রন্ধনশিল্পে সমৃদ্ধ পর্তুগালের পোর্তো শহরে একদিন: প্রথম পর্ব

পর্তুগালপ্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্য রাজীব আল মামুনের সঙ্গে লেখক

জীবনে অনেক কঠিন সময় পার করেছি, তবে সাম্প্রতিককালের মতো খারাপ মুহূর্ত এর আগে বোধ হয় আসেনি কখনো। লেখাপড়ায় কোনোভাবে মনোযোগ নেই, একাডেমিক রেজাল্টের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। ক্রিস্টোফার নোলানের পরিচালনায় নির্মিত ইন্টারস্টেলার সিনেমা দেখার পর মডার্ন ফিজিকসের ওপর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। বয়স তখন আঠারোর নিচে, অনেকটা আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো কিছু বিবেচনা না করে ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকসের ওপর ব্যাচেলর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তব জীবন কোনো ধরনের সায়েন্স ফিকশন সিনেমা নয়, বাস্তব বড় নির্মম। এখন এ ফিজিকসকে গলার কাঁটা মনে হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারিনি, তাই মাঝেমধ্যে পরিবার, পরিজন কিংবা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে টিপ্পনীর শিকার হতে হয়।

বাদু নামক এক ডেটিং অ্যাপের বদৌলতে কয়েক মাস আগে আলিওনা নামক এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয়। আলিওনার জন্ম রাশিয়ায় হলেও বর্তমানে স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভায় তাঁর বাস। বয়সে আলিওনা আমার চেয়ে ছয় বছরের ছোট। তারপরও দীর্ঘস্থায়ীভাবে সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য আমরা উভয়ই একমত হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত আলিওনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। এ নিয়েও আমার মধ্যে বড় ধরনের হতাশা আছে।

যাহোক এ ধরনের ক্রান্তিকালীন মুহূর্ত থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করছি এবং সে অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা চালাচ্ছি।

ফেসবুকে লেখালেখির সুবাদে বছরখানেক আগে রাজিব আল মামুন নামক এক প্রবাসী বাংলাদেশি ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। রাজিব ভাই প্রায় ১০ বছর পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে আছেন। লিসবনে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছে তিনি অবশ্য মোহন নামে বেশি পরিচিত। তিনি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। পাশাপাশি তিনি পর্তুগালের বর্তমান ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্য। এ ছাড়া একজন লেখক ও আবৃত্তিশিল্পী হিসেবেও পর্তুগালে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। কয়েক দিন আগে মোহন ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তাঁর কাছ থেকে পর্তুগাল ঘোরার আমন্ত্রণ পেলাম। কয়েক মাস ধরে বুকের ভেতরে জমে থাকা দুঃখ, হতাশা আর বেদনাকে দূর করার পাশাপাশি নিজেকে মানসিকভাবে চাঙা করতে মোহন ভাইয়ের আমন্ত্রণে তাই শেষ পর্যন্ত পর্তুগাল ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম।

সাও বেন্তো রেলস্টেশন, পর্তুগালের সবচেয়ে পুরোনো রেলস্টেশনগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম

এর আগেও একবার লিসবনে গিয়েছিলাম। তাই লিসবনকে ঘিরে খুব একটা আগ্রহ ছিল না, মূলত পোর্তো ভ্রমণের উদ্দেশে এবার আটলান্টিক মহাসাগরের কন্যা হিসেবে পরিচিত ইউরোপের সবচেয়ে পশ্চিমের দেশ পর্তুগালের উদ্দেশে যাত্রা করা।

পোর্তো পর্তুগালের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। একসময় পর্তুগালের প্রধান বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে এককভাবে পোর্তোর নাম উচ্চারিত হতো। বিশেষ করে ভোজনরসিকদের কাছে শহরটি বেশ প্রসিদ্ধ। পর্তুগালের রন্ধনশিল্পের রাজধানী হিসেবে পোর্তোকে অভিহিত করা হয়। পোর্তোর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ২০০৪ সালে, তখন ক্লাস টুতে পড়ি। ছোটবেলা থেকে ফুটবলের প্রতি আগ্রহ ছিল। ২০০৪ সালে গোটা বিশ্বকে অবাক করে পোর্তোর মতো একটা সাদামাটা ফুটবল ক্লাব চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা জিতে নেয়। রাতারাতিভাবে হোসে মরিনহোর নাম বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানের একটা ফুটবল ক্লাবকে তিনি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়েছেন, রীতিমতো যে বিষয়টি ছিল সবার কাছে অত্যন্ত বিস্ময়কর।

স্লোভেনিয়ার লুবলিয়ানার সঙ্গে লিসবন কিংবা পোর্তোর সরাসরি ফ্লাইট সংযোগ নেই, এ কারণে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট থেকে লিসবনে উড়াল দিতে হলো। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ জ্বালানির জন্য মোটাদাগে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পরও রাশিয়াকে কোনোভাবে দুর্বল করা যায়নি, উল্টো ইউরোপের বাজারে আজ অচলাবস্থা নেমে এসেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। ইউরোপে ধীরে ধীরে জ্বালানির সংকট প্রকট হচ্ছে। এর আগে যখন বুদাপেস্ট থেকে লিসবনে ফ্লাই করেছিলাম, তখন উড়োজাহাজের টিকিট বাবদ আমাকে ৬৭ ইউরো খরচ করতে হয়েছিল। কিন্তু এই যাত্রায় শুধু টিকিটের ভাড়া হিসেবে আমাকে ১৮৭ ইউরো খরচ করতে হয়।

