সিডনি ফিশ মার্কেটে একদিন
মাছে–ভাতে বাঙালি। এই কথাগুলো শৈশবেই বহুবার পড়ানো হয়েছিল আমাদের কখনো ভাব সম্প্রসারণের আবার কখনো বা রচনার বিষয় হিসেবে। সেটা করতে গিয়েই জেনেছিলাম বাংলাদেশে একটি নদীবহুল বদ্বীপ। এখানে তাই বিভিন্ন নদ–নদীতে সারা বছরই বিভিন্ন রকমের মাছ পাওয়া যায়। আর সবুজ খেতে ফলে ধান। তাই বাংলাদেশের জাতীয় খাদ্য ভাত ও মাছ। আমাদের বাড়ি পদ্মা নদীর পাড়ে হওয়ায় এই সত্যটা আরও বেশি করে টের পেয়েছিলাম। সেই ছোটবেলা থেকে তাই মাছের প্রতি একটা আলাদা টান তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে এখনো তরকারিতে মাছই সবচেয়ে বেশি পছন্দের পদ।
প্রবাসে এসেও মাছের প্রতি সেই টানটা অটুট আছে। এখনো স্থানীয় বাংলাদেশি দোকান থেকে ফ্রোজেন ইলিশ, রুই, মৃগেল, পুঁটি, কই, টাকি, ডানকিনা, মায়া মাছ কেনা হয় নিয়মিত। কিন্তু আমার আগ্রহ বেশি একেবারে তরতাজা মাছের বিষয়ে। সেটা পূরণ করা সম্ভব শুধু অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় মাছের মাধ্যমে। এখানে কী কী ধরনের মাছ পাওয়া যায় সেটা দেখার জন্য মিন্টো শপিং মলের মিন্টো ফিশ মার্কেটে যাই প্রায়ই। কিন্তু যেহেতু এদের স্বাদ সম্বন্ধে তেমন ধারণা নেই, তাই অপরিচিত মাছ কিনতে সাহস করি না। বরং পরিচিত তেলাপিয়া আর চিংড়ি কিনি। এর বাইরে কেনা হয় বাড়ামুন্ডি (ভেটকি), মুলেট, হোয়াইটিং, কার্প ইত্যাদি। এক–দুবার অবশ্য শ্যামনও কেনা হয়েছিল। কিন্তু এটা খুবই শুষ্ক, তাই আর কেনা হয়নি। আর বেশির ভাগ সময় কিনি মাছের মাথা। ডাল দিয়ে মুড়িঘন্ট করলে খেতে খুবই সুস্বাদু।
আমি মনে মনে খুঁজছিলাম মাছের আড়ত, যেখানে গিয়ে দুচোখ ভরে মাছ দেখতে পারব। একজন সহকর্মী বলল, তাহলে তুমি সিডনি ফিশ মার্কেটে যেতে পারো। এরপর তার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে কীভাবে যাব সেটা বিস্তারিত জেনে রাখলাম। কিন্তু প্রবাসের ব্যস্ত জীবনে আর অবসর আসে না। অবশেষে গত শুক্রবার সেই সুযোগটা পেয়ে গেলাম। মেয়ের একটা সেমিনার ছিল ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনিতে। সকালে তাকে সেখানে নামিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম সিডনি ফিশ মার্কেট। সিডনির সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে হাঁটাপথে আধা ঘণ্টার পথ। অথবা আপনি লাইট রেইলে চড়েও যেতে পারেন। আমি হেঁটে দুপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে এগোতে থাকলাম।
