অতৃপ্ত ধারা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ঘটনাটি আমি যদি না জানতাম, তাহলে হতো না? আজ কেন ঠিক তেমনই এক মা আমার সামনে পড়লেন? দুর্দান্ত আগ্নেয়গিরির লাভার মতো আমাকে গ্রাস করতে তাড়া করে ফিরছে, এই ৯ হাজার কিলোমিটার দূরেও কেন ঘটনাটা আমাকে আক্রমণ করছে, এমন কেন হচ্ছে—নিজের কাছেই জীবনের এসব প্রশ্ন তাঁর।

জগতে মায়ের কি কোনো নিয়ম আছে? মানুষের নিয়ম বড়, না মা বড়? এই মায়ের সন্তানরাই তাঁদের মায়ের জন্য তৈরি করেন নানা রকম রীতি। কখনো মনের অজান্তেই হা হা করে তিনি হেসে ওঠেন।

সদ্য অবসর নেওয়া সগির সাহেব তাঁর স্ত্রীসহ স্থায়ীভাবে সিডনিতে চলে এসেছেন। তাঁদের দুই মেয়ে আর এক ছেলে। এই তিনজনই বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী। তাই পারমানেন্ট রেসিডেন্ট হতে তেমন জটিলতায় পড়তে হয়নি। বর্তমানে তিনি সিডনির ইস্টলেকসে বড় মেয়ে আফসানার বাসায় আছেন। মা-বাবাকে নিয়ে সেদিন বিকেলে আফসানা বাসার সামনে পার্কে বেড়াতে আসে। এটি জ্যাক মানডে রিজার্ভ-চারপাশে বসার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু সগির সাহেব বসতে চাচ্ছেন না। কী একটা দৃশ্য সবার মধ্যে বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। তিনি বললেন—

তোমরা মা-মেয়ে বসে গল্প করো, আমি পার্কটা একটু ঘুরে দেখি।

অস্ট্রেলিয়ান একটা মেয়ে তাঁর দুই বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে পার্কে এসেছেন। মেয়েটাকে দেখিয়ে মা-মেয়ে কী যেন বলতে গিয়েও বাবার দিকে তাকিয়ে আর বললেন না। দৃশ্যটা সগির সাহেবের চোখে আটকে গেল যেন। ছেলেটাকে দোলনায় বসিয়ে একটু পরপর দোল দিচ্ছে ওই মেয়ে। কী একটা ইঙ্গিত এখানে আছে। তিনি হাঁটছেন বটে, কিন্তু একটু পরপর বেঞ্চিতে বসে থাকা মা-মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন। তাকাচ্ছেন দুলতে থাকা ছেলেটার দিকে। তারপর পার্ক ঘুরে তিনি আফসানার কাছে এই মা-সন্তানের ঘটনাটি শুনে অনেক বছর আগের একটা ঘটনা তাঁর খুব বেশি মনে পড়তে লাগল। বিষয়টি তিনি প্রাণপণে ভুলে থাকতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু হলো আর কই? তাই বিকেলটাই ফিকে হয়ে গেল তাঁর।

ভবনটার দোতলায় পার্কের দিকের অ্যাপার্টমেন্টে তাঁরা থাকেন। ডিনার শেষে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সগির সাহেব বারান্দায় এসে বসলেন। ঝাপসা অন্ধকারে পার্কটির দিকে চেয়ে আছেন তিনি। পার্কের এই প্রান্তে পাশাপাশি বড় তিনটি পেপারবার্ক গাছ। সেগুলোর বুকে জমাটবাঁধা অন্ধকারের ভেতর থেকে নিঃশব্দ করুণ কান্নার মতো কী যেন শুনতে পান তিনি। জোহরা এসে পাশে বসল। সগির সাহেব বললেন—

