ছবি যেন শুধু ছবি নয়
আমি এখানে দুটি ভিন্ন ধরনের ছবি দিয়েছি। প্রথম ছবিটি একটি ছোট্ট শিশুর, যার বয়স চার থেকে ছয় বছরের বেশি নয়। যে কিনা দুয়ারে দুয়ারে, রাস্তার আশপাশে, বাসে, রিকশার পাশে বা ফুটপাতে ফুল বিক্রি করছে। এই সাধারণ একটি ছবির মধ্যেই যেন একটি উপন্যাস দেখতে পাচ্ছি। দেশের পুরো চিত্র ফুটে ওঠেছে এই একটা ছবির মধ্যে।
প্রথমে আলোচনা করি ছবির মধ্যে থাকা অন্য ব্যক্তিদের কথা। শিশুটি মূলত ট্রাফিক জ্যামের সময় তার ফুল বিক্রি করে। আমরা যাঁরা মধ্যবিত্ত, তাঁরা তাঁদের মতো করে ৫ টাকার ফুল ১০ বা ২০ টাকায় কিনে নিই। আবার ফুল কিনে তাকেই উপহার হিসেবে ফেরত দিই। আবার অনেকের নিজেরই সাহায্য প্রয়োজন, তাঁরা চুপচাপ দেখি। অনেকে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিই। যাঁরা ধনীর শ্রেণিতে পড়েন, তাঁরা হয়তো ১০০ টাকায় ফুল কিনে নেন। আর যাঁরা একবারেই উচ্চ শ্রেণির, তাঁরা অনায়াসে এ রকম ১০০ শিশুর দায়িত্ব নিতে পারেন। আবার যাঁরা হয়তো এতই উঁচুতে থাকেন যে নিচের দিকে দেখেনই না, গাড়ির জানালার কাচ নিচে নামানও না। তবে সবাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখলে হয়তো এ রকম শিশুদের রাস্তায় দেখাই যেত না। আমরা সবাই যদি চেষ্টা করি, তবে শুধু আর্থিক নয়, আরও অন্য অনেক পদক্ষেপ নিতে পারি।
এবার আসি শিশুটির জীবন নিয়ে আলোচনায়।
শিশুটি একদিন বড় হবে। সেও নিজে ফুলের মতো করে ফুটে উঠবে। কোনো এক সময় তাকেও কেউ না কেউ কিনতে চাইবে বা কিনবে। শিশুর হাতের ফুল যেমন কোনো এক সময় তার সুগন্ধ ও শোভা থেকে সরে যায়, ঠিক তেমন করে এই শিশু মেয়েটির যৌবনের ভাটা পড়বে, সেও ঝরে পড়বে। তবে কিছুটা পার্থক্য থাকবে, ফুল যতক্ষণ তার বাহার দেবে, ততক্ষণ তাকে সবাই ভালোবাসবে। ফুলদানিতে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবে। পরে ছুড়ে ফেলবে নর্দমায়। আর শিশুটি যখন বড় হবে, তাকে সমাজ নানাভাবে ব্যবহার করবে, সঙ্গে থাকবে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও ঘৃণা, যা তাকে লতাপাতার মতো জড়িয়ে ধরবে। তারও যৌবন একদিন শেষ হয়ে যাবে, তবে বাকি জীবন নির্যাতিত, নিপতিত হয়ে সমাজের অন্ধকারে ধুঁকে ধুঁকে মরবে, যদি শিশুটিকে এখন থেকেই যত্ন করে গড়তে মা–বাবা বা সমাজ ব্যর্থ হয়। এটা একটা দিক। আরেকটি দিক মা–বাবা ছোট্ট শিশুটিকে কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জন করার একটি অসাধু পথ তৈরি করেছেন।
এত অল্প বয়সী একটি শিশুর চরম আর্তনাদ অনেক যাত্রীর মনে বা বিবেকে যন্ত্রণার ঢেউ ফেলে অর্থ রোজগার করছে। হয়তো মা–বাবা বলবেন, পেটের দায়ে। তবু এটা অন্যায়। এর প্রতিবাদ করা দরকার।
ধুরন্ধর হওয়াকেও কিন্তু একধরনের স্মার্ট বলা যেতে পারে। যেমন মা–বাবা সন্তানকে কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন। একটি শিশু, যার এ সময় স্কুলে থাকার কথা, সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলা করার কথা, অথচ সংসারের দায়ভার নিয়ে জীবনের কঠিন সময়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। শিশুটি কি জানে, তার পরিণাম কী হবে! শিশু জানে না। যার ফলে মা–বাবাকেই আমরা শ্রেষ্ঠ অভিভাবক বলে বিশ্বাস করি, কিন্তু সেই বিশ্বস্ততা কি মা–বাবা ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে?
