স্মৃতিবিজড়িত আমার দেশ
১৪ বছরের সাজানো-গোছানো ঘরসংসারকে ৮টা বড় ব্যাগে ভরে স্বামীর সঙ্গে ছোট দুইটা ছেলে-মেয়েকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম কানাডার উদ্দেশে। বাচ্চা দুইটা হাঁটতে না পারার কারণে বড় ব্যাগের সঙ্গে আটটা ছোট ব্যাগ আনার বিধান থাকলেও ছোট ব্যাগ দুইটা সঙ্গে এনেছিলাম। আমার স্বামী ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ভিসায় মাস্টার্স করতে ম্যানিটোবা ইউনিভার্সিটি, আর তাঁর সঙ্গে আমি ও সন্তানেরা এলাম ভিসিটর ভিসায়। বিদেশে স্বামীর লেখাপড়ার পাশাপাশি সন্তানের সুচিকিৎসার ভাবনায় বেশ আবেগতাড়িত ছিলাম। বাপের বাড়ির আর শ্বশুরবাড়ির কুলের সব আত্মীয়স্বজন, কর্মস্থল, বন্ধুবান্ধব, রাস্তাঘাট, গাছগাছালির মায়া ও মহবতের টান বুকের ভেতরে স্তরে স্তরে প্যাকেট–বন্দী করে নিয়ে চলে এসেছিলাম। সেটা প্রায় ১৭ বছর আগের কথা।
প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতা জীবনে এটাই প্রথম ছিল। প্লেনের জানালা দিয়ে অবারিত নীল আকাশ আর মাঝেমধ্যে তুলতুলে পেঁজা তুলোর মতো পুঞ্জীভূত মেঘমালার ভেসে চলা উপভোগ করছিলাম। অদেখাকে দেখার সে এক অসাধারণ অনুভূতি! তবে বিদেশে নতুন করে বসতি গড়ার এক অজানা আতঙ্ক আমাকে সার্বক্ষণিক গ্রাস করে রেখেছিল। দেশে ফেলে আসা মা-ভাইবোনের মুখগুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। সামনের অজানাকে জানার আনন্দের শিহরণে আর পেছনে ছেড়ে আসা আত্মীয়স্বজনের বেদনার মাঝখানে আমি আচ্ছন্ন হয়ে দুলছিলাম।
হংকং বিমানবন্দরে তারপর ভ্যাঙ্কুভার এয়ারপোর্টে প্লেন বিরতি নিয়ে ম্যানিটোবার উইনিপেগ এয়ারপোর্টে সপরিবার নেমেছিলাম। সেটা ছিল ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাস, রাত ১০টা ৩০ মিনিট। কানাডার অন্যান্য জায়গার থেকে উইনিপেগের শীতকালীন আবহাওয়া তুলনামূলক বেশি ঠান্ডা। সে রাতে অনুভব করেছিলাম হাড়ের ভেতরে অস্থিমজ্জায় জ্বালা করা এক চরম মাত্রার শীত। প্রিন্স, শিপন ভাই আর প্রতীপ (আমার কাছে তারা সবাই ছিল আগন্তুক) এয়ারপোর্টে এসেছিল একটা লিমুজিন ভাড়া করে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বাসায় নিয়ে যেতে। আমার স্বামী বাংলাদেশ থেকেই একটা বাসা ভাড়া করেছিল। আমাদের সবাইকে নিয়ে লিমুজিন নিঝুম রাতের নিরিবিলি রাস্তার দুই ধারে বরফের স্তূপ ভেদ করে ছুটে চলছিল অচেনা আবাসস্থলের দিকে।
জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে শহরটা দেখার চেষ্টা করলাম। যতদূর দুই চোখ গেল, দেখলাম বিস্তৃত ভূমির ওপর বিছানো সাদা ধবধবে বরফের চাদর। চাঁদ–তারা খচিত নীল আকাশের এক নৈসর্গিক আলোতে রাশি রাশি বরফের বিন্দু বিন্দু কণা চিকচিক করছে। রাস্তার ধারে গাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে কখনো আগুন লেগে পুড়ে কয়লার বর্ণ ধারণ করেছে। গাড়িতে বসেই জানতে পারলাম, তীব্র শীতে নাকি গাছ ঠান্ডায় পুড়ে মরা গাছের মতো হয়ে যায় এবং