পার্কে শিশুসন্তান নিয়ে আসা মেয়েটার ঘটনা শুনে আমার কেমন যেন লাগছে।

জোহরা বলল—

কী আজব কথা, কেমন লাগার কী আছে! ওসব কি এ দেশে তেমন কোনো বিষয়? এ দেশে মানুষের স্বাধীনতা বেশি। কেউ কারও দিকে তাকায় না। মাথাও ঘামায় না। আমাদের দেশে তো মানুষ মানুষকে অপমান ও অপদস্থ করে মজা পায়। এ ধরনের ঘটনা যদি কোনো পরিবারে ঘটত, তাহলে আত্মীয়স্বজন মিল্যা চুপচাপ মেয়েটাকে দুনিয়া থেকে নাই করে দিত। আবার এভাবে বেবিটাকে পার্কে নিয়ে এসে খেলাধুলা! হে হে হে...

জোহরার তাচ্ছিল্যভরা মুখের দিকে তাকিয়ে সগির সাহেব একটা নীরব নিশ্বাস ছাড়লেন শুধু।

জোহরা বলল—

আফসানার সঙ্গে মাঝেমধ্যে ওর কথা হয়। মেয়েটার নাম রেবা। ইয়ার টেনে পড়াকালে ওই বেবিটা পেটে আসে। তারপর আর কী, ওই যে এ দেশে ফ্যাক্স (ফ্যামিলি অ্যান্ড চিলড্রেন সার্ভিসেস) না কী জানি একটা সংস্থা আছে, ওরা খোঁজ নিয়ে দেখে মেয়েটা ফ্যামিলিতে নিরাপদ নয়। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ, মেয়েটার মা-বাবা কনজারভেটিভ কালচার থেকে আসা। তারপর ওরাই দায়িত্ব নিয়েছে। এখন ওই দিকে, ওই যে হাউজিংয়ের ওই সব সরকারি বাসায় থাকে। সরকারি ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পায়। ওরা এভাবেই আছে। একটু পর বেবিটার বাবাও পার্কে আসছিল। পিচ্চি একটা ছেলে। তুমি হয় তো লক্ষ করো নাই।

লক্ষ করেছি। ভালো করেই দেখেছি।

হ্যাঁ, যদি আমাদের দেশে ঘটত, তখন বুঝতে কত ধানে কত চাল।

সগির সাহেব বললেন—

এভাবে কত ছেলেমেয়ের জীবনই তো শুরুতেই নিভে যায়...

এসব আলোচনা শুনলেই ভয়ে জোহরার শরীর কাঁপতে থাকে।

আচ্ছা, ওসব এখন রাখো। আমার ভয় করে। কার কপালে কখন কী ঘটে, কে জানে। বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে ভেবে আর কী হবে। বাকি জীবনটা সুন্দরভাবে কাটানোর জন্যই তো এখানে আসা।

সগির সাহেব ছিলেন হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক। সাধারণত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে বাংলা, সমাজবিজ্ঞান—এ ধরনের বিষয়গুলোই তিনি পড়াতেন। টিউশনি করেননি কখনোই। তাই তাঁকে মাসিক বেতনটুকু দিয়েই চলতে হতো। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত জীবন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছেলে-মেয়ে তিনটা বেশ মেধাবী। বড় মেয়ে আফসানা এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে একটা ইংলিশ কোচিং সেন্টার শুরু করেছিল। ছোট মেয়ে রেখা আর ছেলে হাসানের পড়াশোনার খরচ আফসানা নিজেই দেখাশোনা করত।

বাবার শিক্ষকতার চাকরি। ছেলেমেয়েরা সেভাবেই চলত। তবে সগির সাহেবের সন্তানেরা দেশে সেটেল হোক, এমন কথা তিনি শুনতেই পারতেন না। তাই আফসানার বিসিএস দেওয়ার চেষ্টাটা পর্যন্ত করা হয়নি।

সগির সাহেব শান্ত প্রকৃতির। জীবনের শুরু থেকেই তিনি সব ধরনের ঝামেলা এড়িয়ে চলা মানুষ। তাই হয়তো অনেক বছর আগে চাকরির শুরুর দিকের ওই ঝামেলাটাও খুব ভালোভাবেই এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেটা কি মূলত ঝামেলা নাকি তাঁর মানবিক দায়িত্ববোধ, এমনই কিছু একটা ছিল ওখানে? এত বড় এক বিপদের সামনে সদ্য নিয়োগ পাওয়া অবিবাহিত ওই সগিরের পক্ষে কীই-বা করার ছিল।