তীর চিহ্ন দিয়ে কোন দিকে ফিশ মার্কেট, সেটা দেখানো হচ্ছিল। সেটা ধরে যেতেই পেয়ে গেলাম জায়গাটা। এটা সিডনির ডারলিং হারবারের পাশেই। মূল মার্কেটের সামনে বিশাল কার পার্ক। এখানে পার্কিংয়ের ফি দিয়ে গাড়ি রাখা যাবে। মূল ফিশ মার্কেটে তিনটা লোডিং ডক আছে। বিভিন্ন উৎস থেকে মাছ নিয়ে এসে এখানে রাখা হয়। এরপর সেখানে নিলামের মাধ্যমে বিভিন্ন দোকান মাছগুলো পাইকারি দরে কিনে নেয়। নিলামের জায়গাটাতে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। আমি অবশ্য ঢুকে পড়েছিলাম। তখন একজন চৌকিদার আমাকে বললেন, সবুজ রঙের বিশেষ পোশাক ছাড়া এখানে ঢোকা নিষেধ। তখন আমি নিলাম মঞ্চের একটা ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম।
মূল ভবনের প্রবেশপথের দুপাশেই সারি সারি মাছের দোকান। আমাদের দেশের মাছের বাজারে গেলে একধরনের আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায়। তবে এখানকার গন্ধটা ভিন্ন। এই দোকানগুলো থেকে আপনি পছন্দমতো মাছ কিনে কাটিয়ে নিতে পারেন। সেখানে সব রকমের মাছের পাশাপাশি ঝিনুক, লবস্টার ও কাঁকড়াও পাওয়া যায়। তবে দামটা স্থানীয় দোকানগুলো থেকে বেশ সস্তা। কারণ এখান থেকেই স্থানীয় দোকানগুলোতে মাছের সরবরাহ করা হয়। এখানে মাছের দোকানের পাশাপাশি রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে বসে মাছের তৈরি বিভিন্ন পদের খাবার খাওয়া যায়। এখানে একটা ফলের দোকান ও একটা স্যুভেনিরের দোকানও আছে।
এগুলো ঘুরে দেখে একটু হতোদ্যম হয়ে গেলাম। এরপর কার পার্কিংয়ে এসে আমার ভুল ভাঙল। বড় বড় মাছের দোকানগুলো কার পার্কের মধ্যে। সেখানে যে কত রকমের মাছ। আমি ঘুরে ঘুরে সেগুলোই দেখলাম। বিক্রিয়কর্মীরা বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করছিল আমার কী লাগবে। আমি বললাম, ধন্যবাদ, আমার কিছু লাগবে না। এভাবে একটার পর একটা দোকান দেখলাম। একটা জায়গায় দেখলাম কাটাকাটির জায়গাটা আলাদা। সেখানে একটা বিশাল মাছের খণ্ড পড়ে আছে। জিজ্ঞেস করলে জানতে পারলাম সেটা একটা সোর্ড ফিশ। এসব জায়গা থেকে মানুষ পছন্দ করে পরিমাণমতো মাছ কিনে নিচ্ছিলেন। কাছের সুদৃশ্য আলমারিতে অনেক কাটা মাছ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সেগুলো দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে আমার ঘণ্টা দুয়েক সময় ব্যয় হলো। মাছ কিনলে ও ওখানে বসে খাওয়াদাওয়া করলে হয়তোবা আরও কিছু সময় অতিবাহিত করা যেত। আমি আবার ওখানে যাওয়ার কথা ঠিক করলাম। আর পরেরবার অবশ্যই আমি আমার বাচ্চা দুটোকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। বাংলাদেশে একটা কথা আছে, মাছের বাজার। যার সহজ অর্থ করলে দাঁড়ায় অনেক ভিড়ের এবং শোরগোলের একটা জায়গা। কিন্তু সিডনি ফিশ মার্কেট খুবই গোছানো এবং কোলাহলমুক্ত একটা জায়গা। বাংলাদেশে মাছের বাজারের কাছাকাছি গেলেই যে আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায়। সিডনি ফিশ মার্কেটে সেই গন্ধটাও অনুপস্থিত, তবুও মাছের বাজার বলে কথা। তাই আমার আরও বহুবার এখানে যাওয়া হবে মাছের টানে।