গ্রীষ্মের একটুখানি ছোঁয়া পেলেই এ ঠান্ডায় জমে থাকা মরা গাছ আবার পাতা, ফুল, ফলে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। আমার অভিজ্ঞতায় সম্পূর্ণ অচেনা দেশ কানাডা। বিচিত্র আবহাওয়া, ভিন্ন ভাষা, অচেনা পরিবেশ, অজানা মানুষ—সবকিছু মিলে আমার আমিত্বকে প্রচণ্ড অসহায় লাগল। স্বামী-সন্তান পাশে থাকলেও বুকের মধ্যে দেশের জন্য কেমন যেন হাহাকার করে উঠল। গাড়ির মধ্যে অন্যদের লুকিয়ে–ছাপিয়ে বারবার চোখের পানি মুছতে লাগলাম। সেই যে বিদেশের মাটিতে শুরু হলো আত্মীয়স্বজন ছেড়ে শূন্যতার হাহাকার এবং একাকিত্বের বেদনা। যার সাক্ষী হিসেবে কত যে হা-হুতাশ আর চোখের পানি ঝরিয়েছি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস।
উইনিপেগের ইউনিভিলেজ অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় আমাদের বাসা ছিল। তখন ওখানে ভাড়াটিয়া হিসেবে মোটামুটি ম্যানিটোবা ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন দেশের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা বসবাস করত। আস্তে আস্তে গুটিকয় বাঙালি পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলো। তাদের কেউই আমার পূর্বপরিচিত বা রক্তের সম্পর্কের কিংবা কোনো প্রকার আত্মীয়তার সূত্রে আত্মীয় ছিল না। সুখে–দুঃখে তাদের সঙ্গেই মিলেমিশে আত্মীয়ের বন্ধন তৈরির চেষ্টা চলত সর্বক্ষণই। কিন্তু তারপরও এ দূর পরবাসী জীবনে স্বজনহীন একাকিত্ব আমাকে প্রতিমুহূর্তে আষ্টেপৃষ্ঠে কাতর করে রাখত। কোনো কিছুই ভালো লাগাতে পারতাম না। খুব বেশি মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনদের মনে পড়ত। কলকার্ড কিনে দেশে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতেই কার্ডের টাকা ফুরিয়ে যেত। তখন ছিল না ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, অথবা ইমোর মতো যোগাযোগের ফ্রি অ্যাপগুলো। বুকের হাহাকার আকুতি বুকের মধ্যেই রাশি রাশি বরফের মতোই স্তূপকৃত হয়ে জমে থাকত।
বাসার লিভিংরুমে একটা প্রশস্ত জানালা ছিল। যেটা দিয়ে আমি আর আমার বাচ্চা দুইটা বাইরের জগৎ দেখতাম। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি বরফ প্রায় গলে যাওয়ার পথে। ঝাঁক বেঁধে শীতের পাখিদের আকাশে উড়ে যাওয়া দেখে মনে হতো, পাখিগুলো কি আমার প্রাণের জাহাঙ্গীরনগরের লেকের পানির ছোঁয়া নিয়ে এখানে এসেছে! মনের মধ্যে সে এক অদ্ভুত আনন্দ বয়ে যেত পাখিগুলোকে দেখতে। জানালার ঠিক সামনে বাড়ির মেহেদি বা ডালিমগাছের মতো আকৃতির গাছটাতে অনেক চড়ুইয়ের আনাগোনা দেখা দিল। আমার এই চিরচেনা চড়ুইয়ের একসঙ্গে কিচিরমিচির শব্দ, ফুড়ুৎ-ফুড়ুৎ করে এক ডাল থেকে আরেক ডালে নাচানাচি, ডাকাডাকি আমার ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতির সাক্ষী হয়ে মনটাকে মোহাবিষ্ট করে রাখত। ওই পাখিদের সঙ্গে আমাদের দেশের পাখিদের রং, চেহারা বা আকার–আকৃতির মিল খুঁজে ফিরতাম।