সগির সাহেবের বাড়ি থেকে ইঞ্জিনের নৌকায় করে এসে প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটা দূরত্বে টিনশেড ঘরের ওই হাইস্কুল। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সাহেবের বাড়িতেই তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। বিশাল বড় বাড়ির আঙিনায় এক কোণে বেশ বড় বাংলো ঘরের বারান্দার দুই পাশে দুটি কামরা। দক্ষিণ দিকের কক্ষে থাকেন তিনি। ক্লাস শুরু করেছেন মাত্র তিন দিন আগে। সেদিন রাত দুইটায় দরজায় মৃদু টোকা—

স্যার কি ঘুমে?

সগির সাহেব অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে জেগে ওঠেন-

কে?

স্যার, আমি স্বপ্না। আপনার ছাত্রী। ক্লাস টেনে পড়ি।

সগির সাহেব জানালার একটি পার্ট খুলে বললেন—

এদিকে এসো।

স্বপ্না জানালার কাছে এসে দাঁড়াল।

ঘটনা কী, কাঁদছ কেন?

স্বপ্না নিশ্চুপ।

কী ব্যাপার, কাঁদছ কেন?

স্যার, আমি বাঁচতে চাই।

আরে কী হয়েছে তোমার?

স্যার, আমার শরীর কেমন যেন করে। খাবারের গন্ধটাও সইতে পারি না। মা টের পেয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে আমারে কঠিন রকমের ইঙ্গিতে জানতে চাইছে। স্যার, আমাকে বাঁচান। আপনাকে দেখে আমার মনে হয়েছে আপনিই আমাকে বাঁচাতে পারবেন।

আরে বলো কী! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর স্বপ্না বলল—

এত বড় কলঙ্ক মাথায় নিয়ে আমি কোথায় যাব, আমি পাপী। কী করে বেঁচে থাকব? তার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। আমি চাইনি। স্যার, আমি এটা চাইনি।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ঘটনা অনুমান করতে পেরে সগির সাহেব নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে পেশাগত আচরণটাই করলেন—

স্বপ্না, তোমাকে স্কুলে দেখেছি কি না মনে করতে পারছি না। হয়তো দেখে থাকব। জানো তো, আমি এখানে নতুন। এক সপ্তাহ হয়নি জয়েন করেছি। এই এলাকার কাউকে তেমন চিনিও না। এমন ঘনিষ্ঠ এখনো কারও সঙ্গে হতে পারিনি যে তোমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করব। আমি কী করতে পারি বলো?

স্বপ্না চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

এই যে এত রাতে তুমি আমার জানালার সামনে। কেউ দেখে ফেললে কত বড় বিপদ হবে জানো? তুমি এই এলাকার মেয়ে। সবাই তোমার পক্ষে কথা বলবে। আমার উপায় কী?

স্বপ্নার কথার ধরন এবার বেশ করুণ এবং কোথায় যেন কঠিন এক ইঙ্গিত স্পষ্ট-

জি, স্যার। আমার ভাগ্যের সঙ্গে আপনি কেন জড়াবেন...

সগির সাহেব বুঝতে পেরেও নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নে হিম হয়ে রইলেন। ভয়ে তাঁর সারা শরীর কাঁপতে থাকে।

অঝোর কান্না বুকে চেপে ওড়নায় চোখ মুছে স্বপ্না চলে গেল। তার চলে যাওয়া পথের দিকে তিনি চেয়েও থাকেননি। সঙ্গে সঙ্গেই জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়েন।

