মঙ্গল বর্ষিত হোক তোমার ওপর

দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।ছবি : সাইফুল ইসলাম

সময়টা সত্তরের দশক। মা–বাবা আর আমাদের তিন ভাইবোনের ছকবাঁধা জীবন। সেই জীবনে বৈচিত্র্যের ঝলক নিয়ে আসতেন মনজুর ভাই (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম)। আমি তখন ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়ি। মনজুর ভাই তখন ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া, পরবর্তী সময়ে সদ্য পাস করা টগবগে তরুণ। ভাইয়া বাসায় এলে আম্মা ভালোমন্দ রান্না করতেন। ভাইয়া তখন আমাদের সঙ্গে নানা ধরনের শিক্ষামূলক ও বুদ্ধির খেলা খেলতেন। সিলেট থেকে মাঝেমধ্যে খালুও আসতেন বাসায়। ভাইয়ার সবচেয়ে বড় ভাই আনোয়ার ভাই ও তাঁর পরিবারের সঙ্গেও তখন আমাদের পরিবারের খুব যাওয়া–আসা ছিল। তবে মনজুর ভাইকে যে আমরা তখন খুব ঘন ঘন পেতাম, তা নয়। বোধ করি পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তিনি। আমার চোখে ভাইয়া তখন পৃথিবীর সুন্দরতম এক পুরুষ।

সময় উড়ে যায় তার নিয়ম মেনে। আম্মার সঙ্গে তাঁর ভাগনের (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম) দেখা হয় মাঝেমধ্যে। মনজুর ভাইয়ার বিয়ের পর, আম্মা ভাইয়ার সংসারে একবার–দুবার ঘুরেও আসেন। খুব সম্ভব ভাইয়ারা তখন রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে থাকতেন।

এসএসসি পাসের পর আমার বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর চাকরির কারণে আমি তখন এক ক্যান্টনমেন্ট থেকে অন্য ক্যান্টনমেন্টে ঘুরে, নতুন রূপে সংসার সাজাতে ব্যস্ত। ধীরে ধীরে আমার পরিবারে আরও দুজন সদস্যের যোগ হয়।

আরও পরের কথা, আমরা তখন মাত্র চীন থেকে ফিরে, চিটাগং ক্যান্টনমেন্টে আছি। অভাগী এই আমি এরই মধ্যে মাকে হারালাম। স্বার্থপরের মতো, খালা, মামাদের মাঝে খুঁজে ফিরি স্নেহের আশ্বাস। মনজুর ভাইয়ের বড়, জাফর ভাই তখন পরিবার নিয়ে চাটগাঁয়। রত্নগর্ভা শ্রদ্ধেয় রাবেয়া খালাও তখন সেখানে! একবার খালার শরীর খারাপ জেনে হাসপাতালে দেখতে গেছি, গিয়ে দেখি মনজুর ভাই বই হাতে মায়ের পাশে বসা। ভাইয়া তখন প্রতিষ্ঠিত লেখক, জনপ্রিয় অধ্যাপক। অল্প কথায় একজন সেলিব্রিটি আর মিডিয়া ব্যক্তিত্বও বটে। সম্ভবত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়ে গেছেন এরই মধ্যে।

কী অবাক কাণ্ড, ভাইয়ার ঠোঁটে সেই স্নেহ মাখানো হাসিটি অবিকল আগের মতোই স্নেহ ছড়াচ্ছে! সরু রিমের ‘জন লেননের’ স্টাইলের চশমা আর ফেইডেড জিনসে কী চৌকসই না লাগছিল ভাইয়াকে! খালার শারীরিক অবস্থা ভালোর পথে বিধায়, সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরে গেলেন ভাইয়া। খুব মন চাইলেও স্বামী-সন্তানদের সঙ্গে ভাইয়ার আলাপ করানোর জন্য বাসায় নেমন্তন্ন করা গেল না। যাঁরা ভাইয়াকে কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁরা জানেন ভাইয়া তাঁর মাকে কতটা ভালোবাসতেন! চাটগাঁ গেলে তিনি খালার পাশেই থাকতে চাইতেন।

