পিএইচডি শিক্ষার্থী ও একাডেমিক লাইফে মানসিক স্বাস্থ্য

আমরা অনেকেই এখন অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে যাচ্ছি পিএইচডি অথবা একাডেমিক কোনো চাকরি নিয়ে। আমি সব সময় বলি যে পিএইচডিতে চান্স পাওয়ার চেয়ে পিএইচডি সফলভাবে শেষ করা কঠিন। শুধু একাডেমিকভাবে ভালো হলেই হয় না, এর সঙ্গে যুক্ত থাকে অনেক মানসিক বিষয়। মানসিকভাবে শক্ত থাকা, নিজেকে অনুপ্রাণিত করা, পজিটিভিটির সঙ্গে থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পিএইচডি অনেক দেশেই একটি ফুল টাইম চাকরি এবং অধিকাংশই ফান্ডেড প্রজেক্টের সঙ্গে থাকায়, মাসিক একটি ভালো বেতন পাওয়া যায় চলার জন্য। এখন মানুষ হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই একটি সামাজিক জীবন থাকবে। আর সামাজিক জীবন মানেই আনুষঙ্গিক কিছু বিষয় চলে আসে। আমি নিজের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করব।

অনেকেই পিএইচডি করাটাকে খুবই সহজ মনে করেন। একবার প্রবাসে একজন বাংলাদেশি আমার সহধর্মিণীকে বললেন, ‘আপনি পিএইচডি করেন না কেন? দুজনেরই ইনকাম হলো।’ আমার সহধর্মিণী হঠাৎ বেকুব বনে গেলেন। যেন পিএইচডি করাটা ক্লাস থ্রি শেষ করে ক্লাস ফোরে উঠে যাওয়া। কেউ কেউ অনুগ্রহের চোখে তাকান, যেন তাঁরা খুব কষ্টে আছেন। আমাকে একবার এক আত্মীয় বললেন, ‘এসব পিএইচডি করে কী হবে? তুমি ঘণ্টা বাড়িয়ে দিতে পারো না!’ কিসের ঘণ্টা, সেটি এখনো বুঝতে পারিনি আমি। কিছু বিষয় খেয়াল করলে, নিজের মতো থাকলে সামাজিক অনেক উটকো অস্থিরতা থেকে নিজেকে দূরে রেখে, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রেখে পিএইচডি শেষ করা যায়।
১.
একাডেমিক চাপ: পিএইচডির একাডেমিক চাপ একটু অন্য রকম। প্রথমে কোর্সগুলো কমপ্লিট করা। অনেক কোর্সে অনেক নতুন কিছু বুঝতে সমস্যা হয়। ভালো গ্রেড না আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে অস্থির হওয়া যাবে না। মাথা ঠান্ডা রেখে শেষ করতে হবে। সুপারভাইজারের কিছু  একটি প্রফেশনাল মজবুত সম্পর্ক রাখতে হবে। অনেক সময় মনে হবে, প্রফেসরের এ কমেন্টটি ঠিক না বা মনে হবে, এভাবে না করলে অন্যভাবে করতে পারলে ভালো। নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো কিছু করে ফেললে হবে না। অধ্যাপক যেভাবে কাজটি চাচ্ছেন, সেভাবেই এগোতে হবে। প্রত্যাশা রাখা যাবে না যে পাবলিকেশন জমা দিলেই তা অ্যাকসেপ্ট হবে। রিজেকশন আসবে জীবনে, তা মাথায় রাখতে হবে। মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে সব ধরনের পরিস্থিতি সামলে ওঠার।

