মাল্টার মাধুর্য
ইউরোপের ছোট একটা দেশ মাল্টা। এটি ইতালির পালেরমো, তিউনিসিয়া আর লিবিয়াবেষ্টিত ভূমধ্যসাগরের ছোট একটা দ্বীপরাষ্ট্র। ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ সালে যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে মাল্টা।
দেশ ভ্রমণের নেশা থেকে এই দেশ দেখার ইচ্ছা জাগল। পরিকল্পনা করে অফিস থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে ঘুরতে বের হই। সকালের ভ্রমণে সাধারণত আগের রাতের ঘুম মাটি হয়। তাই এবার রাতে ভ্রমণ করার পরিকল্পনা করলাম। প্লেনে ভ্রমণের সময় আয়ারল্যান্ড থেকে তিন ঘণ্টার চেয়ে কিছুটা বেশি। আবার সেই বিরক্তিকর প্লেন ভ্রমণ। তবে এবারের সাথি আমার বইয়ের পাণ্ডুলিপি। মানে যাত্রাপথে প্রুফ রিডিং। মাঝরাতে পৌঁছলাম মাল্টার লুকা বিমানবন্দরে। ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে পৌঁছতে আরও আধা ঘণ্টা লাগল। এখানকার ট্যাক্সি ভাড়া করার সিস্টেম হলো বিমানবন্দরের বুথ থেকে এবং বিভিন্ন দূরত্বের জন্য নির্ধারিত ভাড়া। পেমেন্টও এখানে করতে হয়, তাই ভাড়া নিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে কোনো ঝামেলা নেই। সুন্দর সিস্টেম।
পরদিন সকালে উঠে দেখলাম রোদ, যা সাধারণত আয়ারল্যান্ডে শীতকালে দেখা যায় না। আয়ারল্যান্ডের আবহাওয়া থাকে মেঘলা, ঠান্ডা ও বৃষ্টি। আর ওই দিকে মাল্টায় আবহাওয়া রৌদ্রোজ্জ্বল ও কিছুটা গরম। মাল্টার একপাশে আফ্রিকা ও আরেক পাশে মধ্যপ্রাচ্য থাকার কারণে গরম বাতাস এই পাশ থেকে মাল্টার দিকে যায়, যার ফলে এখানকার আবহাওয়া মেইনল্যান্ড ইউরোপের মতো নয়। তাপমাত্রা ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রির আশপাশে থাকে নভেম্বর–ডিসেম্বরেও।
প্রথম দিনে গেলাম পপআই (PopEye the Sailor Man) ভিলেজ দেখতে। বাস থেকে নেমে প্রায় ২০ মিনিটের হাঁটাপথ। পপআই ভিলেজ মূলত একটি ফিল্মসেট, যা বর্তমানে টুরিস্ট অ্যাট্রাকশন। এই ফিল্ম সেটের নির্মাণকাজ শুরু হয় জুন ১৯৭৯ সালে। এতে আছে ১৯টি কাঠের দালান। এটি নির্মাণে ৮ টন পেরেক এবং ৭ হাজার ৬০০ লিটার রং ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া চিত্র গ্রহণের সময় উঁচু সমুদ্র থেকে রক্ষা করার জন্য এর চারপাশে একটি ৬০ থেকে ৭৫ মিটার ব্রেকওয়াটার তৈরি করা হয়েছিল। মূলত, এটি শেষ করতে সাত মাস লেগেছিল এবং চিত্র গ্রহণ শুরু হয়েছিল ২৩ জানুয়ারি ১৯৮০ সালে।
পপআই ভিলেজে যেতে চোখে পড়বে রাস্তার দুই পাশে থরে থরে ক্যাকটাসগাছ। ইউটিউবে একবার একজনকে ক্যাকটাসের ফল খেতে দেখছিলাম। তাই আমিও খাওয়ার জন্য তিনটা ফল নিলাম রাস্তার পাশ থেকে। খালি হাতে পাড়তে গিয়ে হাতে কাঁটা ফুটল অসংখ্য। হোটেলে এসে ক্যাকটাস ফল খেলাম। এর স্বাদ ড্রাগন ফলের মতো।
দ্বিতীয় দিন গেলাম রাজধানীর ছোট একটা শহর মদিনায়। এখানে আছে মধ্যযুগীয় বৈশিষ্ট্য—বিশাল জায়গাজুড়ে প্রাসাদ, আছে গির্জা। এর অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের জন্য এখানেই গেম অব থ্রোনসের শুটিং করা হয়েছিল কয়েকটা এপিসোডের। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে বাসে চেপে ছুটলাম রাজধানী ভাল্লেত্তার দিকে। এখানকার শপিং ডিস্ট্রিক্ট অনেক বিশাল। প্রায় সব বড় বড় ব্র্যান্ডের দোকান আছে এখানে। প্রচুর পর্যটক এখানে। এরপরে বাসে চেপে গেলাম আরেক শহর স্লিয়েমাতে। এটাও শপিং ডিস্ট্রিক্ট। কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে আবার বাসে চেপে হোটেলে ফিরলাম।
