ফ্লামিঙ্ক: দক্ষিণ স্পেনের লোকজ নৃত্যকলা

সম্প্রতি স্পেনের বার্সেলোনায় গিয়েছিলাম। দেখি, হান্না (ছোট বোন) এখানকার প্রচণ্ড জনপ্রিয় একটি ফ্লামিঙ্ক শোর দুটি টিকিট কেটে রেখেছে। বার্সেলোনার বিখ্যাত ‘পালাউ ডে লা মুসিকা, কাতালিনা’ হলে এ শো ২০ বছর ধরে সপ্তাহে দুই দিন করে বিরামহীনভাবে প্রদর্শিত হয়ে আসছে। বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত প্রতিটি শোতেই দোতলা এ হলে দর্শক কানায় কানায় পূর্ণ থাকে, সেদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

সন্ধ্যা সাড়ে নয়টায় শো শুরু হবে, নয়টায় ভাগনে ত্রিমনকে নিয়ে হলে পৌঁছে দেখি, হলটিই একটি দর্শনীয় স্থাপনা। আঠারো শতকের শুরুতে নির্মিত হলটির দেয়ালের ও ছাদের নান্দনিক কারুকার্য থেকে দৃষ্টি ফেরানো দায়। ভাস্কর্য ও কাচ-মোজাইক দিয়ে ফুল-লতা-পাতার চিত্রকর্মের সংমিশ্রণে অপূর্ব নান্দনিক কারুকাজ দেয়ালজুড়ে। ছাদেও রঙিন কাচের সঙ্গে আলোর মিশ্রণে অনন্য শিল্পকর্ম। দৃষ্টিগ্রাহী সৌন্দর্যের হলটিতে বসার খানিক পরই শুরু হলো অনুষ্ঠান।

বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে চারজন বাদক ও হাততালির জন্য দুজন মোট ছয়জন সারিবদ্ধভাবে স্টেজে বসে বাজনা ও তালি শুরু করতেই একজোড়া নৃত্যশিল্পী মঞ্চে এসে নাচ শুরু করেন। তাঁদের একজন আবার নাচের সঙ্গে সঙ্গে গানও গাচ্ছেন।

আমাদের নৃত্যানুষ্ঠানের মতো নেপথ্যে নয়, নৃত্যশিল্পী নিজেই নাচের সঙ্গে নিজ কণ্ঠেই সংগীতও পরিবেশন করেন। অনেকটা ইউরোপীয় শাস্ত্রীয়সংগীত বা ধ্রুপদি সংগীতের সুরের গান, প্রচণ্ড জোরে গলা ছেড়ে গাইছেন, গানের সঙ্গে পা দিয়ে মেঝেতে টুকে টুকে ও পেছনে বসা বাদকদের বাজনা ও হাততালির সমন্বয়ে তালে, নাচে যেন এক অপার্থিব ছন্দ-মূর্ছনার সৃষ্টি হয়। নাচিয়ে ও নর্তকী বদল করে করে বর্ণালি পোশাক পরে একের পর এক নাচ, গান চলে দুই ঘণ্টাব্যাপী। আমরা উপভোগ করি অভূতপূর্ব এক নাচের অনুষ্ঠান। হয়তো নাচ ও গান দিয়ে একটি গল্পও বলা হয়ে থাকবে, যা ভাষার সীমাবদ্ধতার জন্য আমি বুঝতে পারিনি। যদিও এতে হাততালির সঙ্গে পা টুকা নৃত্যের রস আস্বাদনে কোনো কমতি পড়েনি।

এবার ফ্লামিঙ্ক সম্বন্ধে খানিকটা ধারণা নেওয়া যাক। ফ্লামিঙ্ক দক্ষিণ স্পেনের ঐতিহ্যবাহী একটি লোকজ নৃত্যকলা, একটি বিশেষ শিল্পমাধ্যম। হাজার বছরের পুরোনো এ নৃত্যকলা নাকি উত্তর আমেরিকায় বা লাতিন আমেরিকায় গিয়ে আরও পরিশীলিত হয়েছে। অনুমান করি, উত্তর আমেরিকায় স্পেনের কলোনিয়ান শাসনামলে স্প্যানিশরাই সেখানে এ নৃত্যশিল্পের চর্চা করেছে, স্থানীয়দের শিখিয়েছে। আন্তরিক চর্চা ও প্রশিক্ষণে হয়তো এর উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে সেখানে। চারটি যন্ত্র, যেমন স্প্যানিশ  গিটার, ফ্লেমিঙ্ক কাখন, কাস্তানেটসের সঙ্গে হাততালি ও নাচের সময় বিশেষ একধরনের জুতার শক্ত হিল দিয়ে মেঝেতে টুকে টুকে তাল-লয়ের এক অপূর্ব মূর্ছনার সৃষ্টি হয়। হাততালিও নাচের সময় পা দিয়ে মেঝেতে টুকে টুকে তাল সৃষ্টিই ফ্লামিঙ্কের বিশেষত্ব, এটাই অন্য নৃত্যকলা থেকে এর ভিন্নতা।

ভাষাগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অসাধারণ এক অনুষ্ঠান উপভোগ করি আমরা। উপলব্ধি করি ফ্লামিঙ্কের একটি সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আবেদন আছে, যা ভাষার সীমানা পেরিয়ে সব ভাষার, সব সংস্কৃতির মানুষের রসবোধ ও মনন আন্দোলিত করতে সক্ষম। হান্নাকে ধন্যবাদ, ধন্যবাদ ত্রিমনকে।