‘আমার দেখা নয়াচীন’–দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ
বইটির ফ্ল্যাপে লেখা আছে, ‘১৯৫২ সালের ২-১২ অক্টোবর চীনের পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে এ সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে নয়াচীন সফর করেন। “আমার দেখা নয়াচীন”—স্মৃতিনির্ভর এ ভ্রমণকাহিনি তিনি রচনা করেন ১৯৫৪ সালে কারাগারে রাজবন্দী থাকাকালে। শিল্পিত মন ও সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে সদ্য বিপ্লবোত্তর গণচীনের শাসনব্যবস্থা ও জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন প্রাঞ্জল ভাষায়। এ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর সাম্রাজ্যবিরোধী মনোভাব, অসাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার গভীর পরিচয় মেলে। একজন তরুণ রাজনীতিকের মননপরিচয়, গভীর দেশপ্রেম এবং নিজ দেশকে গড়ে তোলার সংগ্রামী প্রত্যয় ফুটে উঠেছে রচনার পরতে পরতে। অপার সৌন্দর্যপ্রিয়তা, জীবন-সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি মুগ্ধ দৃষ্টি এবং সঞ্জীবনতৃষ্ণা এ গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য। এ ভ্রমণকাহিনি রচনার পটভূমি, বহু ঘাত-প্রতিঘাতে পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ, বর্তমান গ্রন্থ প্রকাশের ইতিবৃত্ত এবং দুর্লভ আলোকচিত্র গ্রন্থটিকে আকর্ষণীয় করেছে। বঙ্গবন্ধুর এ অমিয় ভ্রমণকাহিনি তাঁর অন্য বইগুলোর মতো পাঠকপ্রিয়তা লাভ করবে, এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।’
এ বইয়ের ভূমিকায় শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘...এই লেখার মধ্যে দিয়ে আমরা দেখি, পাকিস্তানি শাসকেরা পূর্ববঙ্গের মানুষ যারা সংখ্যায় বেশি অর্থাৎ ৫৬ ভাগ, তাদের কীভাবে বঞ্চনা করেছে সে ধারণাও পাওয়া যায়।...প্লেনে চড়ে আকাশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এমনকি ছোটখাটো বিষয়ে যেমন মেঘের ভিতরে বাতাস থাকে না বলে যে প্লেনে বাম্পিং হয় আর সেটা যে কারও ভীতির কারণ, তা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন।...বিপ্লবের পর সামাজিক ক্ষেত্রে যে একটা পরিবর্তন আসে, তা নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে দেশ কীভাবে পরিচালিত করা যায়, তা তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।...তিনি শুধু সম্মেলনেই অংশগ্রহণ করেন নাই, তিনি এই দেশকে খুব গভীরভাবে দেখেছেন। কৃষকের বাড়ি, শ্রমিকের বাড়ি, তাদের কর্মসংস্থান, জীবনমান সবই তিনি দেখেছেন। ছোট ছোট শিশু ও ছাত্রছাত্রীদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। শিশু বয়স থেকেই দেশপ্রেম ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করার যে প্রচেষ্টা ও কর্মপন্থা, তা–ও অবলোকন করেছেন।’