তৃতীয় দিন একটা দ্বীপে, যার নাম গোজো। ফেরিতে করে যেতে প্রায় আধা ঘণ্টা। সেই দ্বীপে গিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে পথ হারিয়ে ফেললাম। আমাদের সঙ্গে ক্যাশ ইউরো নেই, ভুল করে সব হোটেল রুমে রেখে এসেছি। কিন্তু এখানকার যানবাহনে সবাই ক্যাশ ব্যবহার করে। ভালো ঝামেলায় পড়লাম। এক ব্রিটিশ নারীর সঙ্গে দেখা হলো সেখানে। তাকে বললাম, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। সে এই দ্বীপে বাড়ি কিনেছে ১৫ বছরের বেশি হলো। সে আমাদের তার গাড়িতে অনেক পথ ঘুরিয়ে এই দ্বীপের সেন্টারে নামিয়ে দিল, যেখানে আছে এটিএম মেশিন, দোকানপাট, বাজার, যানবাহনসহ অনেক কিছু। কৃতজ্ঞ তার প্রতি। না হলে, আমাদের এই দ্বীপ ঘুরে দেখা হতো না। এই দ্বীপে আরও আছে হাসপাতাল, পাসপোর্ট অফিস ও গির্জা। এদিক–সেদিক একটু ঘোরাঘুরি করে এটিএম থেকে ক্যাশ ইউরো নিলাম বাস ভাড়া দেওয়ার জন্য। বাসে ফেরিঘাটে যেতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট লাগে। যথাসময়ে ফেরিতে চাপলাম। এবার নিয়ে গেল আরেক দ্বীপে, যার নাম কমিনো। ১০ মিনিটের পথ। এই দ্বীপে মূলত যারা পার্টি পছন্দ করে, তারাই বেশি আসে। কেউবা আবার সমুদ্রে নেমে গোসল করে। এবার ফেরার পালা। ঘণ্টা দুয়েক পরে আবার ফেরিতে চেপে বসলাম। শেষ বিকেলের আলোয় সমুদ্রের উথালপাতাল ঢেউয়ের সঙ্গে দুলতে দুলতে ফিরলাম। আমার স্ত্রীর খুব শখ ছিল জাহাজে করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার। কিন্তু এই আধা ঘণ্টার জার্নিতে তার শখ মিটে গেছে।
পরদিন ফেরার পালা। দুপুরের পরেই ফ্লাইট। চেক-ইন করে ইমিগ্রেশন পার হতে যাব, ঠিক অমনি পাসপোর্ট স্ক্যান করার পরে আমাদের দুজনকে পাসপোর্টসহ ইন্টারোগেশন রুমে নিল। স্ত্রীর বাংলাদেশি পাসপোর্ট হওয়ায়, আমি ভাবলাম তাকে জেরা করবে। কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টা। তারা আমার ইউরোপীয়ান পাসপোর্ট নিয়ে একজন খালি হাতে প্রতিটি পৃষ্ঠা, প্রতিটি পাতার কোণা, সেলাই, সিকিউরিটি, চিপ সব দেখল। না! সন্তুষ্ট হতে পারল না। এবার একটা বিশেষ ধরনের গ্লাস নিয়ে আবার দেখতে লাগল। কী দেখল, কে জানে। কোথায় থাকি—এটা জিজ্ঞাসা করে ছেড়ে দিল। আরেকটু হলেই বোর্ডিং গেট বন্ধ হয়ে যেত আর নিশ্চিত ফ্লাইট মিস। গত ১৫ বছরে এটাই আমার সবচেয়ে তিক্ত ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।
প্লেনে চেপে বসলাম। আমার হাতে আবার পাণ্ডুলিপি। পাশের সিটে ছিলেন নর্দান আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে অবস্থিত আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। উনি একজন পিএইচডি ছাত্রের গবেষণাপত্র দেখছেন। টুকিটাকি কথা হলো। পাণ্ডুলিপি দেখা আর কথার মধ্যেই ক্যাপ্টেন আইরিশ এয়ারস্পেসে প্লেনের অবস্থান জানান দিলেন। প্লেন আস্তে আস্তে সেই অন্ধকার ঠান্ডা আয়ারল্যান্ডে ডাবলিন বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করল।
ভ্রমণে যেটা লক্ষণীয় ছিল—এই দেশ খুবই পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন, সময়মতো বাস পাওয়া যায়। যেকোনো শহরেই বাসে যাওয়া যায় আর ভাড়া মাত্র দুই ইউরো। জিনিসপত্রের দাম মেইনল্যান্ড ইউরোপের চেয়ে অনেক কম। খাবার অনেক সস্তা। এখানকার আবহাওয়া মেইনল্যান্ড ইউরোপের চেয়ে অনেক ভালো। সব সময় সূর্যের আলো পাওয়া যায়। আর দেখলাম অনেক ব্রিটিশ পর্যটক।