সোনার হরিণ ও আলাদিনের দৈত্য

বেনজীর আহমেদ ও মতিউর রহমানফাইল ছবি

আমাদের পাড়ায় মাত্র দুজন সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। তাঁরা ছিলেন ভূমি অফিসের কেরানি। অবশ্য তাঁরা কেউই স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন না। তাঁরাও ছিলেন সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। আমাদের গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ছিলেন কৃষিজীবী অথবা দিনমজুর। এই চাচা-ভাতিজা হয়তোবা সে কারণেই আমাদের পাড়াকে বেছে নিয়েছিলেন স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য। এরপর দিন দিন তাঁদের সহায়সম্পত্তি বেড়ে গিয়ে আকাশচুম্বী হয়েছিল। আমরা জানতাম, তাঁরা যে বেতনের কর্মচারী, সেই বেতনে তাঁদের সংসারই চলার কথা নয়। কিন্তু তাঁদের সচ্ছলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। গ্রামের মানুষ তাঁদের সামনাসামনি সম্মান দেখালেও পেছনে কটু কথা বলতে ছাড়তেন না। সরকারি চাকরির সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার পর একেকজন সরকারি কর্মকর্তা রাতারাতি আলাদিনের দৈত্য বনে যান এবং পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের ইচ্ছা পূরণে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সরকারি চাকরিজীবীদের সঙ্গে আত্মীয়তায় গুরুত্ব দেন বেশি। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবী পাত্রের কদর শহর-গ্রামনির্বিশেষে অনেক বেশি। আমরা এখন একবিংশ শতাব্দীতে বসবাস করছি। কিন্তু এ অবস্থার খুব একটা হেরফের হয়নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কেউ সরকারি চাকরিজীবী হলেই সাধারণ মানুষের অনেক ধরনের চাহিদা তৈরি হয়—এলাকার মানুষকে চাকরি দেবেন, এলাকার মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানায় দানখয়রাত করবেন, অভাবী-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু মানুষ এটাও জানেন, উনি যে বেতন পান, তাতে তাঁর নিজেরই ভালো মতো চলতে পারার কথা নয়; তবু এগুলো আশা করে শুধুই বসে থাকেন না, অনেক সময় রীতিমতো তাগাদাও দেন। এ এক অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। সমাজবিজ্ঞানীরা নিশ্চয় এর পেছনের কারণ সম্বন্ধে ভালো বলতে পারবেন।

বাংলাদেশে সরকারি চাকরির সবচেয়ে উঁচু ধাপ হচ্ছে বিসিএস ক্যাডার। স্নাতক পাস যে কেউই বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা রাখেন। আর এটা আলাদা একটা পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় পাস করার জন্য অসীম পরিমাণ হাবিজাবি পড়াশোনা করতে হয়। হাবিজাবি বলছি, কারণ এ পড়াশোনা আদতে চাকরিজীবনে বা ব্যক্তিজীবনে কোনো কাজে আসে না। প্রাথমিক ধাপে সবাইকে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের একটা সাধারণ পরীক্ষা দিয়ে লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। লিখিত পরীক্ষায় প্রত্যেকের জন্যই সাধারণ কিছু বিষয় নির্ধারিত আছে। এ ছাড়া বিশেষায়িত ক্যাডারের জন্য সেই বিষয়ের বাড়তি আরও দুটি পরীক্ষা দিতে হয়। এ ধাপ পার হলে আছে মৌখিক পরীক্ষা নামের আরেক বিভীষিকা। এতগুলো ধাপ পার হলেই কেবল সরকারি চাকরি নামের সোনার হরিণের দেখা মেলে।

