স্বপ্ন যাবে না বাড়ি আমার...

"ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক

পবিত্র শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গিয়েছে। আগামীকাল সকাল আটটার সময় বাড়াদি পশ্চিম পাড়া ঈদগাহ ময়দানে পবিত্র ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। সবাইকে নিজ নিজ জায়নামাজ সহ ঈদগাহে উপস্থিত হবার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।"

ঈদুল ফিতরের সময় আসলে আমার কানে বাজে এই ঘোষণা। সাধারণ এই ঘোষণাটার মধ্যে এমনকিছু আছে যেটা প্রাণ ধরে টান দেয়। মনেহয় পৃথিবীর যেখানেই থাকি ঈদের দিন বাড়িতে যেয়ে হাজির হই। যেখানে আমার মা ঈদের দিন খুব সকালে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। উঠেই রান্নাঘরে চলে গেছেন। সেখানে বাজার থেকে কিনে আনা খোলা সেমাই মাটির চুলায় ভাজা হচ্ছে। এরপর সেটাকে রান্না করা হবে। এরপর চড়ানো হবে খিচুড়ি। ইতোমধ্যে আমরাও উঠে পড়ে কলপাড়ে চলে এসেছি। আমি আর মেজো ভাইটা নিজে নিজে গোসল করতে পারি। আব্বা তাই ছোটজনকে গোসল দিচ্ছে। আমরা তিনজনই একসাথে বাসনা সাবান দিয়ে গোসল করে ফেলি। এরপর মাথা মুছে তৈরি হতে থাকি। এরমধ্যেই আব্বাও গোসল টা সেরে নেন। টানাটানির সংসারে আলাদাভাবে ঈদের পোশাক বানানো হয় না। ঈদের স্কুলের পোশাক বানিয়ে দেয়া হয়। সেটাই একইসাথে ঈদের পোশাক হিসেবেও কাজ করে।

নতুন জামা নিয়ে আমাদের কোন আলাদা বায়না কখনওই ছিল না। পাড়ার সব বন্ধুরা মিলে একসাথে আনন্দ করাটাই ছিল মুখ্য। পোশাক পরা হয়ে গেলে আব্বা ছোট তুলার টুকরো আতরের শিশির মুখে ধরে সেটা প্রথমে ভিজিয়ে নিতেন। এরপর সেটা আমাদের বুকে বগলে মাখিয়ে ডান কানের ভাজে গুজে দিতেন। আমাদের গা থেকে তখন আতরের সুবাস ছড়িয়ে পড়তো। এরপর উনি চোখে সুরমা দিতেন। আমরা সুরমা নিতে চাইতাম না। কারণ সুরমা নিতে যেয়ে সেটা প্রায়ই চোখের মধ্যে পড়ে যেত। তখন চোখ চুলকানো শুরু হতো। আতর সুরমা দেয়া হয়ে গেলে মা রান্নাঘর থেকে সেমাই নিয়ে হাজির হতেন। ঈদের নামাযে যাওয়ার আগে মুখ মিষ্টি করা সুন্নত। তাই আমরা সবাই একটু করে সেমাই মুখে দিয়েই বেরিয়ে পড়তাম। বের হবার আগে মা আমাদের হাতে কখনও এক টাকা কখনও বা দুই টাকার একটা নোট দিয়ে দিতেন ঈদের সালামি হিসেবে। জীবনে আমি অনেক জায়গায় অনেক রকমের সেমাই রান্না খেয়েছি কিন্তু আমার মায়ের হাতের এই সেমাই রান্নার তুলনা নেই।