অন্যদিকে দেখুন পরের ছবিটা। এই ছবিও অনেক কথা বলছে তার মতো করে। প্রেমিক তার প্রমিকাকে সেদিন হয়তো বলেছিল মনের অজান্তে, ‘একটা ছবি এঁকো আমার জন্য।’ সেই ছবি যেন গোটা বিশ্বকে উজাড় করে নেয়, সেই ছবি যেন সবাইকে ব্যাকুল করে দেয় এবং আমি যেন হই তোমার মাঝে ধন্য। কে জানত, সেদিন ফ্রান্সের ল্যুভ মিউজিয়ামে প্রতিদিন হাজারো মানুষ শুধু মোনালিসার রহস্যময় হাসি দেখতে আসবে! সামান্য একটা ছবি গোটা বিশ্বকে উজাড় করে নেবে? কারও জীবনের ভালোবাসাকে ঘিরে কেউ হয়তো কখনো একটা ছবি এঁকেছে, যা আজও হাজারও মানুষকে ব্যাকুল করে দেয়! যাহোক, আমি দুটি ছবিকে তুলে ধরেছি। আমার ভাবনা থেকে কিছু কথা লিখেছি। জানি না কারও হৃদয় স্পর্শ করবে কি না!
লেখাটির শেষ এখানেই হতে পারত, কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে, শুধু বিরহ দিয়ে শেষ করলে ঠিক হবে না। আমরা তো মানুষ। মানবতা, প্রেম, বিরহ—এর সবকিছু নিয়েই তো জীবন। তাই একজন অতি কাছের মানুষের জীবন থেকে নেওয়া একটি প্রেমের কাহিনি দিয়ে লেখাটি শেষ করি।
‘ভালোবেসে সখী, নিভৃতে যতনে/ আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে...’ ৮০ বছর বয়সেও প্রতিদিনের মতো আজ সকালে সাইমন তার স্ত্রী গুনিলার জন্য এক কাপ কফি বিছানার পাশে এনে আস্তে আস্তে ডাকছে, ‘গুনিলা, তোমার জন্য কফি এনেছি।’ গুনিলা এই প্রথম সাইমনের নিজ হাতে তৈরি কফি মুখে দিতে পারেনি। গুনিলা কখন হঠাৎ ঘুমিয়ে গেছে শান্ত হয়ে সাইমন তা বুঝতে পারেনি।
সাইমন সর্বহারা। কারণ, তাদের ৬২ বছরের ভালোবাসার সংসারে হয়নি কোনো নতুন অতিথির আগমন। বহু বছর আগে গুনিলার সঙ্গে সাইমনের দেখা হয়েছিল সুইডেনের ছোট্ট একটি লেকের ধারে। চিত্রশিল্পী সাইমন লেকের ধারে বসে গুনিলার পুরো দেহটার চিত্রাঙ্কন করেছিল একটি পাথরের ওপর। গোসল শেষে উঠতে পথে গুনিলার নজর কেড়ে নিয়েছিল এই সুদর্শন চিত্রশিল্পী সাইমন।
গুনিলা একজন স্কুলশিক্ষক। সে সাইমনের আঁকা নিজের ছবিটি দেখে মুগ্ধ হয় এবং সাইমনের হাত ধরে সেই যে তার প্রেমে বন্দি হয়েছে, আর কোনো দিন মুক্তি পায়নি। তবে তাদের বিয়ের পর একবার সংসারে ঝড় উঠেছিল বিচ্ছেদের। গুনিলা সাইমনের জীবন থেকে সরেও গিয়েছিল। ওই যে কথায় বলে, ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন!