২.
মা-বাবা, ভাই-বোন, জীবনসঙ্গীর সঙ্গে শেয়ার করুন আপনার অবস্থা। এ পরিধি যত ছোট রাখা যায়, তত ভালো। এমনকি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও কোনো কিছু শেয়ার করলে অনেক সময় মজা নেয়, তামাশা করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।
৩.
কে কী বলল, পাত্তা না দেওয়া, যদি আপনি নিজে সৎ থাকেন। অনেক জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষ আপনাকে অনেক কিছু বলতে আসবে। এখানে না, ওখানে করলে ভালো হতো। একাডেমিক লাইফের বেতন কম, পিএইচডি করে সময় নষ্ট, আরও অনেক কিছু। এগুলো একদম ইগনোর করা।
৪.
আপনি কাউকে অনেক পছন্দ করতেন বা করেন, ভালো মানুষ মনে করতেন, কিন্তু তাঁর আচার-আচরণে তার কোনো প্রকাশ নেই। বুঝতে পারছেন তিনি আপনাকে ইগনোর করছেন বা আপনার মতো তিনি আপনাকে আসলে পছন্দ করেন না। কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে আনেন। তিনি যে রকম, সে রকম হয়ে যান।
৫.
বিবাহিত হলে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক থাকতে হবে। তাঁকে সময় দিতে হবে। তিনি আপনার সঙ্গে অনেক বিষয়ে সেক্রিফাইস করছেন। সময় পেলে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে হবে। প্রবাসজীবন এমনিতেই অনেক রংহীন। জীবনকে রঙিন করার রেসিপি জানতে হবে।

৬.
প্রবাসে বাংলাদেশিদের কেউ মিশতে চাইলে খেয়াল করুন, তাঁর সঙ্গে আপনার মনমানসিকতা মেলে কি না। যদি না মেলে, তাঁদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। সবার সঙ্গে মিশতে হবে মনে করে বিষাক্ত মানুষের সঙ্গে মেশার কোনো কারণ নেই।
৭.
পিএইচডি শেষে চাকরি নিয়ে চিন্তা করার কোনো দরকার নেই। পিএইচডি হয়ে গেলে দেশে এসেও ভালো কোনো চাকরি পাওয়া যাবে, নিশ্চিত। থিসিস লেখা শুরু হয়ে গেলে জব খোঁজা শুরু করে দেওয়া দরকার। শুধু শুধু টেনশন করলে মানসিকভাবে আরও খারাপ লাগবে।
৮.
বাসার কাজ করা—রান্না করা, ঘর সাজানো—এসব করলে মন ভালো থাকে। ইউটিউব দেখে অথবা নিজের মতো করে কোনোও একটি রান্না করে ফেলেন। সবাইকে সারপ্রাইজ দেন। সন্তান থাকলে ওদের অনেক আদর করুন, ওদের মুখের দিকে প্রতিদিন তাকিয়েও অনেক অনুপ্রাণিত হওয়া যায়। ভালো লাগবে।

৯.
কেউ কোনোও নেগেটিভ কথা বললে সঙ্গে সঙ্গেই মেজাজ গরম না করে সেখান থেকে সরে আসুন। পরবর্তী সময়ে নিজের কাজের মাধ্যমে তার জবাব দেওয়া।
১০.
সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করা, দোয়া-প্রার্থনা করা, দান করা। কেউ উপকার চাইলে নিজের সামর্থ্যে থাকলে তাঁর উপকার করা। সর্বোপরি বিনয়ী হওয়া। বিন্দুমাত্র কোনো বিষয়ে অহংকার না করা।

অবশেষে, প্রত্যেক মানুষের বিষণ্নতা, অস্থিরতা দূর করার নিজস্ব কিছু টেকনিক থাকে। সেই টেকনিকগুলো চর্চা করে, সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে যেদিন সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি আসবে, সেদিন সব ধরনের চাপের কথা আর মনে থাকে না। কিন্তু এ যাত্রাপথে জীবনে অনেক কিছু জানতে পারবেন, বুঝতে শিখবেন জীবন নিয়ে। সারা জীবনের জন্য এ শিক্ষাগুলো পাথেয় হয়ে থাকবে।


*লেখক: মুহিদুল ইসলাম খান, সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক, স্ট্যাভাংগার ইউনিভার্সিটি, নরওয়ে