বইয়ের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর জীবন্ত স্বগতোক্তি, ‘১৯৫২ সালে জেল হতে বের হলাম, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর। জেলে থাকতে ভাবতাম আর মাঝে মাঝে মাওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, “যদি সুযোগ পাও, একবার চীন দেশে যেয়ো।” এরপর আছে পাসপোর্ট বানানোর ঝক্কি। তখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় সবকিছুর নিয়ন্তা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী করাচি। পাসপোর্টের প্রথমবারের আবেদনপত্র হারিয়ে যায়। দ্বিতীয়বারের আবেদনপত্রও ঝুলে থাকে কারণ হোম ডিপার্টমেন্টের অনুমতি নাই।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘লাল ফিতার প্যাঁচ। করাচির হুকুম প্রয়োজন। তাহা না হলে পাকিস্তানের বিশেষ করে পূর্ব বাংলার কোনো জলসাই হয় না।’ ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে গেলেও একটা সময় পর্যন্ত ভারতীয় এবং পাকিস্তানিদের বিদেশভ্রমণের সময় লিখতে হতো পাকিস্তানি বা ভারতীয় ব্রিটিশ নাগরিক।
বঙ্গবন্ধু এই বইয়ে লিখেছেন, ‘আমি লেখক নই, আমার ভাষা নাই, তাই সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গোছাইয়া লিখতে পারি না। পাঠকবৃন্দ আমায় ক্ষমা করবেন।’ এটা শুধুই বঙ্গবন্ধুর বিনয়, কারণ এই বই শেষ করে আপনি অবাক বনে যাবেন বঙ্গবন্ধুর প্রাঞ্জল বর্ণনা পড়ে। এখানে উপমার আধিক্য নেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের শব্দমালা দিয়েই উনি একেকটা বাক্য তৈরি করেছেন। ফলে প্রতিটি বাক্যই হয়েছে সহজবোধ্য। এই ভ্রমণকাহিনিতে ভাষার প্রথাগত কোনো নিয়ম মানা হয়নি, তাই পড়তে গিয়ে কখনোই একঘেয়ে লাগে না। বঙ্গবন্ধু বৃহৎ কোনো কিছুর বর্ণনা থেকে শুরু করে একেবারে খুঁটিনাটি বিষয়ও সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন। তার মধ্যে আছে ভ্রমণসঙ্গীদের সঙ্গে খুনসুটি, নয়াচীনের শিশুদের ভেংচি কাটার মতো ব্যাপারও।
বঙ্গবন্ধুর ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন ইত্তেফাকের সম্পাদক ‘মানিক ভাই’। তাঁর সঙ্গে খুনসুটির বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘মানিক ভাইয়ের কথা কিছু না বললে অন্যায় হবে। মানিক ভাই যে এত খেতে পারেন, সে ধারণা আগে আমার কোনো দিন ছিল না। হয়তো কোনো দিন একটা মুরগিই খেয়ে ফেলে, সাথে সাথে ডিম, মাছ, ফলফলারি, বসে বসে শুধু খায় আর খায়। মানিক ভাই বলেন, “বেশি কথার কাম নাই। খাবার সময় গোলমাল করো না। চুপচাপ খাও, সময় পাওয়া গেছে। দেশে লীগ আমলে কী খেতে পাই মনে নাই।” রুমে ফিরে এসে আমি, আতাউর রহমান সাহেব ও মানিক ভাই খুব হাসাহাসি করতাম, মানিক ভাইয়ের খাওয়া নিয়ে। আমি আর আতাউর রহমান সাহেব মানিক ভাইয়ের পিছনে লেগেই থাকতাম।’
নয়াচীনে যেতে হয় হংকংয়ের ওপর দিয়ে। হংকংয়ের রাস্তায় গোলাপ ফুল হাতে বারবনিতারা ঘুরে বেড়ান। হংকংয়ে ফুল দেওয়াটা হলো ‘প্রেম নিবেদন’। ফুলটা গ্রহণ করলেই তাঁরা মনে করবেন, আপনি তাঁর সঙ্গে যেতে রাজি হয়েছেন। একদিন বঙ্গবন্ধু, আতাউর রহমান সাহেব, মানিক ভাই এবং ইলিয়াস সাহেব রাস্তায় বেড়াতে বেড়িয়েছিলেন। হঠাৎ ১৬/১৭ বছরের এক মেয়ে আতাউর রহমান সাহেবের কোটে একটা ফুল লাগিয়ে দিতে অগ্রসর হলে তিনি ধাক্কা দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেন। এই ঘটনার পর মানিক ভাই তাঁর ‘রাজনৈতিক মঞ্চের’ মতো ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে ওনার পেছনে লাগতেন।