সরকারি চাকরি স্থায়ীকরণের তিনটি শর্ত আছে—ন্যূনতম দুই বছর চাকরি করতে হয়, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শেষ করতে হয় এবং বিভাগীয় পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে হয়। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে একেবারে হাতে-কলমে একেকজনকে রাতারাতি অসাধারণ মানুষ করে তোলা হয়। একজন সরকারি কর্মকর্তার চলাফেরা, কথাবার্তা, চালচলন, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে পোশাক-পরিচ্ছদ—সবকিছুই শেখানো হয়। এতে একজন কৃষকের ঘরে জন্ম নেওয়া এবং পান্তা খেয়ে দিন শুরু করা ছেলেও রাতারাতি কাঁটাচামচ ও ছুরি দিয়ে খাওয়া শিখে যান। এভাবেই তিনি নিজেকে দিন দিন অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবতে শুরু করেন। সাধারণ জনগণের প্রভু হয়ে ওঠার শিক্ষাটা এখান থেকেই আসে। আর বিভাগীয় পরীক্ষায় সরকারি সব ধরনের নিয়ম-নীতির পরীক্ষা নেওয়া হয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেই কেউ যদি এই নিয়মকানুনগুলো ঠিকঠাক পড়েন, তাহলে আর তাঁকে দিয়ে কোনো দুর্নীতি সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবে ঘটে এর উল্টোটা। সবাই আইন জেনে এর ফাঁকফোকর বের করে ফেলেন। যত বেশি আইন, তত বেশি ফাঁকফোকর।

সিভিল সার্ভিসে সাধারণ ও কারিগরি/পেশাগত-২ ক্যাটাগরিতে মোট ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। কিন্তু সবাই তিনটি ক্যাডারকে প্রাধান্য দেয়—প্রশাসন, পুলিশ  শুল্ক ও আবগারি। কারণ, এগুলোয় ক্ষমতাচর্চার সুযোগ অনেক বেশি। পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদাও বেশি। আর অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় অর্থযোগও বেশি। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মাঠ প্রশাসনে সহকারী কমিশনার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর একে একে পদোন্নতি পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হয়ে সিনিয়র সচিব হয়ে থাকেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একটি উপজেলার সর্বময় কর্তা। চাকরির শুরুতে পুলিশ ক্যাডারের পদের নাম সহকারী পুলিশ সুপার। এরপর ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত ডিআইজি, ডিআইজি, অতিরিক্ত আইজিপি ও আইজিপি পর্যন্ত হওয়া যায়। শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারের শুরুর পদ হলো সহকারী কমিশনার। এরপর একে একে পদোন্নতি পেতে থাকেন।

প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে সারা বিশ্বেই সরকারি চাকরির প্রতি মানুষের অনীহা তৈরি হচ্ছে; বরং মানুষ বিভিন্ন স্বাধীন পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কিন্তু বাংলাদেশ চলেছে উল্টোরথে। এখানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবাই সোনার হরিণ পেতে চাইছে। কারণ, একবার কেউ এটা পেয়ে গেলে সেটা আর হারানোর ভয় নেই। সরকারি চাকরি পাওয়া কঠিন, কিন্তু যাওয়া অসম্ভব। তাই সবাই সামাজিক ও আর্থিক সুরক্ষার জন্যই এটাকে বেছে নিচ্ছে বলেই আমার ধারণা। অনেকেই নতুন প্রজন্মের সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়াটাকে ভালোভাবে দেখছেন, কিন্তু আমি দেখি না। কারণ আমি জানি, তাঁরা কেউই দেশপ্রেম বা দেশের সেবা করার ব্রত নিয়ে এই চাকরিতে আসছেন না, বরং পরিবারের সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যই আসছেন। কোনো পরিবারে একজন সরকারি চাকরিজীবী থাকা মানে রাতারাতি সমাজে তাদের অভিজাত অবস্থা তৈরি হয়ে যায়।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সংবাদপত্রগুলো সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রকাশ করার পাশাপাশি বিসিএস পরীক্ষার জন্য আলাদা পাতাও প্রকাশ করে। এটাকে আমার কাছে সবচেয়ে বড় ভণ্ডামি মনে হয়। অনেকেই বলতে পারেন, সবাই তো আর দুর্নীতিগ্রস্ত নন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সংখ্যাটা কত? আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রতিটি সরকারি দপ্তরেই একেবারে হাতে গোনা কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকেন, যাঁরা সৎ। আসলে তাঁরাই পুরো সিস্টেমই শক্ত হাতে ধরে রাখেন, ফলে সেটা ভেঙে পড়তে গিয়েও পড়ে না। এটা করতে গিয়ে সেই মানুষগুলো একেবারে সাধারণ জীবন যাপন করেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই সততা তাঁদের পরিবার, বন্ধুমহল, সমাজ ও অফিসে অন্যদের জন্য আলোচনার ও হাস্যরসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এতে আর কেউই আসলে নিজেকে সৎ রাখতে উৎসাহ পান না, বরং স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন। যেমন চলছে চলুক। কারণ, স্রোতের বিপরীতে চলতে গেলে অনেক ঝুঁকি থাকে, এমনকি প্রাণনাশের সম্ভাবনাও আছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

