পূজার স্মৃতি
দুর্গাপূজা এলে পূজা নিয়ে কৈশোর ও তারুণ্যের মধুর সব স্মৃতি মনে পড়তে থাকে। আশির দশকে আমরা বড় হয়েছি একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে। আমাদের শিক্ষক ও সতীর্থদের অনেকেই হিন্দু ছিলেন। প্রতিবেশীও হিন্দু ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আমাদের মুসলমান ছেলেদের মধুর সম্পর্ক ছিল। সত্যি বলতে কী, আমরা কখনো এভাবে চিন্তাই করতাম না যে ওরা হিন্দু আর আমরা মুসলমান। আমাদের সম্পর্কটা ছিল সামাজিক। গভীর সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির। অন্য আট–দশজন মুসলমানের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক ছিল, হিন্দুধর্মের শিক্ষক ও সতীর্থদের সঙ্গেও আমাদের মুসলমান ছেলেদের সে রকম সম্পর্ক ছিল। দারুণ বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতাপূর্ণ। একে অপরের বাড়িতে আসা–যাওয়া ছিল। আর তা বেশি হতো দুর্গাপূজা এলে। কারণ, এ পূজাটি বাংলাদেশে হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব।
এখন এই চর্চা আছে কিনা জানি না। আমাদের সময়ে দুর্গাপূজা এলে আমরা হিন্দু শিক্ষক, সতীর্থ ও বন্ধুদের বাসায় নিমন্ত্রণ পেতাম। মাইজদীতে আমাদের স্কুলের নাম ছিল কল্যাণ হাই স্কুল। হেড স্যার থেকে শুরু করে অধিকাংশ শিক্ষক ছিলেন হিন্দুধর্মাবলম্বী। হেড স্যার বিমলেন্দু মজুমদার ছিলেন শহরের খুব নামকরা শিক্ষাবিদ। আমাদের সহকারী হেড স্যারও ছিলেন হিন্দু। লোকেন্দ্র স্যার। তা ছাড়া ইংরেজির পরিমল স্যার, অঙ্কের বিশ্বজিৎ স্যার ও ভক্তি স্যার, বাংলার যোগেশ স্যার, বুককিপিংয়ের অমূল্য স্যার—তাঁরা সবাই ছিলেন হিন্দুধর্মাবলম্বী। বলতে গেলে আমি মানুষ হয়েছি হিন্দু স্যারদের সাহচর্যেই। তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কিছু কিছু ঋণ জীবনেও শোধ করা যায় না। যেমন শিক্ষকদের ঋণ।
পূজা এলে এসব শিক্ষকের বাসায় আমাদের নিমন্ত্রণ থাকত। স্যাররা বলতেন, ‘তোরা বাসায় আসিস।’ আমরা সতীর্থরা দল বেঁধে যেতাম। মজার মজার সন্দেশ খেতাম। নারকেলের নাড়ু খেতাম। বিমল স্যারের স্ত্রী, লোকেন্দ্র স্যারের স্ত্রী ও অমূল্য স্যারের স্ত্রী আমাকে খুব স্নেহ করতেন। মাসি বলে ডাকতাম। প্রাইভেট পড়ার সুবাদে তাঁদের বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। ফলে সম্পর্কটা আর ছাত্র-শিক্ষক থাকেনি। পরিবারের সদস্য হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁদের স্নেহধন্য হওয়ার।
আমাদের স্কুলের পাশেই ছিল পূজামণ্ডপ। নাম দেবালয়। পূজা শুরু হওয়ার আগে যখন প্রতিমা বানানো শুরু হতো, তখন আমরা টিফিনের ফাঁকে দেবালয়ে প্রতিমা দেখতে যেতাম। মাটি কেটে কেটে কারিগরেরা মানুষ, পশু, পাখি তৈরি করছেন—কী যে নৈপুণ্য ছিল সে কাজে, আহা! আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁদের নির্মাণশৈলী দেখতাম। দেবী দুর্গা—কী চোখ, কী নাক, কী তার অঙ্গসৌষ্ঠব—চোখ সরানো দায় ছিল। দেবী দুর্গার চোখ দুটি থাকত বিস্ফারিত। হাতে অস্ত্র। তিনি অশুভ শক্তিকে বিনাশ করে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা করেন বলেই বিশ্বাস করা হয়।
