ময়ূরাক্ষী, অভিনব জীবনবোধের সন্ধান

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের এক ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্র হিমু। যার পুরো নাম হিমালয়। যাকে তার বাবা হিমালয় পর্বতের মতো করে বড় করে তুলতে চেয়েছিলেন। এভাবে বড় করতে গিয়ে হিমুর বাবা হিমুকে দিয়ে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। এরপর একসময় তিনি মারা যান। হিমু থাকতে শুরু করে তার মামাদের সঙ্গে। মামারা তিনজনই ভয়ংকর ধরনের খারাপ মানুষ।

এরপর একসময় হিমু শহরে চলে আসে। পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে সারা রাত জেগে শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে থাকে। এভাবেই সে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়। হিমু তার বাবার মতো নিজেকে নিয়ে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। ব্যক্তিগতভাবে তার ইনট্যুইশন ক্ষমতা খুবই প্রখর। এভাবেই হিমুর গল্প এগোতে থাকে। তখনকার সময়ে হিমু বাংলাদেশের কিশোর এবং তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি চরিত্র ছিল। একটা প্রজন্ম হিমুর অনুকরণে পড়াশোনা মাথায় তুলে হলুদ পাঞ্জাবি পরে সত্যি সত্যিই রাস্তায় ঘোরাও শুরু করে।

হিমুকে মহামানব বানানোর স্বপ্ন নিয়ে হিমুর বাবা তাঁর নিজের কিছু বাণী চামড়ায় বাঁধানো ৩২১ পৃষ্ঠার একটা খাতায় তিনি মুক্তার মতো গোটা গোটা হরফে লিখে গিয়েছিলেন। অবশ্য তিনি মাত্র ১৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখতে পেরেছিলেন। এরপরই তিনি মারা যান।

যেমন উপদেশ নম্বর ১১—সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান। এই অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, ‘সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান করিবে। ইহাতে আত্মার উন্নতি হইবে। সৃষ্টিকর্তাকে জানা এবং আত্মাকে জানা একই ব্যাপার। স্বামী বিবেকানন্দের একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে স্মরণ রাখিও—

বহুরূপে সম্মুখে তোমার,
ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?’
হিমুর বাবার একটা উপদেশের শিরোনাম হচ্ছে—নির্লিপ্ততা। তিনি লিখেছেন, ‘পৃথিবীর সকল মহাপুরুষ এবং মহাজ্ঞানীরা এই জগৎকে মায়া বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। আমি আমার ক্ষুদ্র চিন্তা ও ক্ষুদ্র বিবেচনায় দেখিয়াছি, আসলেই মায়া। স্বামী ও স্ত্রীর প্রেম যেমন মায়া বই কিছুই নয়, ভ্রাতা ও ভগ্নির স্নেহ-সম্পর্কও তাই। যে কারণে স্বার্থে আঘাত লাগিবামাত্র স্বামী-স্ত্রীর প্রেম বা ভ্রাতা-ভগ্নির ভালোবাসা কর্পূরের মতো উড়িয়া যায়। কাজেই তোমাকে পৃথিবীর সর্ব বিষয়ে নির্লিপ্ত হইতে হইবে।

কোনো কিছুর প্রতিই তুমি যেমন আগ্রহ বোধ করিবে না, আবার অনাগ্রহও বোধ করিবে না। মানুষ মায়ার দাস।’ এই মায়া কাটানোর জন্য যখনই হিমুর কোনো কিছুর প্রতি মায়া তৈরি হয়েছে, তার বাবা সেটাই ধ্বংস করে ফেলেছেন। শৈশবে একবার একটা খেলনা হিমুর খুব পছন্দ হলে সেটা হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলেন। একটা লাল ঠোঁটের সবুজ টিয়া পাখির গলা টিপে হত্যা করেন। এরপর হিমুকে বলেন, ‘মন খারাপ করবি না। মৃত্যু হচ্ছে এ জগতের আদি সত্য।

তিনি তাঁর পুত্রের মন থেকে মায়া কাটাতে চেষ্টা করছেন।’ এ ছাড়া হিমুকে তার বাবা পড়াশোনাও করিয়েছিলেন, অবশ্য সেটা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছিল না। তার বাবার কাছেই হিমু পড়েছিল ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক, ভূগোল আর নীতিশাস্ত্র। নীতিশাস্ত্র বলতে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় এসব। মিথ্যা বলা খারাপ, কিন্তু আনন্দের জন্য মিথ্যা বলায় অন্যায় নেই।