পোর্তোর অলিগলি

মূলত মোহন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতেই লিসবনে পা রাখা। পর্তুগালের স্থানীয় সময় বেলা আড়াইটার দিকে ফ্লাইট লিসবনের পোর্তেলা বিমানবন্দরে অবতরণ করল। প্লেন থেকে নেমে সবার প্রথমে মোহন ভাইকে টেক্সট করলাম। মোহন ভাই আমাকে মাত্রিম মোনিজে আসতে বললেন। লিসবনের গণপরিবহনের মান বেশ ভালো, মেট্রোর সাহায্যে পুরো লিসবন ঘোরা যায়। ৬ দশমিক ৮০ ইউরো হলে এক দিনের পাস সংগ্রহ করা যায় এবং এ পাসের সাহায্যে মেট্রোর পাশাপাশি বাস ও অন্যান্য গণপরিবহন ব্যবহার করা যায়। বিমানবন্দর থেকে বাইরে বের হয়ে মেট্রোতে চেপে সরাসরি মাত্রিম মোনিজের পথে পা বাড়ালাম। মাত্রিম মোনিজের মেট্রো স্টেশন থেকে বাইরে বের হতে না হতে মোহন ভাইয়ের দেখা পেলাম। তিনি স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন।

মাত্রিম মোনিজ

মাত্রিম মোনিজের অবস্থান বলতে গেলে লিসবনের সিটি সেন্টারের খুবই কাছে, মাত্রিম মোনিজের মেট্রোস্টেশন থেকে বের হয়ে উত্তর দিক বরাবর কয়েক গজ হাঁটলে রুয়া দো বেনফোরমোসো নামক একটি স্ট্রিটের দেখা মিলবে। লিসবনের বেশির ভাগ বাংলাদেশির বাস এ স্ট্রিটের আশপাশে। এ এলাকায় পা পড়তে না পড়তে আমার চোখের সামনে ঢাকা শহরের কোনো একটি এলাকার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল। চারদিক থেকে বাংলা ভাষার শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, দেশি পোশাকে মানুষজন রাস্তার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন। আর রেস্তোরাঁগুলো থেকে ভেসে আসছে মসলার গন্ধ, এ গন্ধে পুরো রুয়া দো বেনফোরমোসা ম–ম করছে।

স্লোভেনিয়ায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা একেবারে হাতে গোনা। তাই রুয়া দো বেনফোরমোসোতে পা পড়তে না পড়তে আমি কিছু সময়ের জন্য একেবারে নস্টালজিক হয়ে উঠলাম। বারবার নিজ দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু এ বছর ফ্লাইটের টিকিটের দাম আকাশচুম্বী। তাই শেষ পর্যন্ত দেশে যাওয়া হয়নি।

পর্তুগালের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার বোলহিনোস দি বাকালাও বা কডফিশের কাটলেট

পরের দিনটি ছিল সেই বহুল প্রতীক্ষিত দিন। লিসবনের সেতে রিওস থেকে সকাল সাড়ে ছয়টার বাসে সরাসরি পোর্তোর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার জার্নি শেষে আমাদের বাস পোর্তোতে পৌঁছাল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কৌচসার্ফিং-এর বদৌলতে আমার সঙ্গে এক পর্তুগিজ ভদ্রলোকের পরিচয় হয়। নাম দান্তে এবং তিনি বর্তমানে একটি কোম্পানিতে ব্যবস্থাপক পদে কাজ করছেন। দান্তের বয়স ৬৩ বছর। দান্তে আমার জন্য ত্রিনিদাদ রেলস্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। লিসবনের মতো পোর্তোরও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম অত্যন্ত উন্নত। পোর্তোর ক্যাম্পো ২৪ আগোস্তো বাসস্টেশন থেকে ট্রেনে মাত্র দুই স্টপেজ দূরত্বে ত্রিনিদাদ রেলস্টেশনের অবস্থান। ত্রিনিদাদে স্টেশন থেকে বাইরে বের হতে একটি এটিএম বুথের দেখা মেলে। দান্তের সঙ্গে সেখানে দেখা হয়। দেখা হওয়ামাত্র তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কাঁধে ব্যাগ ঝুলছিল। দান্তে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামাতে বললেন। রেলস্টেশনের ভেতর লকার ছিল। করোনার সময় থেকে নগদ টাকার ওপর নির্ভরতা একেবারে কমিয়ে দিয়েছি, এ কারণে যেখানে যাই সব সময় ব্যাংক কার্ড বা পেপলের মাধ্যমে সবকিছুর মূল্য পরিশোধ করার চেষ্টা করি। তবে লকার ব্যবহারের জন্য কোনোভাবে ব্যাংক কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করতে পারছিলাম না। তাই স্টেশনের ভেতর এটিএম বুথ খুঁজতে থাকলাম, যাতে কিছু ক্যাশ তোলা যায়। দান্তে বিষয়টি লক্ষ করলেন এবং আমাকে বললেন, তুমি আমার অতিথি। পোর্তোতে তোমার যা খরচ হয়, সব আমি পরিশোধ করে দিচ্ছি।

লকারের ভেতর ব্যাগ রাখামাত্র দান্তে বললেন, ‘আজকে আমাদের অনেক হাঁটতে হবে। তুমি রেডি তো?’ দান্তের সঙ্গে পুরো পোর্তো ঘুরতে বের হলাম। চলবে...

লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া