এই সময়ে ভাইয়া একবার পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা (Chittagong Hill Tracts) পরিদর্শনে আসেন সাংবাদিকসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দলের সদস্য হয়ে। তখন দেখা ও কথা হয় আমার স্বামীর সঙ্গে।

চাটগাঁর পাততাড়ি গুটিয়ে, যখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে এলাম, মনে জেদ চাপল আহা রে আর কিছু না হোক অন্ততপক্ষে মাস্টার্সটা কমপ্লিট করি। গাজীপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ধরনা দিতে হলো বেশ কয়েকবার। বাঙালি মেয়েদের কাছে ভাই হলো পরম আস্থার স্থান। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তখন খুবই ব্যস্ত। সৃষ্টির প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর অবাধ বিচরণ। এত যে যাঁর গুণ অথচ অহমিকা ছিল না তাঁর মোটেই। তাই বোনের আবদার ফেললেন না। আজ মনে পড়ছে না কোথায় ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করেছিলাম, তবে ভাইয়া আমার দুই হাত ভরে সাজেশন ও নোটস দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। খুব সম্ভব ভাইয়া ডাকযোগেও সাহায্য পাঠিয়ে ছিলেন। ভাগ্যিস ইংরেজিতে মাস্টার্সটা অর্জন করেছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রে এই মাস্টার্সটার বদৌলতে কিছু করে, কাজ চালাতে পারছি। (বাংলাদেশের মাস্টার্স সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের চার বছরের ব্যাচেলর ডিগ্রি প্রোগ্রামের সমমানের বলে বিবেচিত হয়।)

আবার ফিরে যাই পেছনে। মিলিনিয়ামের শুরুতে আমরা ঢাকায় আসি। আমার পুরোনো চাওয়াটাও পূরণ করা হলো এবার। ভাইয়া সানন্দে নেমন্তন্ন রক্ষা করলেন। ভাইয়া সামরিক উর্দি পরা আমার মানুষটাকে বরাবরই পছন্দ করতেন। বলা বাহুল্য, একই শহরে থাকায় ভাইয়া-ভাবির সঙ্গে দেখা হতো নানা অনুষ্ঠানে।

এরপর চলে এলাম যুক্তরাষ্ট্রে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে মহা ব্যস্ত আমরা সবাই। এরই মধ্যে হারালাম বাবাকে। তারপর হঠাৎ কোভিড এসে ইতি টানল সব ব্যস্ততার। এখানকার স্কুলগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয় গেল। তখনো ভার্চ্যুয়াল ক্লাস শুরু হয়নি। ছাত্রের পেছনে তখন আর সময় বা শ্রম ব্যয়ের প্রয়োজন হয় না সত্য, কিন্তু নানা অনিশ্চয়তা আর অচেনা ভবিষ্যতের ভাবনায় নিশ্বাসে নিশ্বাসে উৎকণ্ঠা! মনকে বললাম, ‘আয় মন লেখাতে’। পুরোনো নেশা আর অফুরন্ত সময়, মন নিবিষ্ট হলো লেখালেখিতে।

নানা ক্যান্টনমেন্টে ঘুরে ঘুরে থাকার দিনগুলোর অভিজ্ঞতার গল্প লিখতে শুরু করলাম আমার ফেসবুকের পাতায়। তারপর হঠাৎ একদিন দেখলাম আমার লেখায় মনজুর ভাইয়ার কমেন্ট! মন খুশিতে ডানা মেলে দিল। আমি সে ডানায় ভর করে শূন্যে উড়ে বেড়ালাম! পরে মেসেঞ্জারে ভাইয়া লিখলেন, আমার লেখার সাবলীল ভাব তাঁর ভালো লেগেছে। পরামর্শ দিলেন, পর্বগুলো লিখে যেতে। এবং পরে বই আকারে বের করার। মেসেঞ্জারে আমাদের নানা ‘সৈয়দ মুজতবা আলীর’ প্রসঙ্গ টানতে ভুললেন না। ভাইয়া ফেসবুকে তেমন একটা ঘুরে বেড়াতেন না। আমার লেখা তাঁর নজরে পড়ায় কী যে ভালো লাগল। তখনই মনে অঙ্কুরিত হলো এক ভাবনার! আমার এই বইয়ের মুখবন্ধটুকু রচিত হবে ভাইয়ার কলমে!

