মা তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়নজলে ভাসি!
‘আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৃদয়ের স্পর্শে, কী বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে আমাদের গৌরবদীপ্ত জাতীয় সংগীত! আমাদের সব আবেগ, সমস্ত দরদ, আমাদের প্রাণের কথামালা, কত বাস্তব হয়ে উঠেছে, চিত্রিত হয়েছে দেশপ্রেমের চূড়ান্ত স্বপ্নগুলো। হ্যাঁ! আমার সোনার বাংলা!
এ দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। ঘোরস্বপ্নে মগ্ন হয়ে থাকা, এ তো এ দেশের আকাশ, মাটি, বাতাস, সবুজ বনানী, পাখ-পাখালি, সোনালি শস্যে মাতম মাঠের পর মাঠ সম্মিলিত প্রয়াসে শিখিয়েছে। আবার গুরুগম্ভীর মেঘগর্জনে, ঘূর্ণিঝড়ে, বন্যায়, খরায়, তাণ্ডবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা, প্রতিবাদী হয়ে ওঠা এই বিচিত্র স্বভাবের আচরণ প্রকৃতিই শিখিয়েছে এ দেশের মানুষকে।
স্বপ্নবাজ বাংলাদেশের মানুষ। বুকে লালিত স্বপ্নকে ধারণ করেই সামনে এগিয়ে যেতে চায় সবাই। কিন্তু, স্বপ্ন দেখতে দেখতেই তাদের স্বপ্ন খানখান হয়ে গুঁড়িয়ে যেতে দেখেছে তারা বার বার, অসংখ্যবার। অনির্বচনীয় ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত হয়ে তাঁর তাই আউল–বাউল–কবি সেজে হাতে তুলে নিয়েছে দোতারা, বাঁশি। রচনা করেছে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মারফতি, মুর্শিদি, অসংখ্য পালা, কবিগান। বিমুগ্ধ হয়ে সুরে সুরে সবার হৃদয় মাতম করেছে স্বপ্নচারী মানুষেরা। আহা! কত সহজ সরল এ দেশের সাধারণ মানুষ! কত শৈল্পিক তাঁদের জীবনাচরণ!
এ দেশের সাধারণ এই স্বপ্নচারী মানুষের স্বপ্নের বাসরে নিভৃত সঙ্গোপনে দুর্বৃত্ত হানা দিয়েছে বারবার। শাসক, শোষক, দুর্বৃত্ত হানাদার সেজে তারা কেড়ে নিতে চেয়েছে ঘরের সম্পদ। দেশের সম্পদ। মান-মর্যাদা, সোনালি ঐতিহ্য! নিয়েছেও!
চোখে অনাবিল স্বপ্ন। হাতে দোতারা। গলায় মোহনীয় সুর। সব কিছু ছেড়ে–ছুঁড়ে ফেলে এ দেশের মানুষ সংগঠিত হয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে এগিয়ে গেছে দুঃসময়ের মুখোমুখি। ওই আসছে বিদেশি দুর্বৃত্ত বেনিয়া! আসছে ধেয়ে তাণ্ডব! প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়! পাহাড় সমান জলোচ্ছ্বাস! সামাল সামাল রব উঠেছে পুরো ভূখণ্ডজুড়ে। বাঙালি তাঁরা সকলে একজোট হয়ে প্রতিরোধ রচনা করেছে। ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুঃসময়ের মুখোমুখি।
তো, সমূহ বিপত্তির ও অসম শত্রুর মোকাবিলা করে সঙিনের সামনে অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে বাঙালি, এ দেশের মানুষ বার বার প্রমাণ করেছে এ দেশ, এ জনপদ, এ জন্মভূমি সকলের কাছে জন্মদাত্রী মায়ের মতই প্রিয়। বিজাতি দস্যুদের হাতে মাতৃতুল্য এ দেশকে তারা দলিত হতে দেবে না। লুণ্ঠিত হতে দিবে না। একেবারেই না!
