ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ

চীনের ক্রেতাদের সঙ্গে হারুন রশিদ
ছবি: সংগৃহীত

দেশ এখন আর কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যেখানেই বাংলাদেশের মানুষ গিয়েছেন, সেখানেই এক টুকরা বাংলাদেশ তৈরি হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়াতেও অনেক বাংলাদেশি বহু বছর ধরে সুনামের সঙ্গে বসবাস করছেন; বিশেষ করে সিডনিতে এই সংখ্যা অনেক বেশি। সিডনিতে বাংলাদেশি মানুষের সংখ্যা যত বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশি দোকান–রেস্তোরাঁ সংখ্যায় এখন অনেক। এসব দোকানে পাওয়া যায় বাংলাদেশ থেকে আসা ‘ফ্রোজেন’ শাকসবজি। সেগুলোর গুণমান নিয়ে প্রশ্ন নেই, কিন্তু ফ্রোজেন হওয়ায় এগুলোর স্বাদ আসল স্বাদের কাছাকাছিও হয় না। অবশ্য অনেকেই নিজ বাড়ির আঙিনায় বাংলাদেশি সবজির চাষ করে থাকেন, কিন্তু পরিমাণের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল।

অস্ট্রেলিয়াতে চারা ও গাছ তৈরির লালনপালন চলছে
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের তরতাজা শাকসবজি প্রবাসী বাংলাদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ইচ্ছা থেকেই ২০১৬ সালে এক বাংলাদেশি—একজন হারুন রশিদ—গড়ে তোলেন রামিনস ফার্ম। শুরুতেই ওনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। জন্মভূমি বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে। বেড়ে উঠেছেন বাংলাদেশের মাটি আর মানুষের সংস্পর্শে। এরপর একসময় দেশান্তরি হন। সেটা ২০০৯ সালের কথা। সিডনির ইউনিভার্সিটি অব ওলোংগং থেকে ম্যানেজমেন্টে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেন। এরপর পেশাদার রংমিস্ত্রি (পেইন্টার) হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু মাটি ও মানুষের কাছাকাছি শৈশব–কৈশোর পার করা হারুনকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল আবহমান গ্রামবাংলার মায়াবতী সবুজ প্রকৃতি।

এরপর সেই ভাবনাকে কাজে পরিণত করেন ২০১৬ সালে। আরও দুজন শুভাকাঙ্ক্ষীসহ সিডনির লেপিংটনে মাত্র পাঁচ একর জমি ইজারা নিয়ে শুরু করেন বাংলাদেশি শাকসবজির চাষ। অন্য দুজন অংশীদার থাকলেও খেতের বেশির ভাগ কাজকর্ম নিজের হাতেই করতেন। আর ফাঁকে ফাঁকে চালিয়ে নিতেন রংমিস্ত্রির কাজও। এভাবেই চলছিল প্রথম দুই বছর। কিন্তু এতে কোনো দিকেই তিনি ভালো ফল পাচ্ছিলেন না। আর খেতে কোনোভাবেই লাভের দেখাও মিলছিল না। খেতের ক্ষতির ব্যাপারটা চাক্ষুষ হতেই দুই বছর শেষেই অন্য দুজন সরে পড়েন। কিন্তু তিনি ক্ষতি স্বীকার করেও আবেগ থেকে চাষটা ধরে রাখেন। এরপর একসময় তিনি রংমিস্ত্রির কাজটা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি চাষে মনোনিবেশ করেন। সেটা ২০১৮ সালের কথা।

নিজে সম্পূর্ণ সময় খেতে দিয়েও কাজকর্মে কুলিয়ে উঠতে না পারায় আরও দুজন মানুষকে নিয়োগ দেন। এভাবেই একসময় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাশাপাশি তত দিনে সিডনির বাংলাদেশি কমিউনিটিতে একটা আলাদা পরিচয়ও তৈরি হয়ে গেছে। যিনিই একবার রামিনস ফার্মে গেছেন, তিনিই শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছেন। আর এটা সম্ভব হয়েছে হারুন রশিদের ব্যবহারের কারণে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা বিষয় আমার খুবই দৃষ্টিকটু লাগে। সেটা হচ্ছে ক্রেতার সঙ্গে তাঁদের দুর্ব্যবহার। প্রথম দু–এক দিন হয়তোবা তাঁরা ভালো ব্যবহার করেন। এরপর অবধারিতভাবে কেন জানি খারাপ আচরণ চলে আসে তাঁদের ব্যবহারে। কিন্তু হারুন রশিদের সদাহাস্যমুখটা সবার কাছেই প্রিয় হয়ে উঠেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। এভাবেই বাংলাদেশি কমিউনিটিতে রামিনস ফার্ম বাংলাদেশি তরতাজা শাকসবজির এক নির্ভরযোগ্য নামে পরিণত হয়।

