এবং উপহার...

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ছোটবেলায় ডায়মন্ড কমিকসের ‘চাচা চৌধুরী’, ‘বিল্লু’, ‘পিঙ্কি’ অথবা নারায়ণ দেবনাথের ‘নন্টে ফন্টে’ ছিল আমার খুব প্রিয়। সময়টা ছিল ১৯৯৪-২০০১! ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আদান–প্রদান করে বই পড়তে কী যে ভালো লাগত!

এমন অনেক দিন গেছে, বান্ধবীর বইটা পড়া শেষে গিয়েছি ফিরিয়ে দিতে, অমনি:

না ফাল্গুনী, এইটা তুমি রেখে দিয়ো।

মানে? হলো কী?

না, এগুলো আমার আরও আছে তো, এইটা তুমি নাও।

কচি বয়সের ভালোবাসা, বেশ লাগত।

হয়তো ক্লাসে টিফিনের ফাঁকে খালারা (সাহায্যকারী) গ্রাম থেকে আনা গাছের কাঁচা আম ধরিয়ে দিতেন। খালা, তোমার জন্য আনলাম।

আমি আবার কাঁচা আম গুড়, লবণ, কাঁচা মরিচ মেখে খুব খাই, কাসুন্দি দিয়েও।

অফিসে থাকা হিন্দু সহকর্মীটি মুড়িমুড়কি ও নারকেলের নাড়ু দিতেন ধরিয়ে।

দিদি, আপনার বউদি করেছেন আপনার জন্য।

ইউনিভার্সিটির ক্যানটিনের মামাকে বলার আগে দই–ফুচকা হাজির, টাকা নেবেন না। এমনকি পরিচিত বাসে চালককেও দেখতাম, পকেটে মিস্টার ম্যাঙ্গো ক্যান্ডি রাখতেন আমার জন্য। প্রিয় শিক্ষিকাকে দেখেছি চুড়ি ভালোবাসি দেখে নিজের হাতের গয়না খুলে পরিয়ে দিতে, পরীক্ষায় ভালো করেছিলাম তাই।

মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করতাম, কিরে, এত আদর? প্রশ্নের উত্তরে অবাক হতে হতো। সেই হিন্দু সহকর্মীটির কথা, দিদি, অনেক মুসলমানকে বলতে শুনি আমি বিধর্মী। তার ওপর আবার পিয়ন। আমার বাড়ির খাবার খেলে জাত যায়। বিশ্বাস করো দিদি, এগুলো একটাও প্রসাদ নয়, এগুলো আলাদা করে তোমার জন্য করা। তোমার তবু জাত যাবে, দিদি? তোমার বউদি তো তোমায় ভালোবাসেন।

জানতাম। ভদ্রলোকের সন্তানহীনা স্ত্রী কোনো এক অজানা কারণে আমায় ভীষণ ভালোবাসতেন। তাঁর সব হাসিকান্না জমা রাখার জায়গা ছিলাম আমি। স্ত্রীটি মা হতে অক্ষম ছিলেন না, সমস্যা স্বামীর। নারীর ভালোবাসার মানুষটির অপমান সহ্য করতে পারবেন না বলে মিছেই নিজের ওপর অপবাদ টেনে নিয়েছিলেন, বন্ধ্যা হওয়ার অপবাদ।

ওই খালাদেরও এক কাহিনি। ওনারা বুয়ার কাজ করেন বলে নাকি কথা বলার যোগ্য নন। আমি হাসি, কেন গো খালা, আপনারা মানুষ না নাকি?

ওই মামা বা বাসচালককে কেবল দৈনিক একবার ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞাসা করার পুরস্কার ওই ফুচকা আর ক্যান্ডি।

সেই শিক্ষিকাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মিস, এই চুড়িজোড়া তো আপনাকে মানাত, আমি? মিস বলেছিলেন, কাচের চুড়ি হয়তো অন্যদের অনেকের ডাস্টবিনের কোনায় পড়ে থাকবে, তুমি এর আড়ালে থাকা আদরটুকু বুঝে নিয়ো। এরপর আর মনে হয় কিছু বলার থাকে না। ওনার এক হাতে টেনে নেওয়া আলিঙ্গনের জবাবে সেদিন বিড়ালছানার মতো কতক্ষণ ওনার বুকের ভেতর আটকে ছিলাম। মাতৃসম ভদ্রমহিলার স্নেহের পর থেকে বৃষ্টির মতো ঝরেছে আমার ওপর, আর আমি ভীষণ উপভোগ করেছি সেটা।

আসলে আমার কাছে সত্যিকারের উপহার এই ভালোবাসাটুকু। এইটাই শক্তি। আর আপনি হিন্দু না খ্রিষ্টান, বেটে না খাটো, কালো না সাদা, আমার কিচ্ছু যায়–আসে না। আমার প্রতি আপনার আচরণ কেমন? আমি আপনার কাছে কে বা কী, ওইটুকুই বিবেচনায় রাখব। কারণ, আমার কাছে ‘সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।’

*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]