মেডিসিন নোবেল ২০২৩: কিছু কথা

হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী ক্যাটালিন ক্যারিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের ড্রু ওয়েইসম্যান ২০২৩ সালের চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট, স্টকহোম, সুইডেন, ২ অক্টোবর, ২০২৩
ছবি: রয়টার্স

ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসজাতীয় রোগজীবাণু যখন শরীরে প্রবেশ করে বংশবৃদ্ধি করে তখন তাকে সংক্রমণ বলে। ব্যাকটেরিয়া ১-৫ মাইক্রো-মিটারের মতো সাইজের হয়। ভাইরাস–ব্যাকটেরিয়ার থেকে অনেক ছোট জীবাণু, ব্যাস ২০-৪০০ ন্যানোমিটার (১ ন্যানোমিটার = ০.০০০০০০৮ ইঞ্চি)। শরীরের প্রতিরোধক ক্ষমতা বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে, এ জীবাণুদের সংক্রমণ থেকে আমাদের প্রতিনিয়ত রক্ষা করে।

রক্তে দুই ধরনের কণিকা থাকে। লোহিত রক্তকণিকা, যা সারা শরীরের, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অক্সিজেন বহন করে। আর সাদা রক্তকণিকা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে। সাদা রক্তকণিকারা আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সৈন্যবাহিনী। প্রতি মাইক্রলিটারের মধ্যে ৪০০০-১১,০০০ সাদা রক্তকণিকা কোষ থাকার কথা। প্রতি মাইক্রলিটার, মানে ১ লিটারকে ১০০০,০০০ দিয়ে ভাগ করলে যতটুকু হয়, ততটুকু আয়তন। ওষুধের ড্রপারের এক ফোঁটা বা ড্রপে মোটামুটি ৫০ মাইক্রোলিটার হয়।

তাহলে বুঝতেই পারছেন কতটুকু আয়তনের কথা বলছি। এই সাদা কোষের সংখ্যা কমতে থাকার নানা কারণ থাকে। একটি হলো শরীরে সংক্রমণজনিত অসুস্থতা।

কোভিড-১৯ এর বদৌলতে আমরা ‘এমআরএনএ ভ্যাকসিন’ আজ ঘরে ঘরে এক পরিচিত নাম।

আরএনএ হল সাংকেতিক চিহ্নবিশিষ্ট একটি সুতার (সিঙ্গেল স্ট্রান্ড) মতো দেখতে পদার্থ, যার এক একটি একককে নিউক্লিওটাইড বলে। তিন ধরনের আরএনএ আছে। এর মধ্যে এক ধরনের আরএনএ আছে, যারা আজ্ঞা বা নির্দেশ পেলে মধ্যস্থতাকারী বার্তাবাহক হিসাবে আমাদের শরীরের আমাদের সাদা রক্ত কণিকার খুব পরিচিত প্রোটিনগুলো, মানে দেশি প্রোটিনগুলোই তৈরি করে। মধ্যস্থতাকারী বার্তাবাহক হিসাবে কাজ করে বলে এদের মেসেঞ্জার আরএনএ বা সংক্ষেপে এমআরএনএ (mRNA) বলা হয়।

এরাই আবার কোষের মধ্যে সংক্রামক আক্রমণকারীদের (জীবাণুদের) বিদেশি প্রোটিন তৈরি করতে বাধা দেয়। যদি মিথ্যা বা বিদেশি আজ্ঞাবাহী সাংকেতিক বার্তা শরীরে ঢুকে পড়ে তাহলে, আরেনেজ (RNase) উৎসেচক নামের মোক্ষম একটি মারণাস্ত্র দিয়ে মিথ্যা নির্দেশসম্বলিত বিদেশি আজ্ঞা বা বার্তাটি ভেঙে টুকরা টুকরা করে দেয়, মানে মুছে ফেলে। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে প্রতিরোধক ক্ষমতা গঠন বা immunization বলে।

এ রকম একটি সুতার সঙ্গে আর একটি সুতা পেঁচিয়ে তৈরি হয় ডিএনএ যা ডাবল-স্ট্র্যান্ডেড মানে দুটি সুতোর পেঁচানো দড়ি। পড়েছেন না ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতাখানি? কবিতাটি শুরু হল এইভাবে -‘গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে, মৈত্রমহাশয় যাবে সাগরসংগমে তীর্থস্নান লাগি।’ সব প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। কিন্তু বার্তা যদি সাংকেতিক হয়, তাহলে পড়বে কে আর প্রস্তুতির-ই বা কি হবে? আর এই যে ‘কপালে লেখা আছে বলে’ আমরা সর্বক্ষণ হেদিয়ে মরি—সে সব ভুয়ো কথা—যা লেখা আছে সব এই ডিএনএ–তে আছে, তবে টরে টক্কা, টরে টক্কা, টক্কা টক্কা টরে টরে—এরকম করে, সাঙ্কেতিক ভাষায়।

পাঠোদ্ধার না করলে সবটাই বৃথা। ডিএনএ–তে সাংকেতিক ভাষায় কি লেখা আছে, এ mRNA তা পাঠোদ্ধার করে বার্তাবাহক হিসাবে শরীরের কোষে কোষে রাইবোসোম ও অন্যান্য কর্মচারীদের কাছে পৌঁছে দেয়।

কিন্তু কখনো কখনো নতুন নতুন রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর আক্রমণ ঠেকাতে বাইরে থেকে প্রতিরোধক্ষমতাবর্ধক বস্তু শরীরের মধ্যে প্রবেশ করানোর দরকার পরে যাকে ভ্যাকসিন বলে। যখন ডাক্তারে কোভিড-১৯ এর mRNAটা আমাদের শরীরে ঢুকিয়ে দেন, তখন আমাদের শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা সৈন্যবাহিনীর মতো বিপজ্জনক বস্তুটি (অ্যান্টিজেন) এর আঁচ আগেভাগে পেয়ে যায়, আর প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্রশস্ত্র (এন্টিবডি) তৈরি করে মজুত করে রাখে। ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রক্রিয়াকে ভ্যাকসিনেসন বা বাংলায় টিকা দেওয়া বলে।

