নীল দরিয়া

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আসসালামু আলাইকুম ম্যাম,

আমি হাসিবুল হক। আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে এসেছি, যদি একটু শুনে বলতেন, আমি এখন কী করব?

মনোচিকিৎসক পারিজাত রহমান তাকিয়ে আছেন সামনে বসা ভদ্রলোকের দিকে, বয়স ৩৫ দেখতে ভালোই , মাঝারি গড়নের, চেক ফুলশার্ট ইন করে পরা কালো প্যান্ট এবং পায়ে জুতা।

বিবাহিত, একটি ছেলে, আড়াই বছর বয়স।

জি অবশ্যই, বলুন...

আমি খুবই ভয়াবহ একটি সমস্যায় আছি বিগত কয়েক বছর, বলতে পারেন বিয়ের পর থেকেই...

সমাজে শুধু নারী নির্যাতনের গল্প শোনা যায়, মেয়েরা তবু কাছের মানুষদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে, সহানুভূতি পায়; কিন্তু পুরুষ নির্যাতন যে ভয়াবহভাবে বেড়েছে, ছেলেরা কাউকে বলতেও পারে না। কী যে যন্ত্রণা, বলতে গেলে ইগো সমস্যা, লজ্জা, এমনকি বন্ধুদেরও বলা যায় না। হাসাহাসি করে বলে, তু্ই তোর বউকে সাইজ করতে পারিস না। বউ কি সাইজ করার জিনিস বলেন?

অলঙ্করণ: মাসুক হেলাল

জি , সমস্যা সবখানেই, তারপর বলুন

আমার বাবা মা বেশ ধার্মিক এবং রক্ষণশীল, আমরা পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। পড়াশোনা শেষ তখন আমার, নতুন চাকরি পেয়েছি, বন্ধুদের নিয়ে একদিন গুলশানের এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয়, পোশাকে বেশ স্মার্ট এবং মুখে কড়া প্রসাধনী। মেয়েটা পাশের টেবিলে বসে ছিল, হঠাৎ করে যাওয়ার সময় তার হাত থেকে মোবাইল পড়ে যায়, যেটা আমাদের টেবিলের নিচে এসে পড়ে। আমি উঠিয়ে দিতে গিয়ে কথা হয় দুই মিনিট মেয়েটার সঙ্গে, মেয়েটা অনেক থাঙ্কস দিয়ে মোবাইল নাম্বার চাইল, আমি দিলাম।

এরপর থেকে মাঝেমধ্যে কথা হতো মোবাইলে, বেশ গুছিয়ে শুদ্ধ করে কথা বলে, কিছুটা ঢং করে, তখন আমার যে বয়স, শুনতে বেশ ভালো লাগত।
সেখান থেকে শুরু, মাঝেমধ্যে রেস্টুরেন্টে ডেট করতে যেতাম। সে–ও আসত, অনেক খাবার অর্ডার করত; কিন্তু কিছুই তেমন খেতো না, খুবই ফিগার সচেতন রিঙ্কি, ওজন বাড়াবে না।

এভাবেই বছর ঘুরতেই আমরা দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করে ফেলি। প্রথমে আমার বাবা–মা রাজি ছিলেন না, তাঁরা সংসারী, নামাজি মেয়ে খুঁজছিলেন, আমাদের মতো ফ্যামিলির, রিঙ্কি একটু বেশি মডার্ন আর পোশাকআশাকে বেশি আধুনিক, বাসার সবাই কানাঘুষা করে। আমি তখন প্রেমে অন্ধ। ভাবলাম, বিয়ের পর নামাজ শিখিয়ে নেওয়া যাবে, এ আর এমনকি, মুসলিম পরিবারের মেয়ে, আমার আম্মার কাছ থেকে শিখে নেবে।

বিয়ে হয়ে গেল
বিয়ের পর শুরু হলো আসল কষ্ট...