মিথ্যা দিয়েই সত্যকে চিনতে পারা যায়। যেমন গল্প, উপন্যাস এসব মিথ্যা, কিন্তু এসব মিথ্যা দিয়ে আমরা সত্যকে চিনতে পারি। ইংরেজি এবং বাংলার জ্ঞানও এত গভীর ছিল যে ছোট বয়সেই হিমু জানত অমাবস্যার ইংরেজি নিউমুন, মৃন্ময় শব্দের অর্থ মাটির তৈরি।

হিমুর নামকরণ বিষয়েও তার বাবার ছিল নিজস্ব মতামত। নদীর নামে, ফুলের নামে, গাছের নামে মানুষের নাম হতে পারলে হিমালয় কেন নাম হতে পারবে না। আর হিমালয় নামকরণের কারণ, যাতে ছেলের হৃদয় হিমালয়ের মতো বড় হয়। কিন্তু আকাশ রাখেননি, কারণ, আকাশ ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু হিমালয়কে স্পর্শ করা যায়। ১৬ বছর পর যদি হিমু মনে করে তার বাবার সিদ্ধান্ত ভুল, তখন সে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

এরপর মানুষের শতগুণ সম্পর্কে হিমুকে ধারণা দেওয়ার জন্য তার মৃত্যুর পর মামাদের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করে যান। কারণ, মামারা ছিল পিশাচ শ্রেণির। এরপর মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে তিনি বলেন, ‘শোন হিমু, কোনো রকম উচ্চাশা রাখবি না। টাকাপয়সা করতে হবে, বড় হতে হবে, এসব নিয়ে মোটেও ভাববি না। সব কষ্টের মূলে আছে উচ্চাশা।’

এভাবে বড় হতে হতে হিমুর মধ্যে একটা স্বকীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। তার ভাষায়, ‘আমি মহাপুরুষ নই। কিন্তু এই ভূমিকায় অভিনয় করতে আমার বড় ভালো লাগে।...আমার মতে, মহাপুরুষ হচ্ছে এমন একজন, যাকে পৃথিবীর কোনো মালিন্য স্পর্শ করেনি। এমন কেউ কি সত্যি সত্যি জন্মেছে এই পৃথিবীতে?...আমি ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলি। অসহায় মানুষদের দুঃখ-কষ্ট আমাকে মোটেই অভিভূত করে না।...কঠিন মানসিক যন্ত্রণায় কাউকে দগ্ধ করার আনন্দের কাছে সব আনন্দই ফিকে।...মহাপুরুষেরা আজীবন চিরকুমার থাকেন। বিয়ে করার পর যারা মহাপুরুষ হন, তাঁরা স্ত্রী-সংসার ছেড়ে চলে যান। যেমন বুদ্ধ দেব।’

হিমুর বাবা হাতে-কলমে হিমুকে মহাপুরুষের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। যেমন তার একটা উপদেশ এমন, ‘যখনই সময় পাবি, ছাদে এসে আকাশের তারার দিকে তাকাবি, এতে মন বড় হবে। মনটাকে বড় করতে হবে। ক্ষুদ্র শরীরে আকাশের মতো বিশাল মন ধারণ করতে হবে।...শুধু হৃদয় বড় হলেই চলবে না, তোকে বুদ্ধিমানও হতে হবে। তোর জ্ঞান এবং বুদ্ধি হবে প্রেরিত পুরুষদের মতো।’ হিমুকে নিয়ে তার বাবার মনে অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা ছিল। সেটা বোঝা যায় তার এই কথায়—‘তোর ওপর আমার অনেক আশা। অনেক আশা নিয়ে তোকে বড় করছি। তোর মা বেঁচে না থাকায় সুবিধা হয়েছে। ও বেঁচে থাকলে আদর দিয়ে তোকে নষ্ট করত।’