তবে দেবী দুর্গা মানুষের মতো হলেও একটু ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁর হাত ২টি নয়, ১০টি। ১০ হাতে ১০টি অস্ত্র থাকত। আর চোখ তিনটি। তৃতীয় চোখটি কপালে। তিনটি চোখেরও ব্যাখ্যা আছে। এখন আর মনে নেই। অনেক আগে শোনা কাহিনি। পুরোপুরি কিছুই মনে করতে পারছি না। তবে যত দূর মনে আছে—মহিষাসুরকে বধ করতে পুরুষ দেবতারা অক্ষম ছিলেন বলেই সব দেবতার শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করা হয় দেবী দুর্গাকে। দুর্গার ১০ হাতে যে ১০টি অস্ত্র, এগুলোর আলাদা আলাদা নাম আছে। নামগুলো আজ আর মনে করতে পারছি না। তবে তীর–ধনুক ও তলোয়ার ছিল, যা দিয়ে দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার দৃশ্য প্রতিমায় ফুটিয়ে তোলা হতো। এই যে অশুভকে বধ করার বার্তা—এ বার্তাটি সেই কৈশোরে আমাকে অভিভূত করেছিল সবচেয়ে বেশি।
আমাদের ক্লাসমেটদের মধ্যে যারা হিন্দু ছিল, পূজায় ওদের বাড়িতেও আমার নিমন্ত্রণ থাকত। আমি বলছি ৩৬ বছর আগের কথা। এখনো ওদের অনেকের নাম মনে আছে। সাথী, রিক্তা, মাধব, কমল, রানা, জুয়েল, আরো অনেক ক্লাসমেট, যাদের বাড়ি ছিল স্কুলের আশপাশেই। আমরা পূজার ছুটিতে দেবালয়ে পূজা দেখে সন্ধ্যায় দল বেঁধে ওদের বাড়িতে যেতাম। মজার মজার প্রসাদ খেতাম। গুড় দিয়ে তৈরি নারকেলের নাড়ুটা আমার ভীষণ পছন্দ ছিল। মাসিরা খুব যত্ন করে খাওয়াতেন। প্রায় সব বাড়িতেই ব্যবহার করা হতো তামা, কাঁসা ও পিতলের তৈজসপত্র। একেবারে ঝকঝকে তকতকে। পূজা উপলক্ষে বাড়ি ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে রাখতেন তাঁরা। সন্ধ্যায় ধূপ জ্বালাতেন। ধূপের ঘ্রাণে পুরো বাড়িতে এক অদ্ভুত মোহনীয় পরিবেশ তৈরি হতো। প্রায় প্রতিটি ঘরের কোণে তুলসীগাছ থাকত। তুলসীগাছ দেখলে আমি পাতা না ছিঁড়ে থাকতে পারতাম না। কারণ, তুলসীপাতার ঘ্রাণ দারুণ মনোহর ছিল। নাকের কাছে নিলেই এক অন্য রকম আবেশে মন ভরে যেত। তুলসী শব্দটিও আমার পছন্দ।
হিন্দু নারীরা পূজা উপলক্ষে বিশেষ সাজে সাজতেন। সে সাজ ছিল অপূর্ব। দেখলেই নয়ন জুড়িয়ে যেত। বিশেষ করে বাহারি শাড়ির সঙ্গে লাল টিপ—অসাধারণ! ছেলেরা পরত ধুতি-পাঞ্জাবি। একেকজনকে কী যে সুদর্শন লাগত। ওরা এই ধুতি পরেই পূজামণ্ডপে নৃত্যে অংশ নিত। কী দুর্দান্ত ছিল সেসব নৃত্য, আহা! নৃত্যের ঝংকার এখনো যেন কানে বাজে। আমার মনের পেছনে অনিন্দ্যসুন্দর দুর্গাপ্রতিমা, সন্ধ্যায় আলো-আঁধারিতে ধূপের ঘ্রাণে বিভোর হিন্দুবাড়ি, তুলসীপাতার ঘ্রাণ, পূজামণ্ডপের আরতি, কীর্তন, শঙ্খধ্বনি, রমণীদের একযোগে উলুধ্বনি, শাড়ি ও সিঁদুরে হিন্দু রমণীদের শৈল্পিক সাজ, ধুতি পরিহিত যুবকদের উন্মাতাল নৃত্য আর তুমুল ঢাকঢোলের ঝংকার প্রচ্ছন্ন ভূমিকা রেখেছে বলেই মাঝে মাঝে মনে হয়। এসবের মধ্যে এক দারুণ শিল্পময়তা আছে। নান্দনিকতা আছে। আমি সেই কৈশোর থেকে সেই শিল্পময়তায়, সেই নান্দনিকতায় অভিভূত ছিলাম। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, এখনো দুর্গাপূজা এলে, পূজামণ্ডপে গেলে, দুর্গোৎসবের ছবি দেখলে সেসব মধুর স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। যেন আমি আমার কৈশোরকে প্রত্যক্ষ করি দুর্গোৎসবের আনন্দে!