প্রথমত দেখি, রিঙ্কি তেমন সুন্দর না, কড়া প্রসাধনী দেওয়া থাকত  সবসময়, তাই বুঝতে পারিনি, একটু মন খারাপ হলো, বিয়ে হয়ে গেছে তাই  মানিয়ে নিলাম। এরপর তার জামাকাপড় পোশাক নিয়ে লাগল ঝামেলা , সে বাসায় সবার সামনে রাতের পাতলা পোশাক পরে ঘোরাঘুরি করে।

ঘুম থেকে উঠে ওই পোশাকেই নাশতা করতে আসে।

আত্মীয়দের বাসায় দাওয়াতে যায় শার্ট–প্যান্ট পরে। আমরা পুরান ঢাকায় বড় হওয়া বড় যৌথ পরিবার।

কেউ এসব ভালোভাবে নিল না। আমি রিঙ্কিকে বুঝিয়ে বললাম, সে উল্টো বুঝে রাগ করে বাবার বাড়ি চলে গেল। আমরা নাকি খেত, ফ্যাশন বুঝি না, সে এমন খুবই টাইট ফিটিং জামাকাপড় পরবে। সালোয়ার–কামিজ নাকি অসহ্য।

এভাবেই এক বছর কেটে গেল, আমার আগেই অ্যাপ্লাই করা ছিল অস্ট্রেলিয়ার, ভিসা হয়ে গিয়েছিল। আমি রিঙ্কির নাম বিয়ের পর অ্যাড করেছিলাম, এরপর রিঙ্কিকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসি। তখন মনে মনে কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম মনে হয়েছিল। অন্তত বাবা–মা মুখ কালো আর আত্মীয়দের কটু কথা শুনতে হবে না।

কিন্তু এখানে এসে শুরু হলো আসল সমস্যা, সে এই দেশের মেয়েদের মতো ড্রেস পরা শুরু করল, এত ছোটখাটো ড্রেস আর এত ফিটিংস। পুরো শরীরের সব বোঝা যায়, এমনকি দাওয়াতে  শাড়ি পরলেও এমনভাবে পরে, তা পরা না–পরা সমান, এর চেয়ে সাঁতারের পোশাক পরা মেয়েদের বেশি ভদ্র দেখায়, বাকিটা আপনি বুঝে নিন। খুবই আবেদনময়ী জামাকাপড় স্মার্টনেসের নামে, তাকানো যায় না; কিন্তু কিছু বললেই ঝগড়া।

বাংলা কমিউনিটিতে তাকে নিয়ে কানাঘুষা চলে, কিছু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে।

এখন রিঙ্কি মডেল হতে চায়, ফটোগ্রাফার দিয়ে অ্যানিভার্সারিতে আমাদের কিছু ছবি তুলেছিল, সেখান থেকে তার কিছু একক ছবি সে এখানকার বুটিক শপগুলোতে গিয়ে দিয়ে এসেছে। আমাকে একদিন বলল, সে মডেল হবে।
খুবই বিরক্ত লাগল শুনে, তোমার কেন এত কিছু থাকতে মডেল হতে হবে? হাজারটা মানুষ তাকিয়ে থাকবে তোমার দিকে, কে কত রকম ভাববে, এটা কি খুব ভালো কিছু? শরীর দেখিয়ে বাহবা কুড়ানো?

রিঙ্কি এমন রেগে গেল, সামনে থাকা ফুলদানি ছুড়ে ফেলে ভাঙল, আরও অনেক কিছু ভেঙে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

আমি বলে খেত, ব্যাকডেটেড!

