শুধু সম্পর্ক নয়, ভালোবাসা কিসে আটকায়

২০২৩ সালেও গানের সুরে, বেদনা ভরা মন নিয়ে, এমনকি মশকরার ছলে বলা হচ্ছে নারী তার মেধা, সক্ষমতা ও যোগ্যতাবলে পুরুষের পাশাপাশি অবস্থান নিলেও এই সমাজ এখনো পুরুষশাসিত। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নীতিনির্ধারণীতেও নারীকে খুব কৌশলে পুরুষের অধীনস্থ করে দুর্বল অবস্থানে রাখা হয়েছে। ফলে অধিকার, ন্যায্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী এখনো বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার।

আমি এসব কথার সঙ্গে একমত পোষণ করি না। কারণ, নারীরা এভাবে থাকতে পছন্দ করেন। এটা আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে নারীরা দুর্বল নন, বরং তাঁরা পুরুষের তুলনায় এত সবল যে ইচ্ছা করলে যা খুশি তা–ই করতে পারেন। কিন্তু করেন না। কারণ, প্রত্যেক নারীর মধ্যে রয়েছে মাতৃত্ববোধ। এই বোধের ক্ষমতা এত বেশি, নীরব থাকা বা কিছু না বলার দক্ষতা নারীর মধ্যে রয়েছে। মূলত সেই কারণে আমরা পুরুষেরা ভাবি, নারীরা দুর্বল।

যুগ যুগ ধরেই দম্পতির আচমকা সম্পর্কের অবনতি দেখে আসছি। গরিবের ধারণা, অভাবের কারণে সংসার ভাঙে। কিন্তু বিশ্বের বিত্তবান ব্যক্তিদের অর্থ, বিত্ত, প্রভাব, ক্ষমতা থাকার পরও সম্পর্ক টেকে না। ফলে প্রশ্ন নারী বা পুরুষের এই সামাজিক সম্পর্ক, ভালোবাসা আসলে কিসে আটকায়?

দেখা যায়, পুরুষের চেয়ে প্রশ্নের তিরটা নারীর প্রতিই বেশি ছোড়া হয়। ভাবখানা এই, সামাজিক সম্পর্ক টেকানোর দায়টা যেন শুধু নারীরই। আসল ও সত্য কথাটি কেউ তুলে ধরছে না হিম্মতের অভাবে। যুগ যুগ ধরে সবাই নিজের মতো করে ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ দিয়ে গেলেন, কিন্তু মনের কথা কেউ খুলে বললেন না।

এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় সেটা হলো, প্রচলিত মিথ্যা সামাজিক মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতা অনুসারেই এসব ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে।

সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষ কিসে আটকায় বলতে যে যুক্তি ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে, তা নারী বা পুরুষ কারোর জন্যই সুন্দর নয়।

রীতিমতো অসম্মানজনক। পুরুষের টাকা থাকলে, পুরুষ সুদর্শন হলে কিংবা ক্ষমতাবান হলেই যে নারী তাঁর প্রতি দুর্বল থাকবেন, থেকে যাবেন—এমন ধারণা পোষণ যথার্থ বা সঠিক নয়। এবং সেটা বর্তমান যুগে তো নয়ই। এখানে নারীর মূল্যবোধ, বিবেককে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে। এককথায়, নারী টাকাপয়সায়, বিত্তে, রূপে এবং ক্ষমতার প্রতি যে দুর্বল, সেটাকেই বোঝানো হয়েছে; যেটা মোটেও কাম্য নয়, যুক্তিসংগতও নয়। এটা একধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ অভিমত নিঃসন্দেহে।

একই কথা প্রযোজ্য পুরুষের ক্ষেত্রেও। দেখা যায়, শিক্ষিত, সুন্দরী ও সম্পদশালী স্ত্রী ঘরে থাকলেও অনেক পুরুষের বহুগামিতা বা নারীপ্রীতি রয়েছে। অন্য নারীর প্রতি তাঁর বেপরোয়া আসক্তি দেখা যায়। সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার অভাবের পাশাপাশি ব্যক্তির শারীরিক কোনো ত্রুটি হতে পারে এর কারণ। আবার রূপ, গুণ ও অর্থের প্রতি কোনো কোনো নারী বা পুরুষ যে দুর্বল হন না, তা–ও কিন্তু নয়। অস্বাভাবিক চাহিদা, লোভ ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করে, বিপথে ঠেলে দেয়।

সম্পর্ক কী—এই প্রশ্নের জবাব নানাজনে নানাভাবে দিতে পারেন এবং সেটা হতে পারে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস ও দর্শনের ওপর ভিত্তি করে। ফলে সম্পর্ক বিষয়ে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির তফাত থেকে যায়। তবে সাধারণভাবে সম্পর্ককে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির গভীর যোগাযোগ বোঝায়, যা সম্পূর্ণভাবে একটা সুস্থ, সুষ্ঠু বিশ্বাসের প্রক্রিয়ার চর্চার মধ্য দিয়ে রচিত হয়, গভীর হয় এবং বিদ্যমান থাকে।

তবে মনে রাখা দরকার, অনেক সময় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ভালোবাসার জন্ম নেয় বা ভালো লাগা, ভালোবাসা থেকে সম্পর্কের গভীরতা বেড়ে যায়। নারী ও পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্ক অতীতে আমাদের সমাজে ছিল একটা সামাজিক চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক, যা কিছু রীতিনীতি ও কাগজে–কলমে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে গ্রথিত হয়েছে। অতীতে পছন্দ করে বিয়ে কিংবা আলাপ-আলোচনা করে বিয়ে—সব ধরনের বিয়েকে সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে সম্পন্ন করতে হয়েছে। আবার সামাজিক রীতিনীতির বাইরে গিয়েও কেউ কেউ এমন সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে, সেখানে আকাশ-বাতাসকে সাক্ষী মানা হয়েছে।