ঠিক তেমনটি ঘটেছিল তাদের জীবনে। গুনিলা স্কুলশিক্ষক, ক্লাসে একটি ছেলে প্রতিদিনই দেরি করে আসে, বেশ অমনোযোগী। মাঝেমধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ে বেঞ্চের ওপর। ক্লাসের কেউই ছেলেটিকে পছন্দ করে না বললেই চলে। গুনিলা সিদ্ধান্ত নেয়, ছেলেটির মা–বাবার সঙ্গে দেখা করার। সে একজন শিক্ষক হিসেবে মনে করে এটা তার নৈতিক দায়িত্ব।
যে কথা সেই কাজ। ক্লাস শেষে ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে তার বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। যেতে যেতে পথে অনেক পারিবারিক বিষয়ে আলোচনা হয় দুজনের মধ্যে। ও, ছেলেটির নাম ডানিয়েল, বয়স আট বছর। মা মারা গেছে জন্মের পর। বাবা নতুন করে বিয়ে করেছে। সংসারে ডানিয়েল একটি বোঝা, কিন্তু দায়ভার এড়ানোর উপায় না থাকার কারণে ডানিয়েলকে তারা যতটুকু না করলেই নয়, তার বেশি কিছু করে না।
ফলে ডানিয়েল অঙ্কুরে বিনাশ হতে চলেছে। গুনিলা ডানিয়েলের মা–বাবার সঙ্গে দেখা করে, ডানিয়েলের বিষয় আলোচনা করে, কিন্তু তেমন আশাপূর্ণ ফল না পেয়ে ফিরে আসে বাড়ি। বাড়িতে এসে সাইমনের সঙ্গে ডানিয়েলের বিষয়টি আলোচনা করে। আলোচনা শেষে তারা ডানিয়েলের দায়ভার নেওয়ার এবং নিজেদের সন্তানের মতো লালন–পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা নিঃসন্তান বলেই সহজে এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এদিকে টমাস এই প্রথম ষাঁড়ের ঘাড়ে দুই মিনিট বসে ষাঁড়কে ক্লান্ত করে তখনকার সময় সর্বকালের সেরা রেকর্ড করেছে, যা জেসিকার নজর কেড়েছে নিউইয়র্কের একটি সংবাদপত্রের মাধ্যমে। টমাসের এমন একটি আনন্দঘন মুহূর্তে সে মিস করছে জেসিকাকে। টমাস হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ষাঁড়যুদ্ধ খেলা ছেড়ে দেবে। টমাস সাইমনের চিত্রাঙ্কনের গ্যালারিতে নতুন চাকরি নিয়েছে। চলছে জীবন নিজ নিজ গতিতে। কিছুদিন যেতে সাইমনের উকিল নোটিশ দিয়েছে সাইমনের সব সম্পত্তি নিলামে বিক্রি হবে, মৃত্যুর আগে সাইমনের লিখে রেখে যাওয়া উইলের ভিত্তিতে।
কী লেখা আছে এই গোপনীয় উইলে, সাইমনের উকিল ছাড়া অন্য কেউ তা জানে না। বহু লোক এসেছে আর্ট গ্যালারিতে। নিলামে নামীদামি চিত্রগুলো বিক্রি হবে চড়া দামাদামির মাধ্যমে—এমনটি আশা নিয়ে সবাই সেদিন বসে আছে। উকিল এসে প্রথমে সাইমনের যে ছবিটি বিক্রি করার জন্য প্রস্তাব দিল, সেটা ছিল সাইমনের আঁকা সেই লেকের ধারে বসে গুনিলার পুরো দেহটার চিত্রাঙ্কন, যার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র এক হাজার ডলার। প্রসঙ্গত জেসিকা আর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্বাভাবিকভাবে সেও সেদিন এসেছে সাইমনের আর্ট গ্যালারিতে, তবে সে জানে না, সেখানে টমাস কাজ করে।
দামাদামি হচ্ছে না, কেউই আগ্রহ দেখাচ্ছে না গুনিলার ছবিটির জন্য। শেষে দাম কমতে শুরু করে। কোনো একপর্যায়ে মাত্র পাঁচ শ ডলার ধার্য করা হয়, তারপরও কেউ গুনিলার ছবিটি কিনতে রাজি হচ্ছে না। জেসিকা জানে, কী চমৎকার হৃদ্যতা ও স্মৃতি জড়িত এই পাথরে আঁকা ছবিটির মধ্যে। হঠাৎ পেছন থেকে একটি সুদর্শন যুবক হাত তুলেছে নিলামে পাঁচ শ ডলারের বিনিময়ে গুনিলার ছবিটি কেনার জন্য।
সবার নজর পেছনে, জেসিকা পেছনে মুখ ঘোরাতেই বিস্ময়ে হতবাক, আরে, এত সেই টমাস, যাকে সে একদিন ভালোবেসেছিল! হঠাৎ দেখে চমকে মুগ্ধ হয়ে থমকে যায় জেসিকা, টমাস কেন এখানে এবং কেনই–বা গুনিলার ছবিটি কিনল, যেখানে অন্য কেউ কোনো আগ্রহ দেখাল না!