দেখুন, আমাদের পরিবারের একটি সম্মান আছে, সেই বাড়ির বউয়ের এমন পোশাক, আর মডেল এসব কিছুতেই যায় না, আমার মা–বাবা জানলে খুবই কষ্ট পাবেন, আমার মাকে মাথায় কাপড় ছাড়া কেউ কোনো দিন দেখেননি, আমার বোনেরাও যথেষ্ট শালীন পোশাক পরে, তারাও তো চাকরি করে, কখনোই কোনো সমস্যা হয়নি।

বুঝলাম, কিন্তু এগুলো আপনার তাকে বিয়ের আগেই বলা দরকার ছিল, আপনি তো বেশ অনেকবার দেখা করেছেন তার সঙ্গে, একেকজনের বেড়ে ওঠা একেক রকম, যার যেটা স্বভাব, সে সেটা হুট করে বদলাতে পারে না, বিয়ে একটা অনেক বড় সিদ্ধান্ত।

জি, বুঝতে পারিনি। আর একদিন দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখি, বাসায় নেই। ফোন করলে বলল, ডেটিংয়ে গেছে! নিয়মিত জিমে যেত শরীর ফিট রাখতে, সেখানে নাকি এক ছেলের সঙ্গে পরিচয়, তাকে নিয়ে দুই ঘণ্টা লংড্রাইভে দূরের এক বিচে ঘুরতে গেছে!
আমি বললাম, আমাকে তো বলোনি?

এটা শুনে এত সিনক্রিয়েট করল। বলে, আমি স্বামী হয়ে কি তার মাথা কিনে নিয়েছি, সব কৈফিয়ত দিতে হবে?

তার নাকি রিলাক্স করতে বয়ফ্রেন্ড প্রয়োজন, আমি বলে বেশি ব্যস্ত থাকি, সময় দিই না তেমন।

কেমন লাগে বলেন?

আমি তো চাকরি করি, উপার্জন করি সংসারের জন্যই, বাড়ি করার জন্য জায়গা বুকিং দিয়েছি, ব্যস্ত থাকি।

সে বাসায় আসার পরে আবারো ঝগড়া, বলে আমি যদি তার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করি, তাহলে সে বিষ খেয়ে সুইসাইড করবে, আর চিরকুট লিখে যাবে মৃত্যুর জন্য নাকি আমি দায়ী! অথবা পুলিশ এ অ্যাবিউসের রিপোর্ট করবে। আচ্ছা এগুলোকে কি নারী স্বাধীনতা বলে?

আমি তার স্বামী, সে কেন আমাকে বলবে না? সে বিবাহিত, তার কেন বয়ফ্রেন্ড থাকবে?
‘ও হো, তিনি তো বিপজ্জনক দেখছি! আপনি আপনার জিপিকে এগুলো জানিয়ে রেখেছেন তো?যেকোনো সময় ঘটনা যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে, যেহেতু তৃতীয়পক্ষ আছে।

জি বলেছি, কিন্তু রিঙ্কি বদলায় না; বরং দিন দিন তার বয়ফ্রেন্ডের সংখ্যা বাড়ল। সবার সঙ্গেই ঘুরতে চায় এবং যায়। সেই সময় আমার এক বন্ধুর পরামর্শে মনে হলো বাচ্চা নেই, তাহলে মনে হয় বদলাবে, এত ভুল চিন্তা ছিলো আমার,এত বড় ভুল। রিঙ্কি একটুও বদলায়নি, অত্যাচার আরও বেড়েছে, বাচ্চার বয়স ছয় মাস হওয়ার পর থেকেই সে আবার একদম আগের মতোই।

এই ছয় মাস তার মা এসেছিলেন। ওদের ফ্যামিলি কিন্তু ঢাকায় সেটেল্ডও না। একটা দুই রুমের বাসায় ভাড়া থাকে। ২ বোন, ২ ভাই, বাবা–মা। অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন ভালো না, আমি এগুলো নিয়ে কখনোই কিছু বলিনি। ভেবেছিলাম, রিঙ্কির মা এসে রিঙ্কিকে শাসন করবেন; কিন্তু কিছুই বলেন না, উল্টো রিঙ্কি যা বলে, তিনিও তা–ই  শোনেন। আমাকেই এটা–সেটা অর্ডার করে সারাক্ষণ।