সময়ের বিক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝায়, একের পর এক, উপর্যুপরি তাদের সমূহ স্বপ্ন, ভগ্ন হয়ে যায়। এ দেশের মানুষ মাকে ‘মা’ বলে ডাকতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হয়। মুখের ভাষা—সেটাকেও কেড়ে নিতে চায় দুর্বৃত্তরা। শুধু কী ভাষা? স্বাধীনতা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত, রাষ্ট্রীয় সম্পদের, সুযোগের সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য, ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার সবাইকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কেন? আশ্বাসে বিশ্বাসে বার বার হোঁচট খেতে খেতে একসময় তাদের অনাবিল রঙিন স্বপ্ন ভেঙে যায়। আর নয়। এবার হবে চূড়ান্ত রাজনৈতিক ফয়সালা। চাই স্বাধীনতা! আমাদের ভাষা, আমাদের কৃষ্টি, আমাদের মাটি, সব মিলিয়ে আমাদের এই দেশ, একান্ত আমাদের সম্পদ। এ দেশ মাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে’ ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত ডাক এল। গাঁও-গেরামের মেঠো প্রান্তর থেকে উঠে আসা একজনের প্রতিবাদী কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম! এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!’
অসহায় মুক্তিপাগল মানুষ আর ঘরে ফিরে না। সকলের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে। এখন দুর্নিবার প্রতিরোধ ছাড়া আর কোনো গতি নেই। তাই হলো। সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল আবাল-বৃদ্ধ, ছাত্র-জনতা সকলে। মাঠের কৃষক। ঘাটের মাঝি। কামার, কুমার। নারী, পুরুষ। কেহই বাদ রইল না। ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি হলো। সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সম্মুখ যুদ্ধে। বাঁচা-মরা যুদ্ধ। রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, মা-বোনের সম্ভ্রম ইজ্জত নির্বিশেষে সব বিসর্জন দিয়ে চূড়ান্ত ফয়সালার দিকে আপামর জনমানুষ, গোটা জাতি এক কাতারে, এক পতাকা তলে অবস্থান নিল।
পরিশেষে, স্বাধীনতার রক্তলাল সূর্যটাকে, সবুজের বিস্তীর্ণ জমিনে প্রাণবন্ত অবয়বে রচনা করল তাঁরা। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক নতুন একটি দেশের জন্ম দিল তাঁরা। তাঁরা সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙালি। তাঁরা অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে প্রাণ বিসর্জনকারী, ৩০ লক্ষ শহীদ বাঙালি। তাঁরা দুই লক্ষ নির্যাতিতা বাঙালি মা-বোনেরা। তাঁরা অন্য রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণকারী এক কোটি উদ্বাস্ত বাঙালি। সবারই তাঁরা মিলে মুক্ত আকাশে প্রাণের পতাকা উড়িয়ে গেয়ে উঠেছিল, ‘আমার সোনার বাংলা। আমি তোমায় ভালবাসি!’ তাঁদের সবার কণ্ঠে, উচ্চারিত হয়েছিল হৃদয়ের জারণরসে জারিত, অমিয় কাব্যের এই চিরসবুজ প্রাণিত পঙ্ক্তিমালা!
কিন্তু! এত কিছুর পরও, এ দেশের মানুষ তারপরও হোঁচট খায়। থমকে দাঁড়ায়। এ কেমন স্বাধীনতা! এই স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে, দেশপ্রেমের ধূয়া তুলে ঘরের বিভীষণ এবার শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। কালো শকুনদের ভয়াল থাবা দেশমাতৃকাকে খামচে ধরে। তাঁকে তারা বে-আব্রু করতে চায়! রক্তাক্ত লাল-সবুজ পতাকায় সেই লোমশ হায়েনার হাত ভিন্নরূপে, সমূলে হামলে পড়ে আবার। মুক্তিযুদ্ধের, মহান স্বাধীনতার মুল-চেতনাকে খণ্ডিত-বিখণ্ডিত করতে এরা সক্রিয় হয়ে মাঠে নেমে পড়ে।
হায়, আমাদের দেশমাতৃকা সোনার বাংলা! আজকে মানুষ দেখে, বাংলা-মায়ের মুখ আবার বেদনার্ত। মলিন। বিবর্ণ হয়ে পড়েছে তাঁর সৌন্দর্য। এবার সেই ‘বিদেশী বেনিয়া’ নয়! স্বদেশী মানুষের ষড়যন্ত্রের ঘোরচক্রে আবর্তিত হয়, এই সোনার বাংলার সরলপ্রাণ মানুষ! তারা কারা? এই তারা তো সেই পরাজিত ‘বিদেশি বেনিয়াদের’ দোসর! তারা তাদের পুরনো লেবাস গায়ে চড়িয়ে, হামলে পড়তে চাইছে আবার!
আজ দেশমাতার দুর্দশা দেখে, তাঁর কোটি কোটি সন্তান এখনো তাই নয়ন জলে ভাসছে। কেবলই ভাসছে ...! সকলের কণ্ঠে আজ, বেদনার্ত উচ্চারণ, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়নজলে ভাসি!’