সবাইকে বিশ্ব কন্যা দিবসের শুভেচ্ছা
ইদানীং ঝামেলাবাজ নাওয়ার সাহেব কিঞ্চিৎ কেয়ারিং হচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি। নাওয়ার আমার মেয়ে। আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক অম্লমধুর। গত সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টা ড্রাইভ করে গেলাম লস অ্যাঞ্জেলেসে খালার বাসায়। সেদিনই ডর্মে তার মুভ ইন করার কথা। ফেরার পথে দেখা করে আসব কথা ছিল। মেয়ে নিজে গোছাবে, আমার সাহায্য লাগবে না বলে দিল। বলল, তুমি না এলেও চলবে। এ রকম অনেক কিছু সে না করে, আমি তবু যাই। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ফেরার পথে টায়ার ফ্ল্যাট হয়ে যাওয়াতে সানডিয়াগো ফিরতে অনেক সময় লেগেছিল। মেয়ে চার-পাঁচবার ফোন করেছে, যেটা সে কখনো করে না; কিন্তু ফোন ধরিনি। কারণ, রাত ১০টায় অচেনা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোড সাইড অ্যাসিস্টেন্স নিয়ে চাকা বদলানো হচ্ছে, এটা তাকে জানানো যাচ্ছিল না। পরে রাত একটায় তাকে বলেছি, বাসায় পৌঁছেছি, মা। সে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে বলে দিয়েছে, তোমার একা একা এতটা পথ ড্রাইভ করা নিষেধ, বুঝেছ? বললাম, কবে থেকে তুই আমার মা হয়ে গেলি, হুম?
হুড়োহুড়ি করে দৌড়ে কাজ করা আমার স্বভাব। সুতরাং ঘরের দরজায়, গাড়ির দরজায় বাড়ি খেয়ে হাত লাল নীল হওয়া নতুন কিছু নয়। তবে একটা কনফারেন্সে যাব, সামারের ছুটি তখন তার। হাতে নীল দাগ দেখে সে মুখ কালো করে বলল, এভাবে কীভাবে যাবে, মা? মেকআপ দিয়ে হাতের রং ঠিক করে নিয়ো। আমি বললাম, মা, কারও এত সময় নেই তোর মায়ের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকার। পরদিন ভোরে রেডি হতে উঠেছি, মেয়ে দেখি মেকআপ হাতে এসে দাঁড়িয়েছে, মায়ের নীল হাত ঠিকই সে বাদামি করে দিল।
সেদিন রাতে ডিউটি করছি হাসপাতালে, হুট করে বিদ্যুৎ গেল, ১৩ বছরে প্রথমবারের মতো। ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল অফিস। করিডরে বের হয়ে দেখলাম ইমার্জেন্সি লাইট জ্বলছে। রোগীদেরসহ সব রুমে একটা লাইট জ্বলছে। তবে কম্পিউটার কাজ করছে, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। পুরো রাত কাজ করতে হবে। এমন সময় মেয়ে ফোন করল, মা, ভালো আছ? অথচ আমাদের হাসপাতাল আর আশপাশের কিছু জায়গায় বিদ্যুৎ গেছে শুধু। এটা তার জানার কথা নয়। সে ফোনও করে অনেক কম। বললাম, আছি মা, ভালো।
এর মধ্যে ভীষণ অসুস্থ একজন রোগী এলেন। বাঁচানো যাবে না হয়তো। রোগী কানে একটু কম শোনেন, কিন্তু টনটনে জ্ঞান। বললেন, তিনি নাচতে ভালোবাসেন। যদি নাচতেই না পারেন, তাহলে বেঁচে থাকার আর কোনো কারণ নেই তাঁর। একটা সুন্দর জীবন পেয়েছেন তিনি। তবে আমার সময় থাকলে আমি যেন অবশ্যই তাঁর মেয়েকে কল করে জানাই। চাকরির কারণে ছয় ঘণ্টা দূরত্বে থাকেন তাঁর মেয়ে। এর পরপরই কোমায় চলে গেলেন রোগী। যত ওষুধ আর ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা নিলাম, তাঁর অবস্থা শুধু খারাপ হচ্ছে।
ফোন করলাম তাঁর মেয়েকে। ফোন পেয়ে মেয়ে বললেন, তিনি আসছেন। কয়েক হাজার মাইল গাড়ি চালিয়ে আসবেন তিনি। বললাম, রোগী কোমায় আছেন, আপনি না এলেও পারেন। তিনি যেকোনো সময়ে চলে যাবেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। তাঁর মেয়ে শুনলেন না। এরপরের ছয় ঘণ্টা আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম রোগীর রুমে। যেই ঠিক করি একটু স্টেবল হলে অন্য রোগী দেখতে যাব, আবার তাঁর অবস্থা খারাপ হয়। রোগীর হুঁশ ফিরছে না। এত চেষ্টা না করে শুধু তাঁর কষ্ট কমানোর চেষ্টা করলেই ভালো হতো মনে হয়। এমন সময় তাঁর মেয়ে এলেন রুমে। তিনি ড্রাইভ করে চলে এসেছেন। এরপরের ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা। মেয়ে আসামাত্র রোগী চোখ খুললেন। বললেন, মা, আমি খুব খুশি হয়েছি, তুমি এসেছ। এখন আমি যাই, কেমন? তারপর মনে হয় আর পাঁচ মিনিট বেঁচে ছিলেন তিনি। মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার কষ্টটা ক্লোসার পেল। ঠিক এ সময় বিদ্যুৎ চলে এল। মেয়েটি বললেন, এতটা কাছাকাছি চলে এসেছিলেন তিনি, টিনএজার বয়সটা পার হওয়ার পরপরই। তাঁর যেকোনো সমস্যায় মা কেমন করে টের পেয়ে যেতেন। সব সময় সঙ্গে ছিলেন। মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এলাম।
আমার আজন্ম সাধ, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় শেষ মুহূর্তে এভাবে যেন সন্তানদের মুখ দেখে যেতে পারি। সবাইকে কন্যা দিবসের শুভেচ্ছা। আলোকিত হোক পৃথিবী তোমাদের আলোয়।