ভালোবাসা-৩

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ইবাদুল্লাহ এফ রহমান হলের দারোয়ান। আমার হল জীবন থেকেই পরিচিত। আগে দেখা হলে স্যার বলত, সালাম দিত। এখন সাবলেট-ভড়াইট্যা হওয়ার পর বলে রউফ ভাই। প্রতি মাসের এক তারিখে আমার চৌকিতে এসে বসে। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখে, আমি তার বাড়ির কোনো ক্ষতি করেছি কি না।

তারপর কয়েকবার কাশি দিয়ে বলে, কেমন আছেন রউফ ভাই, খোঁজখবর নিতে আইলাম। খুব বেশি তো খোঁজ খবর নিবার পারি না। সব ঠিকঠাক আছে তো? বাড়ির হগলে ভালো? হুনছিলাম আপনার আব্বাজান অসুস্থ। উনি এহন কেমন?

—আছে ভালো। তো আপনি কেমন আছেন? আমি বাড়িওয়ালার সঙ্গে যেভাবে সম্মানীয় ভঙ্গিতে কথা বলতে হয়, তেমন করে জিজ্ঞাসা করি।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

—আর ভাই থাকা। এই এটা খাইচ্চোর প্রভোস্ট আইছে, জ্বালাইয়া মারল। ইডা কর উডা কর, ইডা হইল না ক্যান, উডা হইলো না ক্যান। মাঝেমধ্যে মুনে হয়, দিই মুহের উপরে চাকরি ছাইড়া। কথাগুলো বলে, ইবাদুল্লাহ আমার দিকে তাকায় তার মতমতের সমর্থনের আশায়।  

আমি কথা বাড়াই না। ট্রাঙ্কের তালা খুলে সাদা খামটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে সান্ত্বনার মতো করে বলি, কি আর করা বলেন। সব জায়গাতেই এক। শান্তি কোথাও নেই।

একদম নাটক সিনেমার বাড়িওয়ালা।

আমার খুব অবাক লাগে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই ইবাদুল্লাই কি করে আমার কাছে হলের দারোয়ান থেকে বাড়িওয়ালা হয়ে উঠল? সিনেমার বাড়িওয়ালাদের মতো শুধু মুখে পান, গায়ে পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপিটা নেই। লুঙ্গি–গেঞ্জি ঠিকই আছে।

আপনার কোনো অসুবিধা অইত্যাছে না তো? টাকার খামটা নিয়ে মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে বলে ইবাদুল্লাহ।

কিসের অসুবিধা? আমি তো রাজার হালে আছি। বিগলিত ভঙ্গিতে বলি।

কি যে কন ভাই। ইবাদুল্লাহ যেন একটু লজ্জা পায়। তবে সেটা কাটাতে কয়েক সেকেন্ডও লাগে না। তারপর একটু দম নিয়ে বলে, সুজ্জাতের মা থাকলি আপনারে তো থাহনের জায়গা দিব্যার পাইরত্যাম না। নবিরনের বুদ্ধি ভালো। আপনারও সুবিধা অইল। আমারও? কি কন?

মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিই।

নবিরন ইবুর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। প্রথম পক্ষের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে বছর তিনেক হলো নবিরনকে ঘরে তুলেছে। এখনো কোনো ছেলেপুলে নেই এ পক্ষে। প্রথমপক্ষের ছেলের নাম সুজ্জাত। হাফেজি পড়ে হাটহাজারিতে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মাদ্রাসার সামনেই নবিরনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ইবাদুল্লাহর। নবিরনের ছোট ভাইও ওই মাদ্রাসায় পড়ে। কুমিল্লা থেকে ছোট ভাইকে মাদ্রাসায় দিতে গিয়েছিল।  

প্রথম দেখাতেই বোরকার ভিতর থেকে নবিরনের চোখটা ইবুকে কী যেন বলেছিল।
প্রথম দেখার পরই ইবাদুল্লাহ ইবু সেই চোখের ভাষা পড়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল।
এর ছয় মাসেই নবিরন ইবুর দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে ঘরে উঠল। আর তালাকপ্রাপ্তা হয়ে প্রথম স্ত্রীর জায়গা হল শাহরাস্তি ভাইয়ের বাড়িতে।

ইবু অবশ্য খারাপ লোক নয়। সে নিয়মিত হাটহাজারিতে যায়। ছেলের দরকারে টাকা পাঠায়। ছুটিছাটায় নিয়ে আসে। জামা কাপড় কিনে দেয়। সে নবিরনকে নিয়ে পাটি পেতে মেঝেতে ঘুমায়। ছেলেকে দেয় খাটে। হাজার হোক হাফেজ তো! আল্লাহর কালাম আছে ছেলেটার অন্তরে। তাই নামাজও পড়ে ছেলের ইমামতিতে। যে কদিন থাকে যত্ন–আত্তির কোনো কমতি রাখে না।

