সুলেমানের পিরামিড
চিলারকান্দি গ্রামে সুলেমান বকশীর বিরাট নামডাক। শিক্ষিত মানুষ। গ্রামের মানুষের কল্যাণে সব সময় কাজ করেন। সুলেমানের বাপ–দাদার দানের জমিতে এই চিলারকান্দি গ্রামের স্কুল ও মসজিদ হয়েছে। সুলেমান নিজ খরচে গ্রামের মানুষের জন্য ফানাই গাঙের ওপর কাঠের পুল বানিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া সব সময় দান–খয়রাত করে থাকেন। বাপ–দাদার রেখে যাওয়া জমিজমায় কৃষিখেত করেন। কুলাউড়া বাজারে সুলেমানের একটি ভাতের হোটেল আছে। আবার কুলাউড়া মৌলভীবাজার রুটে একটি বাসও আছে সুলেমানের। ভূকশিমইল ইউনিয়ন থেকে তিনবার চেয়ারম্যান ইলেকশনে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনবারই ফেল করেছেন। লোকে বলে ভালো মানুষটারে কেউ ভোট দেয় না, আর দুষ্ট লোকেরা পাস করে যায়। গত ইলেকশনে সুলেমানের মার্কা ছিল উট।
এই নিয়ে আবার তাঁর অপজিশনের কিছু দুষ্টু পোলাপাইনকে বলতে শোনা গিয়েছিল—
সুলেমানের মার্কা উট
সুলেমান পায় না ভোট!
সুলেমানের নাই বেইল
সুলেমান এবারও ফেইল।
সুলেমান বকশী শৌখিন মানুষ। ঘোরাফেরা করতে পছন্দ করেন। পুরোনো স্থাপত্যে আগ্রহ বেশি। বিশেষ করে পুরাকীর্তি, পুরোনো দালান, ঐতিহাসিক জায়গা সুলেমানকে টানে। বাংলাদেশের যত জায়গায় যত পুরাকীর্তি, মসজিদ, মন্দির আছে—সব তিনি দেখেছেন।
ঢাকার লালবাগ দুর্গ থেকে ময়মনসিংহের আটআনি জমিদারবাড়ি, চট্টগ্রামের শমসের গাজীর কেল্লা থেকে যশোরের মাইকেল মধুসূদনের বাড়ি কিংবা কুমিল্লার ময়নামতি থেকে রংপুরের মিঠাপুকুর মসজিদ, কোনো জায়গায়ই সুলেমান ঘুরে দেখা বাদ দেননি। সুলেমানের বাড়ির কাছে ভাটেরায় যখন ভাটেরা টিলা ঢিবিতে প্রাচীন তাম্রলিপির নিদর্শন পাওয়া গেল, সেই সময় সুলেমান নিজ খরচে মাইক্রোবাস ভাড়া করে প্রতিদিন চলে যেতেন খননকাজ দেখতে। খননকর্মীদের জন্য বাড়ি থেকে রান্না করে খাবারও নিয়ে যেতেন।
সুলেমান বকশীর মনে বহুদিনের একটি গোপন ইচ্ছা, তিনি পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি আশ্চর্য মিসরের পিরামিড দেখবেন। বইয়ে পড়ে, ছবি দেখে, ভিডিও দেখে অনেক কিছুই জেনে রেখেছেন পিরামিড সম্পর্কে। চার হাজার বছর আগে কীভাবে এই পিরামিড তৈরি হলো, পিরামিডের ভেতরে কীভাবে মৃতদেহ রাখা হয়, কীভাবে মমি করা হয় ইত্যাদি।
সুলেমান এবার মনস্থির করেই ফেললেন মিসর যাবেন। পাসপোর্ট আগেই করে রেখেছিলেন। খেতের জমি বিক্রি করে কিছু ক্যাশ করলেন আর কাগজপত্র নিয়ে ঢাকায় মিসরের এম্বাসিতে গিয়ে এক সপ্তাহের ভিসা নিয়ে পিরামিড দেখতে মিসর চলে গেলেন।
কায়রো থেকে নীল নদ দেখতে দেখতে সুলেমান গিয়ে পৌঁছালেন মিসরের গিজা শহরে। পরদিন সকালে গেলেন পিরামিড দেখতে। দ্য গ্রেট পিরামিড অব গিজা দেখে মুখ হাঁ হয়ে গেল সুলেমানের। কীভাবে সম্ভব? চার হাজার বছর আগে কোনো আধুনিক টেকনোলজি ছাড়া এত বড় বড় পাথরের তৈরি পিরামিড! সুলেমান একজন গাইড নিয়ে পিরামিডগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন এবং জানলেন পিরামিডের পেছনের ইতিহাস।