গ্রীষ্মের ছোঁয়াতে গাছগাছালি উজ্জীবিত সবুজ শ্যামল পরিবেশ। ডাবল স্ট্রোলারে করে বাচ্চা দুইটাকে নিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করার সময় ঘাসের ফাঁকে থানকুনি গাছের মতো দেখতে পাতা ছিঁড়ে একটু গন্ধ শুঁকতাম। কখনো ঝির ঝির বাতাসে হেলেদুলে নেচে ওঠা গাছের একটা পাতা চোখের কাছে ধরে ভালো করে পরীক্ষা করতাম দেশের কোনো গাছের পাতার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় কি না। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া কাককে বলি, ‘ওগো পাখি, আমার মমতাময়ী মাকে বলো, আমার পরান পুড়ে যায় শুধু তাকে একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য!’ আকাশে প্লেন দেখলে মনে হতো কত দূরে আমি চলে এসেছি, আর কবে কীভাবে আমি ফিরে যেতে পারব আমার জন্মভূমি—আমার ভালোবাসার বাংলাদেশে।
আমার ঘনিষ্ঠ সহপাঠী ফরিদার ভাগ্নে শিপলুকে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছিলাম। খালাতো ভাইয়ের স্পনসরের আহ্বানে শিপলু সপরিবার ইমিগ্র্যান্ট ভিসাতে এই সাস্কাটুন শহরে বসবাসের উদ্দেশ্যে সপ্তাহ দুয়েক হলো এসেছে। ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে ছেড়ে আসা স্বদেশের প্রতি ওর সীমাহীন মমত্ব বোধ ও আকুতি প্রকাশ করল। সবার কাছ থেকে শোনা ও শেখা বাণী দিয়ে আমিও ওকে বিভিন্ন ভাবে আশ্বাস দিলাম। আমি ওকে সান্ত্বনা দিলাম, এই প্রবাসজীবনেই তার একদিন একান্ত বন্ধুত্ব এবং আত্মার পরম সব আত্মীয় গড়ে উঠবে।
ফোনটা রেখে ভাবলাম, আসলেই কী অদ্ভুত এই জন্মভূমির টান! আমি এখানে স্বামী-সন্তান নিয়ে ঘুরি–ফিরি, আনন্দ করি। তা ছাড়া আছে বেশ কতগুলো পরম বন্ধু–সম্পর্কিত বাংলাদেশি পরিবার। প্রায় প্রতি সপ্তাহে আমরা গ্রুপের সবাই মিলে বিভিন্ন ধরনের আনন্দঘন পার্টির আয়োজন করি। কিন্তু এত আনন্দের মধ্যেও মনটা পড়ে থাকে আমার জন্মভূমি সুদূর বাংলাদেশে। এখানে নিজের অর্জিত টাকার বাড়িটাকে যতটুকু না আপন করে ভাবতে পারি, তার চেয়ে এখনো বেশি আপন করে ভাবি আমার মা-বাবা-ভাইবোনদের সঙ্গে কাটানো শৈশব–কৈশোরের বাড়িটাকে। এত বছর বসত করার পরও খুঁজে ফিরি আমার দেশের গাছগাছালি, রং–বেরঙের পাখির কিচিরমিচির, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ আরও কত কিছু।
যে দেশে আমার জীবন চলতে জন্ম হয়েছে কত শত সুখ-দুঃখের কাহিনি। হৃদয়ের কোটরে সেসব কাহিনি সাজিয়ে রেখেছি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায়! যেখানে আমার সব আত্মার আত্মীয়ের বসবাস। পাশাপাশি যেখানে আমার অস্তিত্বের জন্ম। যে দেশকে পেছনে ফেলে এই দূর দেশে আমি একজন অচেনা পথিক। আমার আত্মা-আমার অস্তিত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে যে দেশের মাটিতে, সে আমারই বাংলাদেশ, সে দেশের জন্য মনটা তো আমার সব সময় পড়ে থাকবেই। দেশের জন্য মায়া–মমতায় ভরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা আমার অজস্র স্মৃতিসম্ভার বহমান হোক আজন্মলালিত স্মৃতি হয়ে।