আরও পড়ুন

গত কয়েক বছর ধরে করোনাভাইরাস আর তার টিকা নিয়ে খুব চর্চা চলেছে। করোনাভাইরাস নাক, মুখ বা চোখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। করোনাভাইরাসের ওপর চর্বিজাতীয় আবরণেই এম এবং এস ধরনের প্রোটিন থাকে। এদের মধ্যে একটি হলো স্পাইক প্রোটিন যা আবরণের ওপর শজারুর কাঁটার মতো সূচ্যগ্র বস্তু তৈরি করে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় মানুষের সুস্থ কোষের মধ্যে ফুটা করে এই স্পাইকগুলো বিদেশি ম্যাসেঞ্জার আরএনএ ঢুকিয়ে দেয় এবং সুস্থ কোষগুলোর যন্ত্রপাতি হাইজ্যাক করে এবং এগুলো ব্যবহার করে বিদেশি প্রোটিন তৈরি করার আজ্ঞা প্রদান করতে থাকে। মিলিটারি ক্যুর সময়ে রেডিও স্টেশন দখল করে আদেশ দেওয়ার মতো। আর এ আজ্ঞাবলে জৈবিক বিভাজনের মাধ্যমে দ্রুতগতিতে প্রচুর ভাইরাস কণা তৈরি করতে থাকে। আক্রান্ত কোষটি যখন ভাইরাসে পরিপূর্ণ হয়ে যায়, তখন এটি ফেটে যায়। ফলে কোষের মৃত্যু হয় এবং ফেটে বেরিয়ে আসা ভাইরাসের কণাগুলো আরও নতুন নতুন সুস্থ কোষকে সংক্রমিত করতে থাকে। মানুষের শরীরে সংক্রমণ চক্রবৃদ্ধিহারে দ্রুত বাড়তে থাকে।

এখন শরীরে ঢোকার আগে, হাত বা জিনিসটি সাবান দিয়ে ধুলে সাবানের অণুগুলো ভাইরাসের চারপাশে থাকা ফ্যাটি স্তর বা আবরণকে ধ্বংস করে ফেলে, কোষে ফুটা করতে পারে না, যার ফলে সুস্থ কোষকে আক্রমণ করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। বাতাসের মাধ্যমে যাতে সংক্রমণ না ছড়ায়, তার জন্য মুখোশ বা মাস্ক পরতে হয়। আমরা যে N95 মাস্ক পরি তার নামে ‘N’ অক্ষরটির মানে হল no oil based particle, এটিতে কোনো তেল থেকে উদ্ভূত কোনো কণা নেই এবং ছিদ্রগুলো খুব ছোট (০.৩ মাইক্রন)। তাই ভাইরাস প্রবেশে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে এ মাস্ক ৯৫ শতাংশ সফল। সব মিলিয়ে হলো N95। তবু, এ সংক্রমণ হওয়ার আগে আমাদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে নেওয়া দরকার। আর তাই আমরা টিকা নিয়ে থাকি।

আরও পড়ুন

ক্যাটালিন কারিকো ও ড্রিউ ওয়াইজম্যান যৌথভাবে এ বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন।

তাঁদের গবেষণার ফল আজকের এই mRNA vaccine, যার দৌলতে আজ করোনাভাইরাস থেকে অনেকেই রক্ষা পেলেন। ফিলাডেলফিয়া পেন মেডিসিনে প্রায় ১৫ বছর ধরে গবেষণা করে তাঁরা এ পদ্ধতি বের করেন। এত দিন মৃত বা দুর্বল ভাইরাসকে অথবা ওই ভাইরাসের active site বা সক্রীয় অংশবিশেষ শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো, যাতে ভবিষ্যতে আমাদের এ রোগের প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে। এখন আর একটি অভিনব পদ্ধতি আমরা পেলাম। এই mRNA টিকা সেদিক থেকে একেবারে ব্যতিক্রমী এবং নতুন।

যাহোক, করোনা নিয়ে কী কাণ্ডটাই না হলো, পৃথিবী স্তব্ধ হলো, লাখ লাখ লোক মারা গেল। তোলপাড় হয়ে গেল পৃথিবী। কেউ বললেন, আরও রক্তে ব্লিচিং পাউডার ইনজেকশন দিলে সব সেরে যাবে। কেউ নিজেকে ওপরওয়ালা বলে ফতোয়া দিলেন যে কারও টিকা নেওয়ার দরকার নেই। তাঁর এ ফতোয়ায় বোধ হয় বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে ওপরওয়ালা তাঁকে পৃথিবী থেকে তাঁর নিজের কোলে তুলেও নিলেন।

সমস্যা হলো, সমাজের একটা অংশ, চিরকাল এ মাকাল ফলদের অনুসরণ করি, শুধু দেখতে সুন্দর আর স্ট্রিট স্মার্ট বলে, কাজের বেলায় তাঁরা লবডঙ্কা। তাঁরা বরাবর সব সমাজকে অযথা নাকাল করে বেড়ান।

যাহোক, আমার খুশির কারণ এই যে মাকাল ফলেরা নাকাল হলেন এই mRNA vaccine–এর খপ্পরে পড়ে। ক্যাটালিন কারিকো ও ড্রিউ ওয়াইজম্যানকে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য অসংখ্য অভিনন্দন!

  • লেখক: ড. অতীশ চক্রবর্তী, ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্র