ্গে এবং নিজের ভেতরের শক্তির সঙ্গে একটি গভীর সংযোগের নিমন্ত্রণ। “স্বর্গের সিঁড়ি” নামেও খ্যাত এই বারো দিনের অভিযাত্রা শেরপা গ্রাম, হিমালয়ের বন, ও উঁচু নির্জন মরুভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এটি এমন এক যাত্রা, যা প্রতিটি ভ্রমণকারীকে প্রকৃতির অদম্য শক্তি ও নিজের ভিতরের সাহসের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে সাহায্য করে। এই যাত্রা আমার জীবনে শুধু একটি অভিযান নয়, বরং এটি ছিল একরকম আত্ম-পরিশুদ্ধির পর্ব — যেখানে আমি আমার সীমা চেনার সুযোগ পেয়েছি, আবার তা অতিক্রম করার সাহসও জুগিয়েছি।
*স্বপ্ন থেকে শুরু
আমার হাইকিং বুট বাঁধার বহু আগেই হিমালয়ের অভিযানের গল্প শুনতে শিখেছি। দার্জিলিং, গ্যাংটক, সিক্কিম, কাঠমান্ডু ও পোখরার ভ্রমণ আমাকে আরও আকৃষ্ট করেছিলো; কিন্তু গাড়ির জানালা দিয়ে দেখা সেই দিগন্তের চেয়ে আমি আরো কাছাকাছি দাঁড়াতে চাইতাম—শৃঙ্গগুলোর বিশালতা ফুসফুসে অনুভব করার তীব্র ইচ্ছা ছিল। অনেক বছর ভ্রমণ কাহিনি পড়া, অভিজ্ঞ পর্বতারোহীদের সঙ্গে কথা বলা ও নিজেকে শারীরিকভাবে প্রস্তুত করার পর আমি সাহস করে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের ঐতিহ্যবাহী পথ অনুসরণ করতে রওনা দিলাম।
সঙ্গী খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না, যতক্ষণ না আমার বন্ধু ইকরাম, যিনি আগে কখনো এক শহরের ব্লকের বেশি হাঁটেননি, আমাকে চোখে চোখ রেখে বলল, “কেন না? চল দেখি।” তার অনাকাঙ্ক্ষিত উৎসাহ পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত করল।
*পরিকল্পনা ও প্রথম দিনের উৎকণ্ঠা
আমরা একটি স্থানীয় নেপালি ট্রেক সংস্থার সঙ্গে বুকিং করেছিলাম। ম্যানেজার চিন আমাদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন—আট দিন ট্রেকিং, দুই দিন মানিয়ে নেওয়ার জন্য বিশ্রাম, এবং দুই দিন বিকল্প হিসেবে রাখা। ইকরাম ও আমি আমাদের গাইড সুজন এবং সুপারহিউম্যান পোর্টার রামের সঙ্গে যাত্রা শুরু করলাম। এপ্রিলের স্থিতিশীল আবহাওয়া ছিল উপযুক্ত সময়।
কাঠমান্ডু পৌঁছে সুজন আমাদের ফুলের মালা দিয়ে স্বাগত জানালেন এবং বললেন, “এখন থেকে, প্রতিটি ধাপে আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।” রাত দুটায় আমরা পাহাড়ি রাস্তায় করে রামেচাপ বিমানবন্দরের দিকে এগোলাম, যেখানে একটি ছোট্ট পাহাড়ি বিমান ভোরের অপেক্ষায় ছিল।
*লুকলা থেকে অভিযান শুরু
লুকলা পৌঁছানো এক লেজেন্ডারি অভিজ্ঞতা—ছোট রানওয়ে, উঁচু খাড়া পাহাড়, চারপাশে হিমালয়ের বিশাল পর্বতমালা। হৃদয়ের স্পন্দন দ্রুত হলেও আমরা মৃদু সবুজ পথ ধরে ফাকদিং-এর দিকে হেঁটেছি। ঝর্ণা, প্রার্থনার চাকা, ও বনের কোমল গন্ধ আমাদের ট্রেইল জীবনে স্বাগত জানাল। সন্ধ্যায় ডাল ভাত আর আদার চায়ের সঙ্গে সুজন আমাদের দৈনিক রুটিন বুঝিয়ে দিলেন—সকাল সকাল শুরু, ধীরে ধীরে হাঁটা, প্রচুর পানি পান, এবং পেটের সমস্যার জন্য মাংস বা দুগ্ধজাত খাবার বর্জনের পরামর্শ। আমরা বিস্ময়ে শুনলাম।
*শেরপা অঞ্চলে প্রবেশ
পরের দিন আমরা দুধ কোসির ঝুলন্ত সেতু পার হলাম—বরফ গলানোর প্রবাহের ওপর এই সেতুগুলো এক রোমাঞ্চকর নাচের মতো। প্রার্থনার পতাকা ঝুলানো হিলারি সেতু থেকে শুরু হল দীর্ঘ কঠোর চড়া নামচে বাজারের দিকে। চার ঘণ্টার বাঁকানো পথ আমাদের মাথা ঘোরাচ্ছিল, ফুসফুসে হাওয়া কমে যাচ্ছিল।
নামচে পৌঁছাতে পেরে ইকরাম ও আমার মাথাব্যথা, বমি ভাব, সন্দেহ—সব মিলিয়ে আমরা উচ্চতা অসুস্থতার শিকার হচ্ছিলাম। সুজন গরম রসুনের স্যুপ দিয়ে হাত গরম করিয়ে দিলেন এবং শান্তভাবে ওষুধ দিলেন। “কাল বিশ্রামের দিন,” তিনি বললেন। “ঘুমাও। পাহাড়গুলো এখানেই থাকবে।” পরদিন ভোরে এক ঝলমলে দৃশ্য: তুষার-ঢাকা পর্বত, নীল আকাশের পটভূমিতে। বিস্ময় সব ক্লেশ দূর করল।