হাটহাজারি থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত আসতে আসতে নবিরনের বোরকা ছেড়েছে। নবিরনের চোখ দুটো যেমন ছিল এখনো তেমনি জ্বলজ্বল করে। ইবাদুল্লাহ সে চোখের দিকে তাকিয়ে এখনো ভাবে, বিয়েটা সে খারাপ করে নি। তবে আজকাল ইবাদুল্লাহর মনে হয়, নবিরনের চোখ দুটো যতটা না জ্বলে, তার চেয়ে বেশি জ্বালায়। সে কারণে ইবাদুল্লাহ ইবুর বোরকা নিয়ে কোনো খেদ নেই। বলে, ইচ্ছা হইলে পইরবা, ইচ্ছা না হইলে পইরবা না। আমি পরতেও বলি নেই ছাড়তেও বলি না।
তা বইলা তোমার কুনো ইচ্ছা নেই? নবিরন একটু অভিমানের সুরে বলে।

আমার ইচ্ছা হইল, তুমি ভাল থাহো। আর আমার অনেক পিয়ার করো। বোরকায় কিছু যায় আসে না।
তবুও আপনি কি চান? নবিরন চাপাচাপি করে জানতে চায়।

ইবাদুল্লাহ আপ্ত বাক্যের মত বলে, শুনো, মানুষের ইচ্ছারে দমাইয়া রাহন ঠিক না। মানুষির বিবেকই তারে বুঝাইয়া দ্যায়, কুনডা ঠিক আর কুনডা ভুল। কর, তোমার যা ভাল লাগে, কর।

নবিরন এখন কাঁটাবন মার্কেটে বোরকা ছাড়াই যায়; একটা পাখির দোকানে কাজ করে। বেশিরভাগই শাড়ি পরে যায়। তবে মাঝে মাঝে ফুলতোলা সালোয়ার–কামিজ পরে ওড়নাটা বুকের কাছে ফেলে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে কাজে যায়। ‘ডিয়ারিং’ মেয়ে হিসেবে নীলক্ষেত, পলাশি আর কাঁটাবনের সবাই তাকে কমবেশি চেনে।

গত বছর নীলক্ষেত থেকে এক ছিনতাইকারিকে দৌড়ানি দিয়ে পরিবাগে গিয়ে ধরেছিল। বীরত্বের কারণে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির ওসি পাঁচ শ টাকা পুরস্কারও দিয়েছিল তাকে। আর একটা ছবি তুলে রেখেছিল। বলেছিল, থানার নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে রাখবে। পুলিশ আজকাল থানার বোর্ডে শুধু অপরাধীদের ছবিই টানায় না। যারা পুলিশের সহযোগী, তাদের ছবিও টানায়।

এসব গল্প ইবুর কাছে তার বাসায় ভাড়াটে হবার আগেই আমি শুনেছিলাম।

ইবু গল্প বলতে পছন্দ করে। হলের গেটে বসলে তার গল্প না শুনে পার পাওয়া কঠিন ছিল।

তখন অবশ্য ইবু ছিল হলের দারোয়ান, আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

নবিরনের বঁটি হাতে ধাওয়া আর ইবুর ভোঁ–দৌড়ের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার হাঁপ ধরা বুকটা স্থির হলো। বুকের ধড়ফড়ানি কমায় মাথাটাও কাজ করতে শুরু করল। দরজার সামনে কলা-রুটি হাতে আর ঘাড়ে ব্যাকপাক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না।
আমি ঘরে ঢুকলাম।

একটামাত্র শোবার ঘর। ছোট্ট একটা বাথরুম আর রান্না ঘর; এই নিয়ে ইবু নবিরনের বাড়ি। আর বারান্দাটায় আমি সাবলেট বাসিন্দা।

ইবুর প্রথম পক্ষের স্ত্রী আমেনা আগে বারান্দায় কাপড় শুকাতে দিত। এ দিকটায় টানা রোদ পড়ে বলে খুব সহজেই কাপড়চোপড় শুকিয়ে মুচমুচে হয়ে যায়। ঢাকা কলেজের সামনে থেকে দুটো গাঁদার টবও কিনে এনেছিল আমেনা। রোজ পানি দিত। মাঝেমধ্যে খুঁচিয়ে গাঁদার গোড়া আলগা করে দিত আর অপেক্ষা করত কবে ফুল ফুটবে।

তবে গাঁদা ফুল ফোটার আগেই বাসা ছেড়ে আমেনাকে তার ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠতে হয়েছে।
শাহরাস্তির দরবার শরিফের পেছনে যে বাড়িতে এখন আমেনা থাকে, সেখানে ফুল নয়, আতর লোবানের গন্ধে বাতাস ম–ম করে। মাঝরাতে জিকিরের শব্দে আমেনার ঘুম ভেঙে যায়। তখন ইবাদুল্লাহ ইবু নয়, তার ফেলে আসা সংসার নয়, কেবল ছেলেটার কথা মনে হয়।

বারান্দা ঘিরে সাবলেটের ব্যবস্থা নবিরন আসার পরই হয়েছে। সে খুব হিসেবি আর বুদ্ধিমতি। কাপড় শুকিয়ে আর ফুলের টব রেখে যে ট্যাকে কিছু জমে না, সেটা ইবাদুল্লাহকে বোঝাতে নবিরনের দুই দিনের বেশি সময় লাগল না।