বাকি রাতটুকু সগির সাহেব আর ঘুমাতে পারেননি। ভোরের দিকে একটু তন্দ্রার মতো হয়। মসজিদের মাইকে স্বপ্নার অপঘাতে মৃত্যুর খবরে তিনি চমকে ওঠেন। ততক্ষণে পুলিশ এসে লাশ নিয়ে গেছে। সেদিন স্কুল ছুটি ঘোষণা করা হয়। ছাত্র-শিক্ষকে স্বপ্নাদের বাড়ি ভরে যায়। সগির সাহেব এ ধরনের মৃত্যুতে ভয় পান, এই অজুহাতে অফিসের কক্ষে বসে রইলেন। স্বপ্নাদের বাড়িতে গেলেন না।

আত্মহত্যার সম্পূর্ণ দায় নিজের কাঁধে নিয়ে স্বপ্না ঝকঝকে হস্তাক্ষরে একটি সংক্ষিপ্ত নোট টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছিল। ওই নোটখানা পেয়ে পুলিশ অপমৃত্যু নথিভুক্ত করে। লাশ পোস্টমর্টেম শেষে ওই দিন বিকেলে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

তার পরের ঘটনা...

ওই দিন সন্ধ্যায় লাশ যথারীতি দাফন করা হয়। পৃথিবী ছেড়ে চিরদিনের তরে চলে গেছে স্বপ্না। সংসার তার আপন গতিতেই চলছে।

এদিকে সগির সাহেব মাঝেমধ্যে ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে ওঠেন। তিনি দিনের কর্ম-কোলাহলে বহুদূর থেকে ভেসে আসা কারও কান্না যেন শুনতে পান। ওই কান্নার কোনো ভাষা নেই। শব্দও যেন নেই। করুণ থেকে করুণতর! বুকে ব্যথা ধরা এক বিলাপের মতো। তাঁর মধ্যে একটা মৌনতা নেমে আসে। কিছুক্ষণের জন্য তিনি হারিয়ে যান।

দিনের কোলাহলে সময় কোনো রকমে কেটে গেলেও সন্ধ্যার পর আর কাটে না। এ বাড়ির কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে পড়ানো শেষে তাঁর রাতের খাবারের ডাক পড়ে। ঠিক তখন থেকেই সগির সাহেবকে একটা ভয় পেয়ে বসে। ভয়টা ধীরে ধীরে এমন একপর্যায়ে চলে যায় যে তিনি রাত জেগে ঘরে হাঁটাহাঁটি করেন। খানিক সময় বিছানার ওপর বসেন। কী এক অস্বস্তিতে আবার উঠে দাঁড়ান। এভাবে আর কত দিন চলে! শরীর অসুস্থ হতে শুরু করে।

সেবার তিনি ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন। একদিন মায়ের কাছে ঘটনা সবিস্তারে বলেন। মা বলেন, ‘বাবা, কত মানুষ কতভাবে মরে! বাঁচা-মরার হিসাব কি আর মানুষের হাতে রে বাবা? আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন তোর প্রথম সন্তান মেয়ে হয়। আমি আমার নাতনিকে কোলে লইয়া যখন আদর করব, তুই পাশে বইসা চেয়ে থাকবি। তখন হঠাৎ টের পাবি তোর বুকটা শান্তিতে ঠান্ডা হয়ে গেছে। মরার কথা ভাবতে থাকলে জীবন পাবি কই? জীবনের মধ্যে জীবন খুঁজতে হয় রে বাবা।’

জীবনবাস্তবতার দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া মা আজ কী কথা বললেন! স্বপ্নার মৃত্যুর চার মাস চলছে। এক বিষণ্নতার ভেতর হঠাৎ এ কী আলোড়ন! সত্যিই তো, একটা মেয়ে আমার হবে। তাকে একান্তে পাওয়া, তার কোলজুড়ে আসবে ভালোবাসার শান্তি। চাঁদের মতো ফুটফুটে এক শিশু।

সগির সাহেব ওই দিন বিকেলে কর্মস্থলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও আর গেলেন না। মায়ের কথাটা তাঁর খুব ভালো লাগল। তিনি বাড়ির আঙিনায় বসে রইলেন। ঘর উজ্জ্বল করা এক দৃশ্য-মায়ের কোলে শিশু। আধভাঙা হাসি। পাশে একজন আছেন, তিনি এই শিশুর মা। তাঁর পরনে হলুদ শান্তির মতো শাড়ি। এই এক দৃশ্যের ভেতরই কেবল তিনি নিজেকে জীবন্ত উজ্জ্বল দেখতে পেয়েছিলেন।