কোভিডের ভয় কেটে যেতেই ফিরতে বাধ্য হলাম সেই ব্যস্ত জীবনে। আবার ব্যক্তিগত জীবনের দু–একটা অঘটনায় সৃষ্টিশীল সব ভাবনা মন থেকে উধাও হলো। সময়ে সব সয়ে যায়। আবারও ঘুরে দাঁড়ালাম। ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে লেখা শুরু করলাম।

যেহেতু স্কুলে কাজ করি, ছুটিছাটা পাই যথেষ্ট। আর দেশেও যাওয়া হয় আমার প্রচুর। এপ্রিলে পাই ‘বসন্তের ছুটি’। শুনতে পেলাম আমাদের বৃহত্তর পারিবারিক ঈদ পুনর্মিলনীর অনুষ্ঠান আয়োজিত হতে যাচ্ছে একই সময়ে। যথাসময়ে উপস্থিত হলাম মিলনমেলায়। কী যে ভালো লাগল সবাইকে দেখে! দেখা হলো মনজুর ভাইয়ার সঙ্গেও। বই বের করার মতো যথেষ্ট পর্ব তখনো লিখে উঠতে পারিনি। ওই প্রসঙ্গ নিয়ে কথাও ওঠালাম না। ভাবলাম তাড়া কিসের? ব্যাপারটা নিয়ে ফোনেও কথা বলা যাবে। ভাইয়া নিশ্চয় আমার অনুরোধ রাখবেন বরাবরের মতোই। এত বছর পরেও চোখে পড়ার মতো কোনো পরিবর্তন ভাইয়ার মধ্যে নেই। দারুণ খুশি হলেন আমাদের দেখে।

পারিবারিক ফেসবুক গ্রুপে তাঁর অসুস্থতার খবর পেলাম। মনটা খচখচ করতে লাগল। খালা, মা, বাবা, ফুফুদের পর্ব শেষে, সৃষ্টিকর্তা এবার তুলে নিচ্ছেন নিজ প্রজন্মের সদস্যদের। কিন্তু শেষ দেখায় ভাইয়াকে মোটেও অসুস্থ মনে হয়নি। ‘হে বিধাতা দয়া কর!’ মিডিয়ার সৌজন্যে দেখলাম অচেনা-চেনা কত অগণিত মানুষ এই দোয়াই করছেন।

মনজুর ভাইয়া চলে গেলেন। আমার মনে লালিত অঙ্কুর আর প্রাণ পেল না। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘সৈয়দয়ানা’ ধরে রাখার যে গুরু দায়িত্ব পরবর্তী বংশের ওপর বর্তায়, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যেন তা স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। রসবোধসম্পন্ন, সাবলীল আর জীবননিষ্ঠ লেখার মাঝে বেঁচে থাকবেন এই বহু প্রতিভাধর মানুষটি...

মনঃকষ্ট থেকে হয়তো কখনো কখনো হৃদয়স্পর্শী পঙ্‌ক্তিমালা রচনা করা যায়। আবার কখনো লিখতে বসে এ কষ্টটা সামাল দেওয়া যায় না। আমরা মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি আর নিশ্চয়ই তাঁর কাছেই ফিরে যাব।

*লেখক: শবনম চৌধুরী, এলিমেন্টারি স্কুল টিচার, ক্যালিফোর্নিয়া, আমেরিকা