ইবুও নতুন বিয়ে করা বউয়ের অমন শক্তপোক্ত পরামর্শ ফেলতে পারল না।  

আমি মাঝেমধ্যে কৃতজ্ঞ হয়ে ভাবি, নবিরনের মতো বুদ্ধিমতি বাড়িওয়ালী আছে বলেই এখনো আমার মতো চাকরিপ্রার্থীরা ঢাকায় টিকে আছে। না হলে কবে ভেসে গিয়ে ভুড়ুঙ্গামারির চরায় আটকে থাকতে হতো।

আমি ঘরে ঢুকে দেখলাম সিলিং ফ্যানটা বনবন করে ঘুরছে; ঘরের কোনায় এনটিভিতে চলছে মধ্যরাতের খবর; মেঝেতে পাটি পাতা, তাতে দুটো মেলামাইনের প্লেট; একটা প্লেট উল্টানো। ভাতের হাঁড়িটা কাত হয়ে পড়ে আছে। গ্লাস গড়িয়ে গেছে মেঝেতে। গ্লাস থেকে পানি পড়ে মাদুরের একদিকে ভিজে গাম্বিয়ার ম্যাপের মত দাগ হয়ে আছে। হয়তো দৌড়ে পালানোর সময় ইবুর পায়ের ধাক্কায় পানিভর্তি গ্লাসটা উল্টে গেছে।
খেতে বসেই কি কিছু একটা ঘটেছে?

খাটের বিছানাটাও এলোমেলো। মনে হচ্ছে এই মাত্র কেউ বিছানা ছেড়ে উঠে গেছে। নাকি ইবু বিছানায় শুয়েছিল, নবিরন ভাত বেড়ে দিচ্ছিল, ঠিক তখনই নবিরন কোন কারণে স্বমূর্তি ধারণ করেছে, আর ইবু বিছানা ছেড়ে দে দৌড়?
যা খুশি হোক, আমার কী?

আমি কাঁধ থেকে ব্যাগপ্যাক, কলা, পাউরুটি চৌকিতে রেখে লুঙ্গি–গামছা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম।
বাথরুমের ছোট্ট ভেন্টিলেটর দিয়ে তাকাতেই রাস্তার ওপারে কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের আলোটা চোখে পড়ল। হলুদ হলুদ আলো। মনে হচ্ছে খুব মায়া করে বাতিগুলো জ্বলছে। কোনো উজ্জ্বলতা নেই, কোনো কিছুকে আলোকিত করার চেষ্টা নেই, কেবল চোখের তারার মত একফালি মায়াময় আলো জাগিয়ে রেখেছে।

আমি রোজ রাতেই গোসল করি। আর গোসলের সময় মহিলা হোস্টেলে চারতলার বারান্দার আলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। শীতশীত জলে আমার গা জুড়িয়ে আসে। চুল ভেজে, গা ভেজে, কোমর, পা ভিজিয়ে দরদর করে নেমে যায় ঝর্ণার পানি। কোথায় গড়িয়ে যায় সে পানি, কে জানে। আমার অদ্ভুত আনন্দ লাগে। কেন লাগে জানি না।
তারানার জন্যই কি ঐ হোস্টেলটা আমার কাছে এত প্রিয় হয়ে উঠেছে?

কত মেয়েই তো ওখানে থাকে। তাদের কথা আমার একবারও মনে আসে না। তারা কেউই আমার না। অতো মানুষের মধ্যে শুধু একজন আছে, যে আমার আপন। এখনো আমি তাকে মনের মানুষই মনে করি।
যদিও বুঝতে পারি, আমি আর তার আপন নেই। সে সরছে। একটু একটু করে সরছে। রোজ সরছে। কারণে অকারণে সরছে। আগে আঙুল বাড়িয়েই যাকে ছুঁতে পারতাম, এখন হাত বাড়িয়েও তার ছোঁয়া পাই না।

ওই বিরাট হোস্টেলটার কোনো একটা রুমে তারানা থাকে। তাকে আমি এখনো ভালোবাসি। তার কারণেই একটা ইটকাঠের দালান আমার খুব খুব আপন মনে হয়। ওদিকে তাকালেই আমার ভেতরে আনন্দের বান ডাকে। সে আনন্দের কোন তুলনা নেই। জীবনের অন্য সব আনন্দ-স্মৃতিকে ঐ একটিমাত্র আনন্দ ম্লান করে দেয়।

রাত ৯টার দিকে আমি ফোন করেছিলাম। তখনই তারানা বলেছিল, হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছে। কাজ শেষ করতে দেরি হয়ে গেছে। নিজের কাজ শেষ করলেও আরও কিছুক্ষণ সে অফিসে থাকে। কাজ শেখে। এখনই তো শেখার সময়। ওপড়ে উঠতে গেলে শিখতে হবে। নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে হবে। ঘাড়ে দায়িত্ব নিতে হলে তো পা শক্ত করতেই হয়।  চলবে...