চাকরিজীবনের শুরুতেই স্বপ্নার এমন এক সম্ভাবনাময় জীবনের নির্দয় সমাপ্তি সগির সাহেবের জীবনটাকে দুঃখাচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। মায়ের কাছে কী এক সম্ভাবনার ইঙ্গিতে একটু ভালো লাগছিল তাঁর। স্বপ্নাদের বাড়িতে গিয়ে মেয়ে হারানো মা-বাবাকে একটু সান্ত্বনা দেওয়া, শিক্ষক হিসেবে এটুকু সৌজন্যবোধ কি সগির সাহেবের নেই? অবশ্যই আছে।

স্বপ্নার বাড়িতে গিয়ে ওর মা-বাবার সঙ্গে দেখা করা, সান্ত্বনামূলক দুটো কথা বলা—এমনটা ভাবতেই তাঁর বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে। আবার যদি ওই ভয়টা তাঁকে তাড়া করে! এমন টানাপোড়েনের পরের মাসেই সগির সাহেবের বিয়ে হয়ে গেল। মায়ের কেমন এক দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ের সঙ্গে, নাম জোহরা তাসফিয়া। তখন ইংলিশে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে রেজাল্টের অপেক্ষায় জোহরা। বিয়ের পরপরই জোহরা প্রাইমারি স্কুলে জয়েন করে। পোস্টিং নিয়ে কিছুটা সমস্যা হলেও পরে বাড়ির পাশের স্কুলেই স্থায়ী হয়। দুই বছর পর আফসানার জন্ম। নাতনিকে কোলে নিয়ে বসে থাকার সৌভাগ্য নিয়েই পরপারে আড়াল হন সগিরের মা।

এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। জীবনে অনেক সুযোগ পেলেও কেন যেন তিনি স্বপ্নার স্মৃতিবিজড়িত এই স্কুল আর ছাড়তে পারলেন না।

শিক্ষকতার শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ফাঁকে জীবনবিষয়ক কিছু কথা বলেছেন। এমনই কিছু কথা, যাতে করে স্বপ্নার মতো এমন পরিণতি অথবা যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিই জীবন থেকে বড় নয়। পরিস্থিতি কখনো জীবনকে তুচ্ছ করে দেখার কারণ হতে পারে না। এ কারণে অথবা যেভাবেই হোক সগির সাহেবের চাকরির দীর্ঘ ৩৫ বছর সময়ে কোনো শিক্ষার্থীর জীবনে এমন মর্মান্তিক পতনের ঘটনা ঘটেনি আর।

ছোট মেয়ে রেখা যখন হাইস্কুলে পড়া শুরু করে, এমন একদিন তিনি মেয়েকে ডেকে খুব কঠিন কিছু কথা বলেছিলেন। ওই থেকে তাঁর এই তিন সন্তান পড়াশোনার প্রতি পাগলের মতো খাটতে শুরু করে।

বর্তমানে সগির সাহেবের মাতৃভূমির সঙ্গে যোগাযোগ কমে এসেছে। দেশের কথা উঠলেই মায়ের কথা মনে পড়ে। সর্বোপরি মনে পড়ে স্বপ্নার কথা। আজ একটু অন্যভাবে মনে পড়ছে। ব্যালকনি থেকে হাউজিং দেখা যায়। ওখানে মা রেবার কোলে তখন হয়তো শান্তির ঘুমে মিশে আছে শিশুটি। ওদিকে স্বপ্না মিশে গেছে কবরে। কিশোর-কিশোরীর হৃদয়ের রক্তে ভিজে বেঁচে থাকে আমাদের পবিত্র ঈশ্বর। আমাদের রক্তে তৈরি হয় ইহধামে নিষিদ্ধ অবারিত সুখের স্বর্গ।