এখন আমার বাবা–মাকে বলতে গেলেও সমস্যা। বলেন, আগেই তো মানা করেছিলাম, ওখানে বিয়ে না করতে, এখন দুনিয়ার সবকিছু করা যাবে, কিন্তু ডিভোর্স দেওয়া যাবে না, বাচ্চা আছে একটা ইত্যাদি ইত্যাদি।

এখন আমি কি করব ম্যাম? ডিভোর্স দিলে রিঙ্কি কী করবে সেটিও বুঝতে পারছি না, কিন্তু এসব আমি আর নিতে পারছি না। সারাক্ষণ বিমর্ষ থাকি, গত বছর নিজের বাড়িতে উঠেছি; কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না, রিঙ্কিকেও না, আলাদা ঘরে ঘুমাই।

‘আপনি কী করবেন সেটা আপনার সিদ্ধান্ত, তবে আপনার যা বয়স, তাতে আপনার সামনে গড়ে  আরও ৩০-৩৫ বছর আছে। একটা ভুল বিয়ে আর বাচ্চার কথা ভেবে আপনি কি সারা জীবন এই যন্ত্রণায় থাকবেন,  না বেরিয়ে আসবেন, সেটা ভালোভাবে চিন্তা করেন।

কারণ, সংসার আপনি করেন, আপনার বাবা–মা না, বন্ধুরা না। আর যেই সংসারে ১২ মাস অশান্তি লেগে থাকে, সেই সংসারে বাচ্চারা আরও অসহায় ও মনঃকষ্টে বড় হয়; যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ থেকে আসা পরিবারগুলো এই সত্যটা মানতে চায় না। তারা বাচ্চার দোহাই দিয়ে একটা অমানুষিক কষ্টের জীবন বেছে নেয়। এতে নিজের এবং বাচ্চার দুজনেরই মারাত্মক ক্ষতি করে। শিশুরা খুব দ্রুত যেকোনো পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে, যদি তারা সেখানে শান্তি পায়।

আপনার ওয়াইফ Dissociative Identity Disorder–এ ভুগছে, তার জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসা প্রয়োজন। নয়তো আরও বেপরোয়া হয়ে যাবে।

জি , কিন্তু আমার মনে হয়, আমি গভীর সমুদ্রে পড়ে গেছি, সাঁতরে পার পাচ্ছি না।
আপনার অবস্থা শোচনীয়; কারণ, আপনি তো বিবাহিত জীবনে সংসারী মেয়ে চেয়েছিলেন; কিন্তু মোহে পড়ে বিয়ে করে এখন কষ্ট পাচ্ছেন।

এ জন্য বিয়ের সময় নিজেদের আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে এবং সামাজিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধে মিল আছে,  তেমন পরিবার থেকে ছেলে বা মেয়ে আনতে হয়। খুব বেশি গরমিল হলেই এমন সমস্যা দেখা দেয়। তখন প্রেম, ভালোবাসা ফিকে হতে শুরু হয়।
ডেটিং লাইফ আর বিবাহিত লাইফ সম্পূর্ণ আলাদা।

আমি কি তাহলে সেপারেশনের ফাইল লজ করব?
সেটি একান্তই আপনার সিদ্ধান্ত। চিন্তাভাবনা করে একটি সিদ্ধান্ত নেন। এভাবেই সহ্য করে থেকে যাবেন, নাকি বেরিয়ে এসে নতুন করে কিছু ভাববেন।
আচ্ছা, আজ তাহলে উঠি, প্রয়োজন হলে আর একদিন আসব, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

প্রয়োজন হলে অবশ্যই আসবেন , ভালো থাকবেন, সৃষ্টিকর্তা আপনার সহায় হোন।হাসিবুল হক চিন্তিত মুখে উঠে চলে গেলেন। কিন্তু আর এলেন না, পরবর্তী সময়ে তিনি কী করেছিলেন, তা আর জানা গেল না।