টয়োটা আরএভি ফোর
আজ আমাদের পুরনো গাড়িটাকে বিদায় দিয়ে দিলাম। ৯৯ মডেলের গাড়ি, ২০১০ সালে আবির নিয়ে এসেছিল ভালো দামেই। ওডোমিটারে ২ লাখ ২০, ৫-৬ বছর চললেই যথেষ্ট।
কত স্মৃতি এই গাড়িতে, সিডনিতে নেমে এই গাড়িতে করেই বাড়ি গেলাম। আগের দিনের গাড়ি বলে শুধু ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল, তাই দুইজনে রেডিও শুনতে শুনতে আমরা সিডনির কাছে ঘুরে বেড়াতাম। সাজিয়ার জন্মের পর কার সিট লাগানো হলো, হাসপাতাল থেকে বাড়ি এল। রাতবিরেতে অসুস্থ হলেও পরিবারের নির্ভরযোগ্য সদস্যর মতো নিয়ে গেছে হাসপাতালে, ফিরিয়ে এনেছে।
আমি চালানো শুরু করি ১৮ থেকে। একটাই গাড়ি ছিল বলে আবির তেমন একটা চালাতে দিত না। তবু এই গাড়ি করেই ঘুরে বেড়াতাম, পুরনো গাড়ি স্যাটন্যাভ নাই, ব্লুটুথ নাই। আমি ফেসবুক মার্কেট প্লেস থেকে ২০ টাকার একটা গারমিন জিপিএস আর ১০ টাকার একটা ব্লুটুথ স্পিকার লাগিয়ে নিলাম। বেশ হয়ে গেল আধুনিক গাড়ি।
মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার কেনার পর পুরোপুরি চলে এল আমার হাতে। চিকিৎসক হয়ে কুইন্সল্যান্ডের রকহ্যাম্পটন আসার পর, রকহ্যাম্পটনের চওড়া রাস্তায় আমি আর আমার গাড়ি, ঠিক একটা মানুষের মতো বন্ধু যেন। হয়তো মানুষ থেকেও ভালো, মানুষের মতো তার হাজারবিজার বাই নেই, যেখানে যেতে চাইছি নিয়ে যাচ্ছে, রোদ–বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছে—কই যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, যাওয়ার দরকারটাই কি, এসব ঘ্যান ঘ্যান করছে না।
আমি অত পাকা চালক না, গাড়িতে এদিক ওদিক ঘষা খাওয়া। আবির প্রায়ই বলতো, তোমার আরেকটা গাড়ি দরকার, এমন পুরনো গাড়ি, লোকে খারাপ বলবে। মুখঝামটা দিয়ে দিতাম, আমার এই গাড়িই ভালো। সত্যি বলতে কি, অন্য গাড়িতে উঠলে আমার মাথা ঘোরে। বড় আশা ছিল, এইটাই অনেকদিন চালাব। মানুষ নতুন গাড়ির স্বপ্ন দেখে, আমি একে রঙ করানোর স্বপ্ন দেখতাম। নিজের কোনো উচ্চাশা নাই, এই অনুভুতির বদলে বড় গর্ব হতো, আমার মতো এতো অল্পতে খুশি হতে পারার ক্ষমতা কয়জনের আছে।
এ গাড়ি আমার সেই কাঠুরের লোহার কুড়ালের গল্পের মতো, জলপরি সোনা-রূপার কুড়াল তুলে নিয়ে আসে। সে বলে আমার লোহার কুড়ালটাই খুঁজে দাও, রুপার কুড়ালে কি কাঠ কাটা যায়?
কপালে সুখ বেশিদিন সইল না, এক রাতে ঢাল থেকে নামতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক বাসায় গিয়ে ধাক্কা খেলাম। বাসার দরজা, পিলার ভেঙে গেছে, অথচ আমি মোটামুটি অক্ষত। যেন জীবনের শেষ দিনেও নিজের জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে রেখে গেছে।
আজ বিদায়ের পালা, আমি অত পয়সাওয়ালা মানুষ হলে গাড়িটা সারিয়ে নিতাম। অন্তত বড় একটা বাড়ি থাকলে গাড়িটা বাড়ি নিয়ে আসতাম। মাঝেমধ্যে গাড়ির ভেতর বসে থাকতাম। সুতরাং বিদায় বলতেই হলো।
বিদেশে গাড়ি স্ক্র্যাপাররা নিয়ে যায়, অথবা তাদের টাকা দিয়ে বলতে হয় একে দূরে নিয়ে ফেলে আস। সৌভাগ্যক্রমে ফেসবুকে ক্যাশ ফর কার নামক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আছে। তারা একে কিনে নিয়ে যাবে।
ডাক্তার হলে মানুষের চিন্তাভাবনা অদ্ভুত হয়ে যায়, মরার পর ও মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। অর্গান ডোনেশনে যেমন অনেকের জীবন বেঁচে যায়, আমার এই গাড়িও হয়তো অনেকের গাড়িতে আরও অনেক দিন বেঁচে থাকবে। তার চাকাগুলো কোনো গাড়ির পুরোনো টায়ার রিপ্লেস করবে। ব্যাটারি, ইঞ্জিন, টোবার, মিরর, রুফ র্যাক। আমার এ গাড়িটা আরও অনেক দিন রাস্তায় থাকবে।