*টেংবচে ও মেঘের রাজ্য
টেংবচের পথে পাইন বন আর পাখির কিচিরমিচিরা পরিবেশকে প্রাণবন্ত করে তোলে। হঠাৎ করেই মেঘ ঘিরে ফেলে পথ, যা অদৃশ্য হয়ে যায় পা পড়ার মাত্র এক মিটার দূরেই। প্রার্থনার পতাকার খুঁটির নিদের্শনায় ও সুজনের কন্ঠস্বরের সাহায্যে আমরা মঠে পৌঁছলাম, যখন তুষারকণাগুলো মাথার ল্যাম্পে ঝকঝক করছিল।
সূর্যোদয় আমাদের পুরস্কৃত করল— আমা দবলম স্বর্ণালী আভা, এভারেস্টের দৃষ্টিপাত, এবং পৃথিবী যেন নতুন করে সৃষ্টি হলো। শান্তির মুহূর্ত শেষে আমরা এগোলাম দিংবোচের দিকে।
*দিংবোচে ও ধৈর্যের পাঠ
এই উচ্চতায় গ্রামগুলো ছোট পাথরের ঘর, যেখানে মানুষ ইয়াক গোবরের চুলার পাশে জমায়েত হয়। এটি আমাদের দ্বিতীয় বিশ্রামের জায়গা। আমরা পাহাড়ের একটি রিজে ওঠলাম, ঢালে নেমে আসা ধ্বস দেখতে দেখতে। নেমে আসার পথে শুনলাম, এক প্রবীণ ট্রেকার পথের ওপর হার্ট অ্যাটাক থেকে মারা গেছেন—পাহাড়ের সৌন্দর্যের সঙ্গে বিপদের অনিবার্য সমবায়। রাতে সাধারণ কক্ষে বিভিন্ন ভাষার গানের মিলন আমাদের মানুষের মিলনের এক সাক্ষ্য ছিল।
*লোবুচে থেকে গোরাক শেপ
পথ আরও কঠিন হয়ে উঠল—বরফের মোরেইন, ঢেউ খেলানো পাথর, ও মর্মান্তিক স্মৃতিসৌধ। লোবুচে ততটা শীতল, যতটা রাতের আকাশ তারকারা ঝকঝক করে। ঘুম ঢেউ খেলল; উত্তেজনা ক্লান্তি কে হারিয়ে দিল।
ভোরের আগেই রওনা দিলাম গোরাক শেপের পথে। দ্রুত দুপুরের খাবার সেরে খুম্বু হিমবাহের বরফের ওপর পা দিলাম। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট, কিন্তু মন ভরে ওঠে উল্লাসে। এক পাথরে জল খেতে গিয়ে সামনে ভাসমান দৃশ্য আমাকে থমকে দিল—এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের রঙিন তাঁবু নগরী বরফ ও পাথরের চূড়ার নিচে ঝলমল করছিল। চোখে অশ্রু; স্বপ্ন সত্যি হয়ে উঠল।
ইকরাম কয়েক মিনিট পর এসে আমাকে আলিঙ্গন করল। আমরা হাসলাম, কেঁদে ফেললাম একসঙ্গে। চারপাশে অন্যান্য পর্বতারোহীরা শীর্ষ জয় করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আর আমরা ট্রেকাররা ঐতিহাসিক স্মারক পাথরের পাশে স্মরণীয় ছবি তুলছিলাম।
*কালাপাথর ও প্রত্যাবর্তন
পরদিন আমরা কালাপাথর বরফে ঢাকা অন্ধকারে উঠলাম। সূর্যোদয়ের সঙ্গে এভারেস্টের পিরামিড আগুনের মতো ঝলমল করল—চিরকাল মনে থাকার মতো ছবি। আমরা নামতে শুরু করলাম। পিছনে পরিচিত গ্রামগুলো, উষ্ণ বাতাস, ও হালকা ব্যাগ নিয়ে নিচে যাত্রা কেটে গেলো। কাঠমান্ডুতে ফিরে চিন আমাদের স্বীকৃতি ও সাফল্যের সনদ হাতে দিলেন। ইকরাম, যিনি শুরুতে সন্দিহান ছিলেন, হেসে বলল, “তাহলে… পরবর্তী কোন পাহাড়?”
এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্রেক শুধু পথ হাঁটা বা উচ্চতা জয় নয়; এটি একটি রূপান্তর। এটি শেখায় নম্রতা, ধৈর্য, ও একতা। জীবনকে সরল করে দেয়—মাত্র জল, পদচিহ্ন, ও বন্ধুত্বের মাধ্যমে—এবং মনে করিয়ে দেয় কতটা ধনবান আমরা সেসব বেসিক দিয়ে হতে পারি।
যারা জীবনে একবার হলেও প্রকৃতিকে হৃদয়ের গভীরে অনুভব করতে চান, আত্মাকে ছুঁয়ে যেতে চান, তাদের জন্য এই যাত্রা একান্ত প্রয়োজনীয়। কারণ আপনি যখন পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখবেন, তখন বুঝবেন — জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো শ্বাস বন্ধ করে নয়, বরং গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে উপভোগ করতে হয়।
যদি জীবনে কখনো এমন সুযোগ আসে, তাহলে একবার হলেও এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের পথে রওনা দিন — কারণ এই যাত্রার শেষে আপনি আর আগের ‘আপনি’ থাকবেন না।