মূলত বিয়ে সম্পর্কের শুরুতে থাকে বিভিন্ন আয়োজন, অনুষ্ঠান। সবটাই থাকে আনন্দঘন ও উৎসবমুখর। কিন্তু সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার সময় শুধু স্বাক্ষরের প্রয়োজন পড়ে আমাদের সমাজে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সম্পর্ক ভেঙে যায়? প্রতিটি সম্পর্ক ভাঙার ক্ষেত্রে থাকে ভিন্ন ভিন্ন কারণ। তবে সাধারণভাবে কারণ হিসেবে যেটা আসে, সেটা হলো আস্থা ও বিশ্বাসে ফাটল কিংবা সম্পর্কের মোহ কেটে যাওয়া। অনেকের মতে, সামাজিক নৈতিকতা ও শৃঙ্খলা বোধের অভাবই এই প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। মানিয়ে চলা, মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না—এমন অজুহাতও সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার কারণ হিসেবে আসে।

অনেক সময় সন্তানসন্ততি হওয়ার পরও নারী ও পুরুষ নিজেদের প্রাপ্তির হিসাব কষতে বসেন। কারণ, সমাজটা এখন ব্যক্তিপ্রধান এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার দিকে ধাবিত হয়েছে। তবে কামনা-বাসনার বিষয়টি মুখ্য বলে কেউ কেউ মনে করেন, আমিও কিন্তু এই দলে। সেই সঙ্গে আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির প্রচলন ও তার ব্যবহার জীবনকে এতটাই সহজ করে দিয়েছে যে জীবনের প্রতি ব্যক্তির যত্ন, দায়বোধও কমে গেছে। সহজভাবে সবকিছু পাওয়া, ভোগ করার আচরণ আধুনিক বিশ্বের মস্ত বড় খেসারত হতে পারে আরেকটি দিক।

একটা সময় ছিল, সম্পর্ক বিষয়টা রক্ষণশীল বেড়াজালে আবদ্ধ রাখা হতো। পরিচর্যার বিষয়টি অনুসৃত হতো। আমি সুইডেনে নিজে দেখেছি, এখানে অনেকে সম্পর্কে ধরে রাখতে একসঙ্গে বাড়ি নির্মাণ করেছেন, বিয়ে করেছেন, সন্তান নিয়েছেন তারপরও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারেননি। অনেকে বলবেন, আধুনিক বিশ্ব সেই বেড়াজাল থেকে সম্পর্ককে উন্মুক্ত করেছে। দুটো ডানা দিয়েছে। একটুতেই নারী ও পুরুষের ভেতর থেকে সম্পর্ক উড়াল দেয়।

অন্যত্র ঠাঁই নেয়। ব্যক্তি যতই তাঁর অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন, যতই অধিকার বিষয়ে সমাজে আইন প্রণয়ন হচ্ছে, ততই যেন সম্পর্ক ভাঙতে সহজ হচ্ছে। আস্থা, ভরসা ও বিশ্বাসের অভাব—এমন সম্পর্ক রেখে লাভ কী? কিংবা সম্পর্কের ভেতরে একঘেয়েমি চলে আসছে, জীবন ত্যানাত্যানা—এমন অজস্র কারণ ও মনোভাব রয়েছে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পেছনে।

দুটি ভিন্ন সত্তার মানুষ এক বিন্দুতে থেকে চলাটা কিন্তু ওই দুই ব্যক্তির চাওয়া ও পাওয়ার ওপর নির্ভর করে। তাঁরা কী চান, কী পাবেন—এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। অন্য কারও অধিকার নেই সে বিষয়ে কথা বলার। এখানে যেকোনো সুস্থ সম্পর্কই হলো সভ্যতার অন্যতম সামাজিক আচরণ, যা সভ্যতাকে টিকে থাকতে সাহায্য করে, সুশৃঙ্খল করে। পরিশেষে বলব, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে তুলনা করে আমাদের সামাজিক সম্পর্কের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ প্রদান করার সময় এসেছে। কারণ, আমরা বিশ্বায়নের রণক্ষেত্রের অংশীদার।

মূল কথা হলো, বীজ বপনের পর যেমন বৃক্ষের যত্ন লাগে, বেড়ে উঠতে জায়গার প্রয়োজন হয়, ঠিক সম্পর্কের বেলায়ও যত্ন লাগে, জায়গার প্রয়োজন হয়। ‘ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে/ আমার নামটি লিখো...তোমার মনের মন্দিরে।’

সম্পর্ক, ভালোবাসা কিসে আটকায় না, কিসে মজবুত ও বিস্মৃত হয়, সেই অনুসন্ধান করলে ব্যক্তির ভেতরকার ঝামেলা হয়তো দূর হতে পারে, তবে সবকিছুর পরও যেটা সত্যি সেটা হলো, ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা, সেটা যখন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ঝরতে থাকে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বিচ্ছেদে পরিণত হয়।

ভুলে গেলে চলবে না, মানুষ বিয়ে করে যখন যৌবনের মৌ বনে দোলা দেয়। যৌবন যখন আর আগের মতো দোলা না দেয় পরস্পরের প্রতি, তখন মৌমাছি যেমন নতুন মধুর আহরণে বের হয়, ঠিক একই ঘটনা ঘটে আমাদের ক্ষেত্রেও। এটাই সত্যি, বাকি সব যা ওপরে লিখেছি—সাহিত্য, রচনা। যদি সত্যিই সম্পর্ক, ভালোবাসাকে আটকাতে ইচ্ছা হয় তবে ‘ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে/ আমার মুখর পাখি...তোমার প্রাসাদও প্রাঙ্গণে॥’