ফার্মে এসে প্রবাসী প্রজন্ম ফিরে যায় তার শিকড়ের কাছে
ছবি: সংগৃহীত

এভাবেই ফার্মের নাম একসময় ছড়িয়ে পড়ে প্রবাসী অন্যান্য কমিউনিটিতেও। বাংলাদেশিদের বাইরে নেপালি, ভারতীয়, চাইনিজ কমিউনিটির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া স্থানীয় আদিবাসীদের কাছেও পৌঁছে যায় ফার্মের নাম। তাদের উৎসবে ফার্মের কচুর পাতা (তারো লিভস) অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এরপর ফার্মের শাকসবজির নাম ছড়িয়ে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার অনেক এলাকায়। তাদের চাহিদা মেটাতে একসময় অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য রাজ্যে কুরিয়ারে সবজি পাঠানো শুরু হয়। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা থেকে কিছু দোকান সরাসরি পণ্য সংগ্রহ শুরু করে। তারা খুব ভোরে ক্যানবেরা থেকে রওনা দিয়ে ফার্ম থেকে সবজি নিয়ে আবার দুপুরের আগেই ক্যানবেরা ফিরে যায়। তারপর সেই সবজি শেষ হলে আবার একইভাবে এসে নিয়ে যায়।

সবজির বাড়তি এই চাহিদা জোগান দিতে পাশেই আরও পাঁচ একর জায়গার ইজারা নিতে হয়। সেখানেও একইভাবে চাষ শুরু হয় বাংলাদেশি শাকসবজির। পাশাপাশি নতুন জায়গার মজাপুকুরটার সংস্কার করে সেখানে ছাড়েন মাছ। আর পুকুরপাড়ে লাগান আখ। ক্রমবর্ধমান সবজির চাহিদা পূরণে এ বছর আরও সাত একর জমি ইজারা নেওয়া হয়েছে। আর এই তিন জায়গায় হাওয়ায় দোল খায় বাংলাদেশি বিভিন্ন প্রজাতির লাউ, শিম, কুমড়া, ঢ্যাঁড়স, ধুন্দুল, চিচিঙ্গা, কচুশাক, কচু, কচুর লতি, বিভিন্ন রং ও আকারের বেগুন, মুলা, মুলাশাক, পালংশাক, পুঁইশাক, ডাঁটাশাক, সর্ষেশাক, মটরশুঁটির শাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, কচি ও পাকা চালকুমড়া, উচ্ছে, আদাসহ আরও অনেক সবজি। পরীক্ষামূলকভাবে একবার চাষ করা হয়েছিল কাঁকুড়ও। এখন পরিকল্পনা করা হচ্ছে কাঁকরোল ও পটোল চাষের। তবে আলাদাভাবে বলতে হবে এখানকার মরিচ, ধনেপাতা, বৈথাশাক, মেথিশাক, পাটশাক আর কুমড়ো ফুলের কথা। ফার্মের মরিচ ঝালের কারণে এখন সবার কাছেই আদরণীয়। আর ধনেপাতার সুবাসে এখন বাংলাদেশিদের হেঁশেলঘর ম–ম করে। ফার্মের কুমড়ো ফুলের কারণে এখন মানুষ প্রবাসেও ফুলের বড়া খেতে শিখে গেছে। আর বিলুপ্তপ্রায় বৈথাশাক ও মেথিশাক এ প্রবাসেও ফিরে এসেছে সগর্বে।

ফার্মের স্বত্বাধিকারী হারুন রশিদ
ছবি: সংগৃহীত

ফার্ম সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি বহু মানুষের কর্মসংস্থানও করেছে। প্রবাসী শিক্ষার্থীদের কাছে এখন রামিনস ফার্ম এক ভরসার নাম। পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক তরুণই এখন সেখানে কাজ করে নিজের ব্যয় নির্বাহ করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন দুর্যোগের সময় রামিনস ফার্ম তার যথাসাধ্য নিয়ে এগিয়ে আসে। ফার্ম শুরু থেকেই নিজেদের কাজের মানকে আরও কীভাবে ভালো করা যায়, সেটাই চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন ফার্মে সুনির্দিষ্ট গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা আছে। প্রবেশপথের দুপাশে এবং বিক্রয়কেন্দ্রের সামনে লাগানো হয়েছে সুন্দর সব ফুলের চারা। সবজির সবুজের পাশাপাশি বিভিন্ন ফুলের বাহারি রং নিমেষেই ক্রেতাদের মনের ক্লান্তি দূর করে দেয়। আর সতর্কবাণীসহ বিভিন্ন সাইনবোর্ডও বসানো হয়েছে। এতে ব্যস্ত সময়ে সবাই শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে কেনাকাটা করতে পারে। উদ্বৃত্ত সবজি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছে ঠান্ডা ঘর। এ ছাড়া ক্রেতাদের চাহিদা মাথায় রেখে এখন বিভিন্ন গাছের চারাও সুলভ মূল্যে বিক্রি করা হয়। পাশাপাশি ক্রেতারা যাতে ঘরে বসেই কেনাকাটা করতে পারেন, তার জন্য তৈরি করা হয়েছে ওয়েবসাইটও। তবে ক্রেতারা ফার্মে এসে সরাসরি কিনতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