যা–ই হোক গুনিলার অঙ্কিত চিত্র টমাসের কাছে বিক্রি হয়ে গেল। পরবর্তী চিত্রাঙ্কনগুলো নিলামে দামাদামির অপেক্ষায় সবাই, এমন সময় উকিল ১৫ মিনিট বিরতির ঘোষণা দিলেন। সবাই বসে আছে আর অপেক্ষা করছে পরবর্তী স্টেপের আশায়। এই ফাঁকে জেসিকা টমাসের সামনে এসে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। টমাস জেসিকাকে দেখছে স্মৃতির জানালা খুলে।
কেমন আছো, জিজ্ঞেস করল জেসিকা।
আমি ভালো আছি, তুমি?
হ্যাঁ, আছি।
তুমি এখানে? তুমি তো কখনো চিত্রাঙ্কন পছন্দ করতে না। তা হুট করে গুনিলার ছবি কেন তুমি কিনলে?
তোমার কথা মনে করে।
আমার কথা মনে করে, মানে?
একদিন তুমি বলেছিল, সাইমনের জীবনের ভালোবাসার কথা এবং গুনিলার সঙ্গে তার প্রথম দেখার স্মৃতি। তোমার সে কথা মনে আছে?
হ্যাঁ। তা কীভাবে জানলে যে আজ সাইমনের সবকিছু নিলামে বিক্রি হবে?
আমি এখানে কাজ করি।
এ কথা শুনে জেসিকা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, মানে?
তোমার ষাঁড়যুদ্ধ?
সেটা ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগেই।
ওহ!
হঠাৎ বিরতির সময় শেষ হয়ে গেল। সবাই যার যার জায়গায় গিয়ে বসতেই উকিল সাইমনের লেখা উইলটি পড়তে শুরু করল, ‘যে গুনিলার চিত্রাঙ্কন কিনবে, সেই আমার সব আর্ট গ্যালারির দায়ভার এবং মালিকানা লাভ করবে।’ উকিলের উইলনামা পড়া শেষ হতেই সবাই হতভাগ! বলে কী? কীভাবে এটা সম্ভব?
নানাজনের নানা প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর নেই কোথাও। তাহলে কি টমাস সব জানত? সে জানবে কী করে। সে আর্ট গ্যালারিতে চাকরি নিয়েছে সাইমনের মৃত্যুর পর। জেসিকা নিঃশব্দে নীরবে তাকিয়ে আছে টমাসের দিকে। টমাস জেসিকাকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলল, ‘তোমাকে ঘিরে ভালোবাসার জাল বুনেছিলাম। কিন্তু তোমাকে হারিয়ে শুধু অনুভবে স্মৃতিটুকু নিয়ে তোমার পছন্দের জায়গা সাইমনের আর্ট গ্যালারিতে চাকরি নিয়েছি। কারণ একটিই, হয়তো কোনো একদিন তুমি এখানে আসবে।’
সাইমনের জীবনের ভালোবাসা ছিল তার গুনিলাকে ঘিরে আর টমাসের জীবনের ভালোবাসা হলো জেসিকার জন্য গুনিলার চিত্রাঙ্কন কিনে।
*লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]