হিমু তার বাবার স্বপ্ন সফল করার জন্য সারা দিন পথে পথে ঘোরে। মহাপুরুষ হওয়ার সাধনা করে। যখন খুব ক্লান্ত অনুভব করে, তখন একটা নদীর স্বপ্ন দেখে। অনেকটা অবাস্তব মনে হলেও হিমুর জীবনে কাকতালীয় ঘটনার সমাবেশ অনেক বেশি। এ নদী আবিষ্কারের ঘটনাটাও কাকতালীয়। ক্লাস সিক্সে মফিজ স্যার তাদের জিওগ্রাফি পড়াতেন। একদিন ক্লাসে এসেই হিমুকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই একটা নদীর নাম বল তো। চট করে বল।’ তার উত্তরে হিমু বলেছিল - আড়িয়াল খাঁ। স্যার এগিয়ে এসে প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর পড়ানো শেষ করে স্যারের মন খারাপ হয় এবং তখন বলেন, আমি তোর কাছ থেকে সুন্দর একটা নদীর নাম শুনতে চেয়েছিলাম।’ এরপর হিমু হঠাৎ বলে বসে সেই নদীর নাম— ময়ূরাক্ষী।

এরপর মফিজ স্যার যেদিন মারা যান, সেদিন রাতেই প্রথম ময়ূরাক্ষী স্বপ্নে দেখে। হিমুর ভাষায়, ‘ছোট একটা নদী। তার পানি কাচের মতো স্বচ্ছ। নিচের বালুগুলো পর্যন্ত দেখা যায়। নদীর দুধারে দূর্বাঘাসগুলো কী সবুজ! কী কোমল! নদীর ওই পাড়ে বিশাল ছায়াময় একটা পাকুড়গাছ। সেই গাছে বিষণ্ন গলায় একটা ঘুঘু ডাকছে। সেই ডাকে একধরনের কান্না মিশে আছে।’ এরপর হিমু আরও বলেছে, ‘নদীর ধার ঘেঁষে পানি ছিটাতে ছিটাতে ডোরাকাটা সবুজ শাড়ি পরা একটা মেয়ে ছুটে যাচ্ছে। আমি শুধু তার মুখটা দেখতে পেলাম। স্বপ্নের মধ্যেই তাকে খুব চেনা, খুব আপন মনে হলো। যেন কত দীর্ঘ শতাব্দী এই মেয়েটার সঙ্গে কাটিয়েছি।’

এ নদীর প্রসঙ্গেই হিমুর মনে পড়ে তার মায়ের কথা। এ নদীর কোমল স্পর্শ যেন তাদের মায়ের আঁচলের শীতল পরশ। হিমুর ভাষায়, ‘আমার বাবার স্বপ্ন সফল করার জন্য সারা দিন আমি পথে পথে ঘুরি। মহাপুরুষ হওয়ার সাধনা করি। যখন খুব ক্লান্তি অনুভব করি, তখন একটি নদীর স্বপ্ন দেখি। যে নদীর জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে একজন তরুণী ছুটে চলে যায়। একবার শুধু থমকে দাঁড়িয়ে তাকায় আমার দিকে। তার চোখে গভীর মায়া ও গাঢ় বিষাদ। তরুণীটি আমার মা।

আমার বাবা যাকে হত্যা করেছিলেন।’ এমন সব পরিবেশে বেড়ে উঠতে উঠতে হিমু হয়ে যায় অন্য মানুষ। সেই মানুষকে আসলে কোনোভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। হিমুর ভাষায়, ‘আমাকে তো আর-দশটা সাধারণ ছেলের মতো হলে চলবে না। আমাকে হতে হবে অসাধারণ। আমি সারা দিন হাঁটি। আমার পথ শেষ হয় না।’

এ উপন্যাসের শেষ লাইনটা এককথায় আমাদের জীবনবোধের জায়গাটাতে নাড়া দেয়। মানুষের জীবন তো আসলে একটা অনির্দিষ্ট যাত্রা। কোথা থেকে শুরু আর কোথায়ই-বা শেষ হবে, এর উত্তর খুঁজে বেড়ানোর মধ্যেই জীবনের গূঢ় অর্থ বিদ্যমান। কিন্তু সবাই কি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়? হয়তোবা দু-একজন পায়, কিন্তু তারা তখন আর সাধারণ মানুষ থাকে না। হয়ে ওঠে অসাধারণ। হিমুর ভাষায়, ‘গন্তব্যহীন গন্তব্যে যে যাত্রা, তার কোনো শেষ থাকার তো কথাও নয়।’