তোমাকে আসতেই হবে
আমি ফাগুন। ফাগুন মাসে জন্ম, তাই আম্মু শখ করে ফাগুন রেখেছিল। সাহিত্যমনা আম্মুকে আমি অনেক জ্বালিয়েছি, ছোট বোনটাকেও। রাগী ডাক্তার আব্বুর সঙ্গে কোনো দুষ্টুমি করেই পার পেতাম না। মায়ের ব্যাপারগুলো একটু খুলেই বলছি।
পড়াশোনায় একটু ফাঁকিবাজ ছিলাম ছোটবেলায়। বকাবকি লেগেই থাকত। রাগ করে একদিন আম্মুকে টেক্সট করলাম, ‘তুমি একটা গরু।’ শেষের একটা ডিজিট পার্থক্য থাকাতে টেক্সট চলে গেল আব্বুর কাছে। ডাক্তার আব্বু তখন রোগীর সঙ্গে ছিল। তুমুল রাগ করে বাসায় ফিরে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টা চিৎকার করেছিল—আমি কত বড় বেয়াদব। আম্মু না বলতে পারে এটা আব্বুর জন্য ছিলই না, না বলতে পারে অন্য কিছু।
দুই বছরের ছোট বোন আবার পড়াশোনা করে আমার মানসম্মান ডুবাতে ছিল ওস্তাদ। ওর জন্য একদিন বকা খেলাম তুমুল। একই বিষয় ও তোর ছোট হয়ে সব সময় কী কষ্ট করে পড়াশোনা করে আর তুই বড় ভাই হয়ে বাঁদরামি করিস। লজ্জা নেই? আমি এইটে পড়ি তখন আমি আর বনু ক্লাস সিক্সে। রাতে সে ঘুমাতেই চুপি চুপি ওর ফোন হাতে নিয়ে ওর সবচেয়ে কাছের মেয়ে বন্ধুকে লিখলাম, ‘সামরিন, আই হেইট ইউ’ আর ওর সবচেয়ে কাছের ছেলে বন্ধুকে টেক্সট করলাম, ‘কাব্য, আই লাভ ইউ।’ পরের দিন বনু চোখের পানিতে নাকের পানিতে একাকার, টিফিন টাইমে দেখলাম সামরিনের পেছন পেছন যাচ্ছে বলছে, বিশ্বাস কর ভাইয়া, মনে হয় এসব লিখেছে। তুই তো আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী। তোকে কেন হেট করব? আর কাব্যর বাবা–মা নাকি আর্মিতে। ওরা নাকি কাব্যর পিঠের ওপর স্কেল ভেঙেছে। বলেছে এই বয়সেই লাভ ইউ? তোর ভবিষ্যৎ তো ঝরঝরা।
এসব ঘটনা জানাজানির পর নিজের ফোন খোয়ানোসহ কয়েকটা চড় খেয়ে আম্মুর ওপর প্রতিশোধ নিলাম। আম্মুর ফোন নিয়ে রাত একটায় আম্মুর এক ছেলে ক্লাসমেটকে লিখলাম আই লাভ ইউ। সেই মামা তক্ষুনি আম্মুকে ফোন করল খুব উদ্বিগ্ন হয়ে, সোমা কি হয়েছে তোমার? ফোন ধরল আব্বু। কারণ, আম্মু তো ঘুমে। ডাক্তার মানুষ, ঘুম পাতলা। আব্বু মামাকে বলেই দিল, সোমা কি টেক্সট করবে, নিশ্চয়ই এটা আমার ছেলের কাজ। তুমি কিছু মনে কোরো না ভাই।
রঙিন এসব দিন শেষে আমেরিকাতে চলে আসতেই হলো আমাকে কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে। যেই আমি সব সময় চিন্তা করতাম কেমন করে সবার জীবন তেজপাতা করা যায়, সেই আমিই দেখলাম দেশকে মিস করছি ভীষণ। এমন সময় ফারিহা এলো আমার জীবনে। মন খারাপের দিনগুলো ওর সাবলীল উপস্থিতি আর বন্ধু হিসেবে একটা সোল্ডার এগিয়ে দেওয়া আমাকে মুগ্ধ করেছে। প্রথম দুই বছর বন্ধুত্ব, এরপর বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু। ফারিহার জন্ম আমেরিকাতেই। ওর মা–বাবা বাংলাদেশি। এই মেয়ে কী সুন্দর দেশের খোঁজখবর রাখে। আমি বাংলাদেশি শুনেই নাকি ওর ভালো লাগা বেড়েছে। ও সব সময় বলে, ফাগুন আমরা এ দেশে থাকব কিন্তু ঢাকায় বেড়াতে যাব। শুনেই আমি হেসেছি। আরে কী বলে এই মেয়ে? দেশে আমার শিকড়। এর মধ্যে দেশে শুরু হয়ে গেল জুলাইয়ের ঘটনা। ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আমি দেশে চলে এসেছি। থাকতাম শাহবাগ। আব্বু–আম্মু এমনকি বনুটাও পথে নেমেছিল। কী উদ্বেগপূর্ণ দিনগুলো। আশ্চর্য ব্যাপার হলো ফারিহার মুখটাই শুধু মনে পড়ত আমার। চলে আসার আগে আগে ওকে বলে এসেছিলে বেঁচে থাকলে দেখা হবে। ফারিহা বলেছিল তোমাকে আসতেই হবেই।
অগাস্টে আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিলেন। একজন নোবেলজয়ী স্কলার, পুরো পৃথিবীতে তাঁর মতো মাত্র দশজন আছেন। এরপর আমাদের আমেরিকাসহ সব পরাশক্তির কাছে আমাদের অবাধ আনাগোনা। ওরা আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দেয়। তিনি বলেছেন, আমরা সবাই একক শক্তি। এতজনকে মেরে ফেলেও আমাদের একতায় ফাটল ধরেনি। দেশকে ভালোবাসি যে আমরা।
দেশ স্বাধীন করেছেন বঙ্গবন্ধু, তাঁর নেতৃত্বে, পরে দেশে দুর্ভিক্ষ আর অচলাবস্থাটুকু আমরা রিসেট করি (মানে দুঃসময়টুকু)। তেমনি যেকোনো স্বৈরাচার সরকারের ভালো কাজটুকু রেখে দুঃশাসন ডিলিট করে দেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে চলি। কী অপূর্ব চিন্তা। খারাপ সময় বাদ দিয়ে উন্নয়নটুকু করতেই হবে। সবার জীবনেই রিসেট বাটন আছে। মাঝেমধ্যেই চাপ দিতে হয়। ভালো সময়ের জন্য।
আর নিজের জীবনের রিসেট বাটনেও চাপ দেওয়ার সময় এসেছে। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ফারিহা, ওর কাছে চলে যাব আমি। ঠিক করেছি আমেরিকাতেই থাকব। পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করব ফারিহাকে। আমরা প্রতিবছর একবার দেশে বেড়াতে আসব। নিজেকে ভালোবাসা, সঙ্গে প্রিয়জনকে ভালো রাখা—এই ফাগুনের প্রতিজ্ঞা।