সেমাই খাওয়া শেষ করেই আমরা স্পঞ্জের দুই ফিতাওয়ালা স্যান্ডেল পরে পটপট শব্দ করে বেরিয়ে পড়তাম। আব্বার এক হাতে একটা বড় শীতল পাটি। অন্য হাতের কেনে আঙুল ধরে আছে ছোট ভাই। আমরা বের হতে হতেই বন্ধু সালামও বেরিয়ে পড়তো। তারপর সবাই মিলে দলবেঁধে ঈদগাহে যাওয়া। ঈদগাহের চারিদিকে পাটের সুতলি দিয়ে ঘিরে ফেলা হতো। সেই সুতলির সাথে ঝুলতো বাহারি রঙের তিনকোনা আকৃতির কাগজ। গ্রামে যেকোনো উৎসবে এই কাগজের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। তাই এই কাগজের সাজ দেখলেই আমাদের মনে উৎসবের আবহ তৈরি হতো। ঈদগাহে জায়নামাজ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের তহবিল সংগ্রহ করা হতো। দুজন জায়নামাজের দুই মাথা ধরে নৌকার মতো করে আমাদের সামনে মেলে ধরতেন। মানুষেরা যে যার সামর্থ্য মতো তার মধ্যে দান করতেন। এরপর হুজুরের পেছনে দুই রাকাত নামায পড়ে আমরা একে অপরের সাথে কোলাকুলি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। ঈদে সবার সাথে সবার দেখা হওয়ায় ঈদগাহ ময়দান একটা মিলনমেলায় পরিণত হতো। নামায শেষ করে অনেকই ঈদগাহ লাগোয়া কবরস্থানে যেয়ে প্রিয়জনের কবরটা জিয়ারত করে আসতেন।

ঈদগাহ থেকে বেরিয়ে আমরা বাসার পথ ধরতাম। ঈদগাহের পাশের রাস্তার দুপাশে খাবার আর খেলনার দোকান বসে যেত। খাবারের বেশিরভাগ দোকানগুলোই দিতেন আমাদের পাড়ার হিন্দুরা। পাল পাড়ার মানুষেরা দিতেন বাতাসা, ছাচ, কদমা, খাগড়াই সহ বিভিন্ন শুকনো খাবারের দোকান। আমাদের বাড়ির উল্টো পাশের বরগী দাদু কড়াইতে গরম গরম জিলাপি ভাজতেন। বেশিরভাগ মানুষই এই জিলাপি কিনে বাড়ি ফিরতেন। কিন্তু আমাদের আকর্ষণ ছিল সস্তার পাপড়ের প্রতি। আমরা সবাই একটা করে পাপড় ভাজা কিনে খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম। এরপর বাড়ি ফিরে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় মেতে ওঠা। কেউ মার্বেল খেলতো। কেউবা সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে বানানো তাস। এভাবে চলতে চলতে দুপুর গড়িয়ে হয়ে যেত। বিকেল তিনটার সময় বিটিভিতে ঈদের ছবি দেখানো হতো। তখন আমরা সবাই সালামদের বাড়িতে যেয়ে হাজির হতাম। ঈদের সময় বাড়তি আকর্ষণ ছিল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি দেখা।

এরপর সন্ধ্যার আগে আগে সমাজে সিন্নি নিয়ে যাওয়ার চল ছিল। আমাদের পাড়ায় তখন দুটো সমাজ ছিল। একটা বাগাড়িদের অন্যটা মন্টু চাচাদের। আমরা বাগাড়িদের ওখানে যেতাম। কারণ উনারা আমাদের দুসম্পর্কের চাচা হন। সমাজে সমাজে কোন বৈরিতা ছিল না। সমাজগুলো তৈরি হয়েছিল মানুষের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ানোর জন্য। একটা গ্রামের সবাই সবাইকে চিনে, সবাই সবার সুবিধা অসুবিধা জানেন। আপাতদৃষ্টিতে মনেহয় একটা গ্রাম যেন একটা একান্নবর্তী পরিবার। সমাজে সিন্নি নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের তেমন আগ্রহ ছিল না কারণ তাহলে ছবি দেখা মিস হয়ে যাবে। তবুও যেতে হতো। বিভিন্ন বাড়ি থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী সিন্নি আসতো। আর ছোট ছেলেমেয়েরা আসতো প্লেট নিয়ে। এরপর সবাইকে গোল হয়ে বসতে হতো। গোল হয়ে বসার পর বৃত্তের কেন্দ্রে সব বাড়ির খিচুড়ি একটা বড় গামলায় মিশিয়ে এক করে ফেলা হতো। তখন আর বুঝা যেত না কোনটা বড়লোকের খিচুড়ি আর কোনটা গরীব মানুষের খিচুড়ি। এরপর সমান পরিমাণে প্লেটে প্লেটে দিয়ে দেয়া হতো। এই খিচুড়ি স্বাদ ছিল অনন্য। গরীব মানুষেরা স্বভাবতই অনেক বেশি খিচুড়ি নিয়ে ফিরতেন কারণ তাদের ছেলেমেয়ে অনেক। সেই খিচুড়ি জ্বাল দিয়ে দিয়ে রেখে তারা অনেকদিন ধরে খেতে পারতেন। এভাবেই আমাদের সাদামাটা কিন্তু আনন্দময় ঈদের দিনটা কেটে যেত। ঈদের সবচেয়ে মুখ্য দিকটা ছিল পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া। যে যেখানেই থাকুক ঈদের সময় তাই স্বজনের কাছে ফিরে আসতেন।