নয়াচীনের একটা সেলুনে চুল কাটাতে গেলে সেলুনওয়ালা যখন তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন, তখন বঙ্গবন্ধু খুবই মজার একটা উত্তর দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমার আবার পরিচয় কী? কী বলতে পারি? বললাম, এমনি ঘুরে বেড়াই, দেশ–বিদেশ দেখি। মনে মনে বলি, আমার আবার পরিচয়? পথে পথে ঘুরে বেড়াই, বক্তৃতা করে বেড়াই। আর মাঝে মাঝে সরকারের দয়ায় জেলখানায় পড়ে খোদা–রসুলের নাম নেবার সুযোগ পাই। এই তো আমার পরিচয়।’
এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর শিশু মনেরও পরিচয় মেলে। একদিন নানকিং বিশ্ববিদ্যালয় দেখে বেরিয়ে একটা ঘটনার বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমাকে জড়িয়ে ধরল। কারণ, ওদের আমি একটু ঠাট্টা করেছিলাম, মুখ ভেঙচিয়া দিয়াছিলাম। ওরা মনে করল, পেয়েছি মনের মতো লোক। তাই আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি ওদের সাথে কিছু খেলা করে রওয়ানা হলাম। আমার বন্ধুবান্ধবরা আগেই গাড়িতে উঠে বসে রয়েছে। মনে মনে বিরক্ত হলো বলে আমার মনে হলো। কিন্তু কী করব? ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দময় সঙ্গ যেন হুট করে ছেড়ে আসা যায় না, আর আমার স্বভাবও সে রকম না। ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে আমি ভালোবাসি।’
বঙ্গবন্ধু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন নয়াচীনের শিক্ষাব্যবস্থা। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের দেশের মতো কেরানি পয়দা করার শিক্ষাব্যবস্থা আর নাই। কৃষিশিক্ষা, শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং, টেকনিক্যাল শিক্ষা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।... বাধ্যতামূলক ফ্রি শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে।... আমাকে একটা কৃষিস্কুল দেখানো হয়েছিল। সেখানে যুবক কৃষকদের কিছুদিনের জন্য শিক্ষা দিয়ে খামার জমিতে পাঠাইয়া দেওয়া হয়।...মাত্র চার বৎসরে তারা শতকরা ৩০ জন লোককে লেখাপড়া শিখিয়ে ফেলেছে। গর্ব করে আমাকে আবার বলল, ১০ বৎসর পরে যদি চীনে আসেন, তবে দেখবেন একটা অশিক্ষিত লোকও নাই।’ পাশাপাশি নিজের মনেই তুলনা করেছেন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের দেশে অর্থশালী জমিদাররা প্রিভিলেজড ক্লাস, অন্য দেশে শিল্পপতিরা প্রিভিলেজড ক্লাস; কিন্তু নতুন চীনে দেখলাম, শিশুরাই প্রিভিলেজড ক্লাস।...নয়াচীন সরকারের হুকুম, প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিতে হবে, একটা পরিমাণ ঠিক করে দিয়েছে, সেই পরিমাণ খেতে দিতে হবে। পোশাক ঠিক করা আছে, সেইভাবে পোশাক দিতে হবে। যাদের দেবার ক্ষমতা নাই, তাদের সরকারকে জানাতে হবে। সরকার তাদের সাহায্য করবে।...খাওয়া-পরা পেয়ে নয়াচীনের ছেলেমেয়েদের চেহারা খুলে গিয়েছে। মুখে তাদের হাসি, বুকে তাদের বল, ভবিষ্যতের চিন্তা নাই। মনের আনন্দে তারা খেলছে। প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে খেলতে হয়, প্যারেড করতে হয়।’