ফার্মে পাওয়া যায় পাটশাকের মতো ঐতিহ্যবাহী সবজিও
ছবি: সংগৃহীত

রামিনস ফার্মের এ যাত্রাপথ মোটেও সুগম ছিল না। প্রথম বাধা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার বৈরী আবহাওয়া। বলা হয়ে থাকে, এখানে একই দিনে চার ঋতুর দেখা পাওয়া যায়। আবার কখনো শীতকাল প্রলম্বিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় শীতের মাত্রাও। আবার কখনো গরমের তীব্রতাও বেড়ে যায়। কখনো কখনো অতিবৃষ্টিতে দেখা দেয় হঠাৎ বন্যা (ফ্লাশ ফ্লাড)। এ ছাড়া আছে স্থানীয় ক্যাঙারুর আক্রমণ। এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে গাছ বড় করা এবং সেখানে ফসল ফলানো রীতিমতো ঝক্কির ও ধৈর্যের ব্যাপার। করোনার সময়টায় ছিল টিকে থাকার আরেক ঝুঁকি। তখন হোম ডেলিভারি সার্ভিসের মাধ্যমে সবজি পৌঁছে দেওয়া হতো বাড়ি বাড়ি। বাংলাদেশের মাটিতে একটা বীজ ফেলে দিলেই চারা গজিয়ে যায়। একসময় সেই চারাগাছ বড় হয়ে ফুলে ফলে ভরে ওঠে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে একটা চারা তৈরি করা আবার সেটাকে বড় করা অনেকটা মানুষের বাচ্চা লালনপালনের মতো পরিশ্রমের ব্যাপার। শুধু ব্যবসায়িক মনোবল থেকে সেটা সম্ভব না বলেই আমার বিশ্বাস। এর জন্য দরকার সবুজের জন্য, গাছের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা। কারণ, অন্য অনেক পথেই সহজেই এখানে টাকা আয় করা সম্ভব। কিন্তু শাকসবজির খামার করে সেখান থেকে লভ্যাংশ তুলে আনা মোটামুটি অসম্ভব। এখন পর্যন্ত রামিনস ফার্ম কেবল অর্থনীতির ‘ব্রেক ইভেন্ট’ পার করতে পেরেছে। পাড়ি দিতে হবে আরও অনেক পথ।

ফার্ম প্রবাসী বাংলাদেশি প্রজন্মকে তার শিকড়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এখানে যাঁরা কেনাকাটা করতে আসেন, তাঁরা প্রায় সব সময় বাচ্চাদের নিয়ে আসেন। এতে পরবর্তী প্রজন্ম বাংলাদেশের সবুজ সম্বন্ধে ধারণা পায়, সবুজের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয় তাদের মধ্য। আবার প্রবাসে বেড়াতে আসা প্রবীণেরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন একখণ্ড সবুজ বাংলাদেশকে আবিষ্কার করে। হাত তুলে নাতি–নাতনিদের দেখিয়ে বলেন, দাদুভাই, এমনই সবুজ, মায়াময় ও প্রাণবন্ত ছিল আমাদের শৈশব। অনেক সময় আবার তাঁরা খেতের মধ্যে বসে নিজ হাতে তুলে আনেন প্রয়োজনীয় পণ্য। এ ছাড়া অন্যান্য দেশের প্রবাসী এবং স্থানীয় মানুষের কাছে এখন বাংলাদেশের অপর নাম রামিনস ফার্ম। শুরুতেই যে কথাটা বলেছিলাম, সেখানে ফিরে আসি। দেশ আসলে এখন আর কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নয়। আমি, আপনি, আমাদের আচার-ব্যবহারই দেশের পরিচয় বহন করে। আমি–আপনিই বাংলাদেশের একেকজন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। রামিনস ফার্ম আর হারুন ভাইয়ের সদাহাস্যমুখ অস্ট্রেলিয়ায় এখন বাংলাদেশের অন্যতম বড় ব্র্যান্ড।

*দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। মেইল করতে পারেবেন [email protected]