যতই দেখেন ততই অবাক হন। বড় তিনটি পিরামিড ছাড়াও আশপাশের ছোট পিরামিডগুলোও দেখলেন। পিরামিডের ভেতরে ঢুকে মমি রাখার চেম্বার দেখে বললেন এত দেখি বিশাল সাইজের ঘর পিরামিডের ভেতর! মিউজিয়ামে গেলেন, মমি দেখলেন, মমি করার প্রক্রিয়া দেখলেন। নীল নদে নৌকা করে ঘুরলেন। কায়রো শহরের বিভিন্ন স্থাপত্য ঘুরে দেখলেন। কিন্তু পিরামিড দেখার পর সুলেমানের আর ঘোর কাটে না। মিসরে থাকা অবস্থায় মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে ফিরেই তাঁর নিজের জন্য একটি পিরামিড বানাবেন।
সুলেমানের পিরামিড তৈরির ইচ্ছায় পরিবারের মানুষ, গ্রামবাসী কেউই সায় দিল না। সবাই বলাবলি করল যে সুলেমানের মাথা খারাপ হয়ে গেছে! কিন্তু সুলেমান নাছোড়বান্দা। সবার মতামত অগ্রাহ্য করে তিনি পিরামিড তৈরিতে হাত দিলেন। ফানাই গাঙের পাশে তাঁর নিজের একটি জায়গা বেছে নিলেন পিরামিডের জন্য। পিরামিডের খবর চারদিকে ছড়িয়ে গেলে দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন মানুষ সুলেমানের বাড়িতে ভিড় জমাল।
পিরামিড বানাতে সুলেমান আরও কিছু ধানের জমি আর কুলাউড়া মৌলভীবাজার রুটে চলা তাঁর গাড়িটা বিক্রি করে দিলেন। জাফলং থেকে পাঁচ ট্রাক বড় বড় পাথর আনালেন। আশপাশের এলাকার ভালো রাজমিস্ত্রিদের ভাড়া করলেন। ইন্টারনেট থেকে পিরামিডের নকশা, ছবি সংগ্রহ করে কাজ শুরু করে দিলেন। ভারী ভারী পাথর আর সিমেন্ট দিয়ে পিরামিড তৈরিতে কয়েক মাস লেগে গেল। পাথর ওঠানোর জন্য সুলেমান ক্রেনও ভাড়া করলেন। অবশেষে তৈরি হলো সুলেমানের পিরামিড।
পিরামিডের ভেতরে ১০ ফিট স্কয়ারের রুম রাখলেন। আর ত্রিভুজ পিরামিডের একেবারে ওপরে দুই ইঞ্চি পাইপ লাগিয়ে একটা ছিদ্র রাখলেন বাতাস আসা-যাওয়া করতে। কারণ, মিসরের পিরামিডের ভেতরে সুলেমানের গুমোট পরিবেশ লাগছিল আর তাঁর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। নিজের জন্য একটি কাঠের কফিন বানিয়ে পিরামিডের ভেতরে রেখে দিলেন। আর পিরামিডের ভেতরে প্রবেশের রাস্তাটি একটি বড় পাথরে ঢেকে রাখলেন।
সুলেমান পরিবারের মানুষকে নির্দেশ দিলেন, তিনি মারা গেলে যেন তাঁর লাশ কফিনে ভরে পিরামিডের ভেতরে রেখে ঢোকার রাস্তাটি পাথর আর সিমেন্ট দিয়ে যেন ভালোভাবে সিল করে দেওয়া হয়।
অনেক বছর কেটে যায়। একদিন সুলেমানের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর সিপিআর দেওয়া হয় কিন্তু সুলেমানের আর দম ফেরেনি। মৃত সুলেমানকে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী জানাজা পড়ে কফিনে শুইয়ে পিরামিডের ভেতরে রেখে দেওয়া হলো। তারপর বড় পাথর আর সিমেন্ট দিয়ে প্রবেশের রাস্তাটি বন্ধ করে দেওয়া হলো। চিলারকান্দি গ্রামের সব মানুষ পিরামিড ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। নানান জন নানান কথা বলল। একসময় যে যার মতো করে চলে গেল।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। আকাশে ঝকঝকে চাঁদ। হঠাৎ সুলেমানের দম ফিরে এল! লম্বা শ্বাস নিতে নিতে কাফনের কাপড় সরিয়ে কফিন থেকে উঠে দাঁড়ালেন সুলেমান!
