ত্যাগের মহিমায় ঈদ, চিকিৎসকের গল্প
পবিত্র ঈদুল আজহার কয়েক দিন আগে কয়েক বন্ধু মিলে নার্সদের স্টেশনে বসে আলাপ করছিলাম কাজের ফাঁকে। মূল কথা হচ্ছিল ঈদের দিন আমার ছুটি, কী কী করব এসব নিয়ে। স্বস্তি ও আনন্দের মাঝামাঝি গল্প। এর মধ্যে বন্ধুর অবাক করা দৃষ্টি দেখে মুখ তুলে সামনে তাকালাম। দেখি, আমার একজন রোগী সামনে দাঁড়ানো। তাঁর আরও কিছু প্রশ্ন আছে। ৪৫ মিনিটে সবকিছু বুঝিয়ে বাইরে এসেছি, কিছু অর্ডার লিখে তারপর অন্য রোগী দেখতে যাব। একই জায়গায় এতটা সময় ব্যয় করলে অনেক কষ্ট হবে কাজ শেষ করতে। তবু গেলাম। রুমে ঢুকে দেখি কাঁচুমাচু মুখে এক কোনায় একটা মেয়ে বসে আছে। রোগীর স্ত্রীও পাশে বসা। পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর রোগীকে জিজ্ঞাসা করলাম তাঁর মেয়ের সামনে রোগের সব কথা বলা যাবে কি না। রোগী তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত নেড়ে বললেন, যা ইচ্ছা বলতে পার। প্রশ্নগুলো জেনে নিয়ে আবার ধৈর্য ধরে সব বোঝালাম। তারপর চলে যাব—এমন সময় রোগীর বিরক্তিকর প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়ালাম।
কি ফেস্টিভ্যাল নিয়ে কথা বলছিলে তুমি? বললাম পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। সে ততোধিক বিরক্ত হয়ে বলল, শুধু শুধু পশু কোরবানি করে কী লাভ? মাংস তো অন্যভাবেও খাওয়া যায়। আর গরিবকে খাওয়ার জন্য টাকাপয়সা দিয়ে দিলে কি হয়? সবকিছু নিয়ে ঝামেলা করা তোমাদের একটা অভ্যাস। একই প্রশ্ন ১০ বার জিজ্ঞাসা করে লম্বা একটা কাজের দিনকে যথেষ্ট লম্বা তিনি করেছেন। তারপর না জেনেশুনে যা মনে এসেছে বলে বসেছেন। আমি বসলাম তাঁর বিছানার পাশে। তারপর পবিত্র হজের তাৎপর্য বোঝালাম। সৎ হৃদয়ে একতা এবং বিশ্বাস স্থাপনের অঙ্গীকার নিয়ে জীবনে একবার পবিত্র হজ পালন করতে হবে। তারপর বললাম হজ শেষে পশু কোরবানির তাৎপর্য নিয়ে। কোরবানি ফরজ শুধু তাঁদের জন্য, যাঁরা জাকাত দিতে সক্ষম। এটা আমাদের সবচেয়ে বড় দুটো উৎসবের একটি। চলে আসার সময় এ কঠিন লোকটার চোখে অন্য রকম কোনো আলো কি দেখেছিলাম? পরদিন কোনো ঝামেলা ছাড়াই তিনি বাসায় চলে গেলেন। সুস্থ এবং খুব ভদ্র ব্যবহার করে।
ঈদের আগের দিন কাজের ফোনে একটা ফোনকল পেলাম। একটা খুব জরুরি চিঠি আমার নামে এসেছে। আমি অবশ্যই যেন সেটা সংগ্রহ করি। রীতিমতো তিতা চেহারার করে গেলাম। প্রেরকের নাম পড়ে তো মাথা গরম। সেই সব সময় কটকট করে বিরক্ত করা বুড়া, যাকে আমার ঈদের তাৎপর্য বোঝাতে হয়েছে এবং বাসায় গেছেন তিনি মাত্র সেদিন। কী কারণে এখন আবার চিঠি লিখছেন? খুলে দেখলাম চিঠি। চিঠিটা ছিল এমন