জীবনের বহমানতায় একসময় ঢাকায় চলে আসলাম। কিন্তু ঈদের সময় আসলেই যেকোনোভাবেই হোক কুষ্টিয়া যাওয়া চাইই চাই। ঈদের বাসেরভটিকিট পাওয়া ছিল সোনার হরিণ পাওয়ার মতো ব্যাপার। কিন্তু এইসব কোন বাধাই আমাদেরকে ঢাকায় আটকে রাখতে পারতো না। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। গরীব খেটে খাওয়া মানুষের এই জীবনবোধ নিয়ে আমাদের শিক্ষিতরা অনেক সমালোচনা করেন। আরে গ্রামে কি আছে যে যেতেই হবে। অনেকেই বলে ঈদের সময় দ্বিগুণ বেতন বোনাস দিয়েও এদের রাখা যায় না। আর গেলে আসার নাম করে না। করোনার লকডাউনের সময় সবধরনের যানবাহন বন্ধ করে দেয়া হলো। তবুও মানুষ ফেরি ভর্তি করে, ভেঙে ভেঙে গ্রামে ফিরল। এগুলো নিয়ে অনেক কথা হলো কিন্তু আমি এর পেছনের কারণটা জানি। তাই আমি মোটেই অবাক হইনি।

এরপর একসময় অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলাম। প্রবাসীদের জীবনে উৎসবের দিনগুলো বাড়তি দু:খের কারণ। এখানে সবই আছে কিন্তু প্রিয়জনের ওম নেই তাই সব থেকেও আসলে কিছুই নেই। তাই প্রবাস জীবনকে আমি বলি ফাঁপা জীবন বিশেষকরে যারা প্রথম প্রজন্মের। যারা জীবনের অর্ধেক সময় দেশের আলো বাতাসে বেড়ে উঠেছিল। এরপর মধ্য বয়স পেরিয়ে গেলে যখন বিদেশে পাড়ি জমায় তখন এই দোটানা টা থেকেই যায়।

উৎসবের দিনগুলো বাড়তি মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তখন দেশের কথা দেশে ফেলে আসা স্বজনের কথা সবচেয়ে বেশি করে মনেপড়ে। দেশের ঈদের সাথে মিলিয়ে এখানে ছুটি মেলানো অসম্ভব। পাশাপাশি বাচ্চাদের স্কুলও খোলা থাকে। এছাড়াও আসাযাওয়াটা যথেষ্ট খরুচে। তাই সবার সাধ্যেও কুলায় না। সবমিলিয়ে দেশে আর ঈদ করতে যাওয়া হয় না। ঈদের দিন সামনে আসলেই আমি তাই টিভিতে ইউটিউবে মিলন মাহমুদের 'স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার' গানটা ছেড়ে দিই এবং বারংবার শুনতে থাকি। বছরের অন্যান্য দিন অন্যান্য গান শুনলেও এসময় শুধু এই একটা গানই শুনি। এটা দেখে আমাদের মেয়েটা আমাকে একবার প্রশ্ন করেছিল, কেন আমি শুধুই এই গানটা শুনি। আমি বলেছিলাম আমারও স্বপ্ন ছিল বাড়ি যাওয়ার কিন্তু যেতে পারছি না তাই এই গানটা শুনে সেই ক্ষতটা ঢাকার চেষ্টা করছি।