নয়াচীনের মিলমালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে একটা সাম্যাবস্থা তৈরি করা হয়েছে। শ্রমিকদের জন্য মিলের সঙ্গে আছে নার্সিং হোম, হাসপাতাল এবং শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল আছে। এ ছাড়া মিলের মালিক চাইলেই ইচ্ছেমতো লাভ করতে পারেন না। একটা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও শ্রমিক প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আমরা শ্রমিক ও মালিক পাশাপাশি দেশের কাজ করছি। মিলটা শুধু মালিকের নয়, শ্রমিকের ও জনসাধারণেরও। আজ আমাদের মধ্যে কোনো গোলমাল নাই। আমরা উভয়েই লভ্যাংশ ভাগ করে নেই। শ্রমিকের স্বার্থও আজ রক্ষা হয়েছে, মালিকের স্বার্থও রক্ষা হয়েছে। চিয়াং কাইশেকের আমলে আমাদের মধ্যে তিক্ততা ছিল। মাঝে মাঝে মিল বন্ধ রাখা হতো। আমাদেরও ক্ষতি হতো আর শ্রমিকদেরও ক্ষতি হতো।’
নয়াচীনে যদি শোনা যায়, কোনো এলাকায় কোনো লোক না খেয়ে মারা গেছেন, তাহলে সেই এলাকার সরকারি কর্মচারীদের কৈফিয়ত দিতে হয়। সন্তোষজনক কৈফিয়ত দিতে না পারলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নয়াচীনের একটা বড় সমস্যা ছিল বেকারত্ব। সেই বেকারত্ব দূর করতে নয়াচীন সরকার কুটিরশিল্পের দিকে নজর দেয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘নয়াচীন বেকার সমস্যা দূর করতে চেষ্টা করছে। এ জন্য তারা নজর দিচ্ছে কুটিরশিল্পের দিকে। কুটিরশিল্পে সরকার থেকে সাহায্য করা হয়। হাজার হাজার বেকারকে কাজ দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের তাঁতিদের মতো লক্ষ লক্ষ তাঁতি কাপড় তৈয়ার করে সুতা কেটে জীবন ধারণ করে।’ সাংহাই ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ লক্ষ বেকার আছে, তাদের সরকার টেকনিক্যাল ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করেছে। কাহারও ছয় মাস লাগবে, কাহারও এক বৎসর, আর কাহারও চার বৎসর লাগবে। এদের ট্রেনিং হওয়ার সাথে সাথে কাজ মিলে যাবে। ট্রেনিংয়ের সময় সরকার এদের অ্যালাউন্স দেয়, যদিও তা যথেষ্ট নয়।... তিন বৎসর পরে যদি কোনো দিন আসেন তবে দেখতে পাবেন, একটাও আর বেকার লোক নয়াচীনে নাই।’ এগুলো দেখেশুনে বঙ্গবন্ধু স্বগতোক্তি করেছেন, ‘কত বড় সংকল্প এদের মনে।’
যেকোনো দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সে দেশের কৃষি। বঙ্গবন্ধু নয়াচীনের কৃষিরও আদ্যোপান্ত খবর নিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘নয়াচীন সরকার কায়েম হওয়ার পরে তারা প্রথম কাজ শুরু করলেন, লাঙল যার, জমি তার—এ প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে। বড় বড় জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করে গরিব জমিহীন কৃষকের মধ্যে বণ্টন করে দিল। সত্যিকারের কৃষক জমির মালিক হলো। যে সমস্ত অনাবাদি খাসজমি পড়ে ছিল, তা–ও ভাগ করে দিল কৃষকের মধ্যে। হাজারো বেকার কৃষক জমি পেল।... নয়াচীনে একখণ্ড জমি দেখলাম না, যা অনাবাদি অবস্থায় পড়ে আছে।... যে চাষি সকলের চেয়ে বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারবে, তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে। গ্রামে গ্রামে মিউচুয়াল এইড সোসাইটি গড়ে উঠেছে।... এতে সকলের মধ্যে একতা গড়ে উঠেছে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য, সকলেই সকলের জন্য—এই নীতির খুব প্রচার হয়েছে এবং কাজও সেইভাবে হতেছে। গ্রামের গরিব চাষিরা একতাবদ্ধ হয়ে চাষাবাদ করাতে মানুষের মধ্যে বিভেদ ভাব দিন দিন দূর হয়ে যেতেছে।’