সুলেমান আসলে মারা যাননি। মৃত ভেবে তাঁকে পিরামিডের ভেতরে কবর দিয়ে দেওয়া হয়। হাসপাতালে সিপিআর দেওয়ার পর সুলেমানের শ্বাস না ফিরলেও সে তখন পর্যন্ত মারা যায়নি। ডাক্তারি ভাষায় এটাকে ল্যাজারাস সিনড্রোম বলে। পৃথিবীতে এ রকম ঘটনা বহু দেশে ঘটেছে, যা মেডিকেল জার্নালে লিপিবদ্ধ আছে। এই সিনড্রোমে অনেকের শ্বাস ফিরে আসতে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। সুলেমানের বেলায়ও তা–ই ঘটেছে।
পিরামিডের ভেতরে অন্ধকার। সুলেমান ঠাহর করতে পারেন না তিনি কোথায়। ভয়ে কুঁকড়ে যায় সুলেমান। পিরামিডের ওপরের সেই দুই ইঞ্চি পাইপের ছিদ্র দিয়ে চাঁদের আলো এসে ঢোকে। সেই আবছা আলোয় সুলেমান বুঝে যান তিনি পিরামিডের ভেতরে। বুঝে যায় তাঁকে মৃত ভেবে পিরামিডের ভেতরে কবর দেওয়া হয়েছে। সুলেমান চিৎকার করতে থাকেন। আমি মরিনি! আমি মরিনি! পিরামিড ভেঙে আমাকে বের করো।
দিনের আলো ফুটে ওঠে। দুই ইঞ্চি ছিদ্র দিয়ে সূর্যের আলোর সরু রেখা আসে পিরামিডের ভেতরে। সুলেমান পিরামিডের দেয়াল ধরে থাবড়ায় আর চিৎকার করতে থাকেন, আমাকে বের করো, আমি মরিনি! আমি পিরামিড চাই না। কিন্তু সুলেমানের এই চিৎকার পাথরের দেয়াল ভেদ করে বাইরে আসতে পারে না। পিরামিডের ছিদ্রের পাশে দুইটা চড়ুই কিচিরমিচির করে। সুলেমানের চোখে নীল আকাশ ও খোলা বাতাস খেলা করে আর দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। পাশে ফানাই গাঙের পানি কলকল শব্দে বয়ে চলে হাকালুকি হাওরের পানে।
শতাব্দী পেরিয়ে একদল ব্রিটিশ আর্কিওলজিস্ট পিরামিডের খোঁজে আসে চিলারকান্দি মডেল টাউনে। শহরের পাশে নদীর ধারে পরিত্যক্ত জঙ্গলে শেওলায় আবৃত সুলেমানের পিরামিডের খনন শুরু করে এই ব্রিটিশ দলটি। ভেতরে ঢুকে তারা একটা ভঙ্গুর কাঠের কফিন ও কিছু ময়লা সাদা কাপড় দেখতে পায়। আরও দেখতে পায় পিরামিডের দেয়ালে হেলান দিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসা একটি কঙ্কাল।
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]