দেশে কিংবা প্রবাসে বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীদের নিয়ে মানুষের মনোভাব একই। আমরা স্বামী-স্ত্রী প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি, এটা প্রবাসের মানুষ অনেকেই বিশ্বাস করেন না। সোনার ডিম দেওয়া হাঁসকে নিশ্চয়ই কেউ ফেলে দেয় না। এক বাসায় দাওয়াতে গিয়ে দেশ থেকে আসা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি ধর্মের অনেক নিয়মকানুন আমাদের বোঝাচ্ছিলেন। তিনি দেশে কোনো একটা সরকারি দপ্তরে কেরানির কাজ করতেন। যেই শুনলেন আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি, সেই উনি বলতে শুরু করলেন, আমি একটা বিশাল ভুল করেছি। আমি তখন বুঝলাম, তিনি আসলে কী বলতে চাইছেন। উনি নিজেও জীবনের সব উপার্জন দিয়ে প্রবাসে থাকা মেয়েজামাইকে ব্যবসায় সহযোগিতা করেছেন। আমাদের ধর্ম পালন এবং দুর্নীতির মহোৎসব আসলে পাশাপাশি চলে। বিষয়টা এমন যে একটা দিয়ে অন্যটা কাটাকাটি হয়ে যায়। দেশের সরকারের দুর্নীতি নিয়ে মুণ্ডুপাত করা প্রবাসীদের অন্যতম বড় বিনোদন। কিন্তু এরাই আবার যখন দেশ থেকে কোনো মন্ত্রী বা আমলা আসেন, তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিয়ে ক্ষমতার সঙ্গে নিজেদের যোগসূত্র জাহির করেন।

প্রবাসের বেগমপাড়া এখন অপ্রিয় সত্য। আর দেশে বেনজীর-মতিউর তো হাজারে হাজার। সম্প্রতি একটা পত্রিকার পাতায় মতিউরের গ্রামে গিয়ে কী জানা গেল, সে প্রতিবেদন পড়লাম। সেখানে গ্রামের একজন বলেছেন, মতিউর সাহেব অনেক ভালো মানুষ। শুধু শুধু তাঁর নামে বদনাম করা হচ্ছে। আরেকজন বলেছেন, ‘সবার মাথার চুলই তো কালো!’ এটাই আসলে সবচেয়ে সত্যি কথা। আপনি আসলে কাকে ছেড়ে কাকে ধরবেন। পুরো একটা দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এভাবেই বিবর্তিত হচ্ছে। তবে আশাবাদী হয়েছিলাম তথ্যপ্রবাহের অবাধ প্রচার দেখে। এবার নিশ্চয়ই একে একে মানুষ সরকারি লোকজনের দুর্নীতি প্রকাশ করতে শুরু করবেন। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। আসলে দুর্নীতি থেকে আমাদের মুক্তি নেই। এটাকে যত দ্রুত আমরা আমাদের জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নেব, জীবনযাপন ততই সহজ হবে?