যেকোনো দেশের উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না, যদি এতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করা যায়। নয়াচীনের সরকার এ জায়গায় নজর দিয়েছিল এবং রাষ্ট্রীয় সব কাজে জনগণকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাত। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘চীনের সরকারের কাজের একটা কায়দা আছে। তারা সকল কাজেই জনগণের সাহায্য চায়। জনগণ বুঝতে পারে, এ কাজ তাদের মঙ্গলের জন্য, তাই সরকার যখনই ডাক দেয়, লক্ষ লক্ষ লোক তাতে সাড়া দেয়। এক জায়গায় শুনলাম, সরকার ডাক দিল, এক শত মাইল একটা রাস্তা করতে হবে। তোমাদের যথেষ্ট অসুবিধা হতেছে; সরকারের অত টাকা নাই, তাই তোমাদের নিজেদের কাজ নিজেদের করাই উচিত। প্রত্যেকের আসতে হবে, অন্তত দুই দিন কাজ করতে হবে। সমস্ত লোক এসে কাজ শুরু করল, সরকার তাদের খাবার দিল। নারীপুরুষ–নির্বিশেষে এক মাসের ভিতর রাস্তা করে দিল।... এমন বহু ছোটবড় কাজ এই তিন বৎসরে চীন সরকার করেছে।’
দুর্নীতি যেকোনো দেশের জীবনমান উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। সমাজের প্রতিটা স্তর থেকে এর নির্মূল সম্ভব না হলে সমাজে কখনোই সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। নয়াচীন সরকার দুর্নীতি তুলে দিতে ছিল বদ্ধপরিকর। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘নয়াচীন থেকে দুর্নীতি তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে এই কারণে যে রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা ঘুষ–দুর্নীতি তুলে দিতে বদ্ধপরিকর। আমি নয়াচীনে একটা ঘটনা শুনেছিলাম যে, মাও সে তুংয়ের একজন প্রধান বন্ধু এবং নয়াচীনের নেতা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছিল বলে তাকে বিচার করে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। ইচ্ছা করলে মাও সে তুং তাকে রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু বিচারে যাকে ফাঁসির হুকুম দিয়েছে তাকে রক্ষা করা অন্যায়।’ এটা দেখে বন্ধবন্ধু স্বগতোক্তি করেছেন, ‘দুর্নীতি সমাজের ক্যানসার রোগের মতো। একবার সমাজে এই রোগ ঢুকলে সহজে এর থেকে মুক্তি পাওয়া কষ্টকর।...ফাঁসি যদি কাহাকেও দিতে হয়, তবে চোরাকারবারি ও দুর্নীতিপরায়ণ লোকদেরই দেয়া উচিত।’
এই সফরে বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্র বিষয়েও আলোকপাত করেছেন। একটা রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র প্রতিনিধির ওপর দেশের ভাবমূর্তির অনেকটাই নির্ভর করে। এই সফরে বিভিন্ন দেশের ডেলিগেটরা এসেছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু বিদেশে তখনকার পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির একটা ধারণা পান। তাঁর ভাষায়, ‘অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি আমার সাথে আলাপ করতে করতে বললেন, তোমার দেশের রাষ্ট্রদূতরা মনে করে, দুনিয়ার মানুষ আহম্মক! আমি বললাম, কেন এ কথা বলছেন? তিনি উত্তর করলেন যে রাষ্ট্রদূত ও কর্মচারীরা যেভাবে থাকেন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও সেভাবে থাকতে পারেন না।...দেশের মানুষ না খেয়ে মরে, সেই দেশের কর্মচারী অথবা রাষ্ট্রনায়করা যেভাবে বাজে খরচ করে, তা ভাবলে আমাদেরও লজ্জা হয়।’ বিদেশে দেশের পরিচয়ও অনেকটাই নির্ভর করে দূতদের ওপর। যেমন দক্ষিণ আমেরিকার একটা দেশের ডেলিগেট বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, পাকিস্তান কি একটা স্বাধীন দেশ না ভারতের একটা প্রদেশ? অদূর অতীতেও অনেকেই বাংলাদেশকে ভারতের আবার পাকিস্তানের প্রদেশ মনে করতেন। অবশ্য বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়ন এখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য রোল মডেল, তাই আর বিদেশে আমাদের পরিচয় সংকটে ভুগতে হয় না।
নয়াচীনের মানুষের দেশপ্রেমও বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছিল। চীনের মানুষের দেশপ্রেম বিষয়ে লিখেছেন, ‘১লা অক্টোবর নয়াচীনের স্বাধীনতা দিবস পালন করা হবে।... চীনে এই দিনটাকে লিবারেশন ডে বলা হয়।... এই দিন সমস্ত চীনের লোক কাজকর্ম ছেড়ে আনন্দ করে। দিন দিন যে আনন্দ বেড়ে চলেছে এদের। এই দিন প্রত্যেকে তাদের কাজের হিসাব নেয় ও দেয়। দেশের জন্য কী করেছে এক বৎসরে কী কী ভালো কাজ করেছে। দেশ কত দূর অগ্রসর হয়েছে? রাস্তা কত হয়েছে? শিল্প কতগুলি বেড়েছে। কৃষক জমি পেয়ে কত বেশি ফসল উৎপাদন করেছে? এই দিনে তারা তার হিসাব করে। যার যা ভালো কাপড় আছে, তা বের করে পরে। মাওকে দেখবে, তাঁর বাণী শুনবে। মানুষ যেন পাগল হয়ে গেছে।’
এই সফর শেষে বঙ্গবন্ধু নয়াচীনের সার্বিক অগ্রগতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘নয়াচীনের উন্নতি দেখে সত্যই আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। যদি ১০ বৎসর তারা দেশকে শান্তিপূর্ণভাবে গড়তে পারে, তবে দেশের জনসাধারণের কোনো দুঃখ-দুর্দশা থাকবে না, অশিক্ষা–কুসংস্কার মুছে যাবে এবং দুনিয়ার যেকোনো শক্তির সাথে মোকাবেলা করতে পারবে সকল দিক থেকে। কারণ, জাতিকে গড়ে তোলার যে প্রধান শক্তি জনসাধারণের মনোবল, তা নয়াচীনের জনগণের মধ্যে আছে।’ অবশেষে লেখাটা শেষ করেছেন একটা সুন্দর দেশের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।’
দেশকে ভালোবাসার এবং বিদেশের মাটিতে দেশের সম্মান রক্ষা করার বিষয়েও এই বইয়ে বঙ্গবন্ধু একটা ধারণা দিয়েছেন—‘আমরা হংকং থাকতে সভা করে নিয়েছিলাম, আমাদের দেশের ভিতরের খবর কেহ সভায় বলব না এবং আলোচনা করব না। আমাদের দেশের মুসলিম লীগের শাসনের কথা যদি বলি, তবে দুনিয়া হাসবে। কারণ, মুসলিম লীগের গণতন্ত্রের যে রূপ, তা কোনো সভ্য সমাজে না বললেই ভালো হয়। কারণ, তাতে পাকিস্তানের ইজ্জত যাবে।’ বঙ্গবন্ধুর গোছানো মানসিকতার একটা পরিচয় পাওয়া যায় এই বইয়ের শেষে ভ্রমণের নোটগুলো পড়ে। আসলে যেকোনো লেখা শুরু করার আগে এভাবে নোট নিয়ে নিলে লেখাটা অনেক সহজ হয়ে যায় এবং কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেন বাদ না পড়ে, সেটাও নিশ্চিত করা যায়। যদিও এই বইয়ের শুরুতে বঙ্গবন্ধু বিযয়বশত বলেছেন যে তিনি কোনো লেখক নন। কিন্তু এই বই পাঠ করলে মনে হবে, এটা কোনো পেশাদার লেখকের ভ্রমণকাহিনি। অনেকেই এই লেখাকে সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমণকাহিনির সঙ্গে তুলনা করবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
এই বইয়ের শেষে যোগ করা দুর্লভ আলোকচিত্রগুলো বইয়ের লেখাকে যেন পূর্ণতা দিয়েছে।