‘আমার আদরের ডাক্তার মা–মণি
মানুষের শেখার বোধ হয় কোনো শেষ নেই। তাই জীবনের অন্তিম সময়েও ভিনদেশি এক মেয়ের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখলাম আমি। সেদিন যে মেয়েটিকে রুমে দেখেছিলে সে আমার স্ত্রীর আগের ঘরের মেয়ে। ওর বাবা মারা যায় মেয়েটার বয়স যখন পাঁচ বছর। অনেক সম্পদ রেখে যায় ওর বাবা। ওর মা তখন শোকে দিশেহারা। ছোট্ট মেয়ে নিয়ে কোনো সাহায্য ছাড়া কীভাবে চলবে ভেবে প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা। আমি তখন তাকে বিয়ে করে অভিভাবক হতে রাজি হই। কিন্তু শর্ত ছিল সম্পত্তি যা আছে সবকিছুর দায়িত্ব আমার হাতে ছেড়ে দিতে হবে।
শহরে ওদের তখন ওষুধের দোকান, সঙ্গে গ্যাস স্টেশনসহ বেশ কিছু চালু ব্যবসা। আমার স্ত্রী যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন আমি দায়িত্ব নেওয়াতে। কিন্তু ওর আগের ঘরের মেয়েকে আমার নিজের করে কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। তার থাকার কষ্ট, খাওয়ার কষ্ট নিশ্চিত করতে অনেক কিছু আমি করেছি। তাকে কলেজে পড়ার খরচ আমি দিইনি। নিজে কাজ করে পড়ছে। বাসায় থাকতে পর্যন্ত দিইনি ১৮ বছরের পর। তার মা কষ্ট পেলেও মাথার ওপর ছায়া হারানোর ভয়ে টুঁ শব্দটি করেনি। তারপর আমাদের আরও দুটো মেয়ে হয়েছে। তাদের সঙ্গে ব্যবহার আমার সৎমেয়ের সঙ্গে ব্যবহারের পুরো বিপরীত আমার। কারণ, ওরা আমার নিজের হৃদয়ের অংশ। এত দিনে সবকিছু নিজের নামে করে নিয়েছি। সৎমেয়ে সেদিন যাকে দেখেছ আমার রুমে, সে কিন্তু তবু খোঁজ রাখে আমার আর তাঁর মায়ের, যতটুকু সে পারে।
তোমার সঙ্গে সেদিন কথা বলার পর আমার চোখ খুলেছে। আমার সৎমেয়ের বাবা কত কষ্ট করে এত সম্পদ করেছিলেন। নিশ্চয় মেয়ের সুখ–শান্তির কথা চিন্তা করে। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় নিশ্চয় তাঁর অনেক কষ্ট হয়েছে তাঁর মেয়ের কথা চিন্তা করে। মেয়ে তো আমারও আছে। কেন বুঝিনি তার হৃদয়ের কষ্ট?
তাই তোমার কথা শোনার পর ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়েও নিজের পশুত্বকে কোরবানি করে দিয়েছি। সব সম্পত্তি সমান ভাগ করে তিন মেয়েকে উইল করে দিয়েছি। এ ঘটনা মা তোমার জানা উচিত। খুব ভালো থেকো আর রোগীর সেবা করে যেয়ো সারাজীবন, কেমন?
ইতি
একজন পরিবর্তিত বাবা।
রৌদ্রোজ্জ্বল অসম্ভব সুন্দর একটা দিন আজকে। নিজের পশুত্ব বিসর্জন দেওয়া একজন বাবার গল্পে আলোকিত একটা ঈদ হয়েছে আমার এ বছর। আপনাদের? সবাইকে ঈদ মোবারক।